পাবনা নামের উদ্ভব সম্পর্কে বিশেষ ভাবে কিছু জানা যায় না। তবে বিভিন্ন মতবাদ আছে। প্রত্নতাত্মিক কানিংহাম অনুমান করেন যে, প্রাচীন রাজ্য পুন্ড্র বা পুন্ড্রবর্ধনের নাম থেকে পাবনা নামের উদ্ভব হয়ে থাকতে পারে। তবে সাধারণ বিশ্বাস পাবনী নামের একটি নদীর মিলিত স্রোত ধারার নামানুসারে এলাকার নাম হয় পাবনা। ‘পাবনা’ নামকরণ নিয়ে কারও মতে, ‘পাবন’ বা ‘পাবনা’ নামে একজন দস্যুর আড্ডাস্থল একসময় ‘পাবনা’ নামে পরিচিতি লাভ করে। কয়েকজন ইতিহাসবিদ মনে করেন, ‘পাবনা’ নাম এসেছে ‘পদুম্বা’ থেকে। কালক্রমে পদুম্বাই স্বরসঙ্গতি রক্ষা করতে গিয়ে বা শব্দগত অন্য ব্যুৎপত্তি হয়ে ‘পাবনা’ হয়েছে। ‘পদুম্বা’ জনপদের প্রথম সাক্ষাৎ মেলে খ্রিস্টীয় একাদশ শতকে পাল নৃপতি রামপালের শাসনকালে। তন্তুবায়ী বা তাঁতীর সংখ্যাধিক্য ছিল এই জেলায় প্রাচীনকাল থেকেই। এই সব তন্তুবায়ীরা তুলা বা তুলাজাত দ্রব্য থেকেই কাগজ তৈরী করত। এই জাতিবাচক শব্দ ‘পানবহ’ থেকে পাবনা শব্দের উৎপত্তি ঘটেছে বলে অনেকে মনে করেন। ১৮২৮ সালের ১৬ অক্টোবর পাবনাকে জেলা হিসেবে ঘোষণা করা হয়।
সাবেক পাবনা (সিরাজগঞ্জ জেলাসহ) জেলা রূপে গঠিত এলাকাটি প্রাচীন যুগে পূর্ব ভারতের বঙ্গ ও পুন্ড্রুবর্ধন জনপদের অংশ ছিল। গঙ্গারিডির রাজত্বের অবসানের পর বৃহত্তর পাবনা মৌর্য সাম্রাজ্যভুক্ত হয়। রাজা অশোক পুন্ডুসহ সমগ্র বাঙলা নিজ শাসনাধীনে এনেছিলেন।এ অঞ্চল সমুদ্রগুপ্তের সময়ে (৩৪০-৩৮০ খ্রিষ্টাব্দ) গুপ্ত সম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল এবং প্রথম কুমার গুপ্তের (৪১৩-৪৫৫ খ্রিষ্টাব্দ) শাসনামলে পাবনা (সিরাজগঞ্জসহ) জেলা উত্তর বাংলার পুন্ড্রবর্ধন ভুক্তি নামে গুপ্ত সাম্রাজ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক বিভাগে পরিণত হয়েছিল। সপ্তম শতকের প্রারম্ভে শশাংক পরবর্তী গুপ্তদের উচ্ছেদ সাধনে সাফল্য অর্জন করেন। তিনি উত্তর ও পশ্চিম বাংলা এবং মগধ নিয়ে গৌড় রাজ্য নামেএকটি স্বাধীন শক্তিশালী রাজ্য স্থাপন করেন। ৬৩৭ খ্রিঃ শশাংকের মৃত্যুর পর হর্ষবর্ধন এই অঞ্চলের উপর কর্তৃত্ব স্থাপন করতে সক্ষম হন। অষ্টম শতকের প্রারম্ভে ৭২৩ এবং ৭৩৫ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে কোন এক সময়ে কনৌজের যশোবর্ধন গৌড়রাজকে পরাজিত করে বাংলাদেশ দখল করেন এবং পাবনা জেলাসহ প্রায় সমগ্র বাংলা তাঁর হস্তগত হয়। ৭৩৬ খ্রিষ্টাব্দে কাশ্মীরের ললিতাদিত্য যলোবর্ধনকে পরাজিত করে এ অঞ্চলের উর প্রভুত্ব বিস্তার করে। পরবর্তীকালে পাবনা পালদের অধীনে এসে যায়। ১১২৫ সাল নাগাদ পালদের পতন ঘটে এবং এ অঞ্চলে সেন শাসন শুরু হয়ে যায়। ১২০৪ খ্রিষ্টাব্দে ইখতিয়ার উদ্দিন মুহম্মদ বখতিয়ার খলজী লক্ষণ সেনের রাজধানী নদীয়া আক্রমণ করে লক্ষণাবতীর অধিকার নেন। বলা যায় পাবনা জেলায় ১২০৫ হতে মুসলিম সাম্রাজ্য চালু হয়। ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাতে ১৭৫৭ সালে নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার সমগ্র স্বাধীন বাংলার কর্তৃত্ব হারানোর মাধ্যমেই গৌড় মুসলিমদের সাম্রাজ্যের পরিসমাপ্তি ঘটে; বাংলার দেউয়ানী বক্সারের যুদ্ধেই অর্জন করে ইংরেজরা।
পাবনা জেলার লোক সংঙ্গীত , লোকগাঁথা, লোকনৃত্য, কৌতুক, নকশা, পালাগান, ইত্যাদি লোকসংস্কৃতিতে অত্যমত্ম ঐতিহ্য মন্ডিত। অতি প্রাচীনকাল হতেই এ জেলার বস্ত্র শিল্প প্রসিদ্ধ , গ্রামে গ্রামে বস্ত্র বয়নকারী হিন্দু মুসলমান উভয় জাতি সম্প্রদায় মিলে মিশে কাজ করে। হান্ডিয়ালের বিবরন প্রসংগে অবগত হওয়া যায় একমাত্র এখানেই কোম্পানি আমলের সমস্ত ভারতবর্ষের চার পঞ্চমাংশ রেশম আমদানি হত। ধুয়া গান, বারাসে গান, জারি গান, সারি গান, যাগ গান, তত্ত্বমূলক গান, মেয়েগান প্রভৃতি লোকসঙ্গীত প্রচলিত রয়েছে। এ অঞ্চলের মানুষ মুখে মুখে ছড়া, ধাঁধাঁ, প্রবাদ-প্রবচন, নানা ধরনের লোকগাথা, উপকথা বলে থাকে। নৌকাবাইচ, তীর-ধনুক খেলা, লড়ি-লাঠি খেলা, ডাংগুলি খেলা, কুস্তি খেলা, কাছি টানাটানি খেলা, জোড়-বিজোড় খেলা, পাঁচগুটি খেলা, সাঁতার খেলা, বাগরজানি খেলা, বাঘ-বন্দী খেলা, গোল্ললাছুট খেলা, হা-ডু-ডু খেলা, কানামাছি খেলা, কুমির-ডাঙ্গা খেলা, সাপ খেলা, বানর খেলা, ঘুড়ি উড়ানো ইত্যাদি পাবনা জেলায় বেশ জনপ্রিয়। পাঁচগুটি খেলা, ডুব-সাঁতার খেলা, কড়ি খেলা, বৌ-ছি খেলা, এক্কা-দোক্কা খেলা, রান্না-বাড়ি খেলা, পুতুল খেলা, ওপেন্টি বাইস্কোপ খেলা, তালকাটি খেলা, ধাঁধার খেলা ইত্যাদি খেলা উল্লেখযোগ।
পদ্মার ইলিশ আর পাবনার ঘি,
জামাইয়ের পাতে দিলে আর লাগে কি!
পাবনার প্রসিদ্ধ ঘি এর কদর বাঙলা দেশের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে পরেছে। এমন কি দেশের গন্ডি পেরিয়ে বিদেশে পাবনার ঘি এর কদর রয়েছ। পাবনার দই,মিষ্টি এগুলো বিখ্যাত। পাবনা অঞ্চলের কয়েকটি বিখ্যাত খাবার হল লাউ চিংড়ি, লাউ বরইয়ের খাট্টা, চিংড়ি কলার মোচা ঘণ্ট, বেগুনের খাট্টা, চিংড়ি শুটকি দিয়ে ডাটা শাক।
পাবনা শহেরই কিংবদন্তি নায়িকা নায়িকা সুচিত্রা সেনের পৈতৃক বাসভবেন অবস্থিত। শৈশব ও কৈশোরের অনেকটা সময় সুচিত্রা সেন কাটিয়েছেন এই বাড়িতে। এখানেই গড়ে উঠেছে সুচিত্রা সেনের স্মৃতি সংগ্রহশালা।ঋত্বিক ঘটকের জন্ম ঢাকায় হলেও তাঁর আদিবাড়ি পাবনা জেলার নতুন ভারেঙ্গায়। প্রমথ চৌধুরীর (বীরবল) পৈতৃক নিবাস পাবনা জেলায়। পাবনার চাটমোহর উপজেলা সদরে যুগ যুগ ধরে দাড়িয়ে আছে ঐতিহাসিক মাসুম খাঁর মসজিদ চার শতাধিক বছর পূর্বে নির্মিত মাসুম খাঁ কাবলীর মসজিদটি কালের সাক্ষী হয়ে রয়েছে চাটমোহর উপজেলা পরিষদের পশ্চিমে। পাবনা শহরের প্রাণকেন্দ্রে দক্ষিণ রাঘবপুরে শহরের পূর্ব-দক্ষিণে এ জোড়বাংলা মন্দিরটি অবস্থিত। স্থানীয় লোকমুখে প্রচলিত কাহিনীতে জানা যায় যে, ব্রজমোহন ক্রোড়ী নামক মুর্শিদাবাদের নবাবের এক তহশিলদার আঠার শতকের মধ্যভাগে এ মন্দির নির্মাণ করেন। পাবনা শহরের প্রাণকেন্দ্রে বনমালী রায় বাহাদুরের তাড়াশ বিল্ডিং এখন পর্যন্ত প্রায় অক্ষত অবস্থায় আছে। পাবনার জমিদারদের মধ্যে সবচেয়ে নামকরা এবং প্রাচীন বলে পরিচিত এই তাড়াশের জমিদার। পাবনা শহরের সন্নিকটে হেমায়েতপুর গ্রামে শ্রী শ্রী ঠাকুর অনুকূল চন্দ্রের সৎসঙ্গ(আশ্রম-মন্দির) টি অবস্থিত। ইতিহাস আর ঐতিহ্যের অনন্য এক নিদর্শন পাবনার বেড়া উপজেলার জমিদার বাড়ি। কালের বিবর্তনে যার অনেক কিছুই হারিয়ে যেতে বসেছে। চলন বিল বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বিল এবং সমৃদ্ধতম জলাভূমিগুলির একটি। পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলার পাকশী ও কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা উপজেলার মাঝ পদ্মা নদীর উপর নির্মিত দেশের বৃহত্তম রেল ব্রিজটির নাম পাকশী হার্ডিঞ্জ ব্রীজ। শাহজাদপুর উত্তরবঙ্গের প্রাচীন জনপদ। বর্তমানে এটি সিরাজগঞ্জ জেলার একটি উপজেলা হলেও আগে পাবনা জেলার অন্তর্গত ছিল। জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারের জমিদারী, পোরজনা-পোতাজিয়ার জমিদারদের জমিদারী আর শাহ মুখদুম (রহ.) এর স্মৃতিবিজড়িত জনপদ শাহজাদপুর। জমিদারী সুত্রেই শাহজাদপুরে এসেছিলেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। বলা হয়ে থাকে শাহজাদপুরের অনাবিল সৌন্দর্য আর নদীগুলোর জলের যৌবনা স্রোতধারায় মুগ্ধ হয়েই রবীন্দ্রনাথ বারবার ছুটে এসেছেন এই জনপদে। অবস্থান করেছেন দীর্ঘ সময়। এই এলাকার নদীতে বসে তিনি কবিতা লিখেছেন; গড়ে তুলেছেন সমবায় সমিতি। কৃষকদের সাথে মিশে করেছেন কৃষি বিপ্লব। আত্রাই-বড়ালের নদীপথ ধরে বজ্রা সাজিয়ে গিয়েছেন পতিসরে। রবীন্দ্রনাথের অনেক স্মৃতিকথায় উঠে এসেছে শাহজাদপুরের কথা; এ অঞ্চলের নদী-মাঠ-ঘাট-মানুষের কথা।