রূপসা, মধুমতি, কপোতাক্ষ আর ভৈরব নদীবিধৌত খুলনা ইতিহাস ও ঐতিহ্যমণ্ডিত। খুলনা নামকরণের উৎপত্তি নিয়ে মতভেদ রয়েছে। তবে সবচেয়ে বেশি আলোচিত মতগুলো হচ্ছে- ধনপতি সওদাগরের দ্বিতীয় স্ত্রী খুলনার নামে নির্মিত ‘খুলনেশ্বরী মন্দির’ থেকে খুলনা নামের উৎপত্তি। আবার কেউ কেউ মনে করেন, খুলনা শহর যেখানে, সে অঞ্চল তখন সুন্দরবনের গভীর জঙ্গলের অংশ ছিল। এই অঞ্চলের পাশ দিয়ে বয়ে যেত বিশাল ভৈরব নদ এবং এ নদে সওদাগরী জাহাজ চলাচল করত। ঝড় উঠলে ভৈরব নদের রূপ ভয়ঙ্কর আকার ধারণ করত। এতে মাঝিদের জীবন বিপন্ন হওয়ার যথেষ্ট আশঙ্কা ছিল। তাই ঝড় উঠলে বাণিজ্য তরীর মাঝিরা এখানে (ভৈরব তীরে) নোঙর ফেলত। এ সময় জলদেবতা মাঝিদের নৌকা না ছাড়ার জন্য ‘খুলোনা, খুলোনা’ বলে সতর্ক করে দিতেন। এ ‘খুলোনা’ শব্দ থেকে খুলনা নামের উত্পত্তি। ১৭৬৬ সালে ‘ফলমাউথ’ জাহাজের নাবিকদের উদ্ধারকৃত রেকর্ডে লিখিত Culnea শব্দ থেকে খুলনা। অনেক বিজ্ঞজনের মতে ‘কিসমত খুলনা’ মৌজা থেকে খুলনা নামের উৎপত্তি হয়েছে। বৃটিশ আমলের মানচিত্রে লিখিত Jessore-Culna শব্দ থেকে খুলনা এসেছে বলেও অনেকের ধারণা। তবে কোনটি সত্য তা এখনও গবেষণার বিষয়। খুলনা প্রাচীনকালে সমতট অথবা বঙ্গ রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ১২শ শতাব্দীতে এই এলাকা সেন রাজত্তের তৎকালীন রাজা বল্লাল সেনের অধীনে চলে আসে। আগে এই এলাকার নাম ছিল জালালাবাদ। ১৪শ শতকে শামসুদ্দিন ফিরোজ শাহ প্রথম মুসলিম শাসক হিসেবে এই এলাকায় আসেন। ১৫শ শতকে ধর্ম প্রচারক খান জাহান আলী এই এলাকায় আসেন এবং তিনি গৌড়ের রাজার কাছ থেকে এই এলাকার জায়গীরের ভুমিকা লাভ করেন। পরবর্তীতে তিনি এখানে শাসনকর্তা হিসেবে কাজ শুরু করেন। মৃত্যু পর্যন্ত (১৪৫৯ সাল) তিনি এখানে শাসন করেন। বাগেরহাটে তাঁর প্রতিষ্ঠিত ষাট গম্বুজ মসজিদ এবং তাঁর কবর রয়েছে। ১৭৯৩ সাল পর্যন্ত খুলনা নবাবদের অধীনে ছিল। কিন্তু ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি নিজামত তুলে দেয় এবং এই এলাকার শাসনভার গ্রহন করে। ১৮৪২ সালে যশোর জেলার খুলনা মহকুমার অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায় খুলনা শহর। ১৮৮২ সালে খুলনা শহর হয়ে যায় খুলনা জেলার কেন্দ্রস্থান।
সুন্দরবনের প্রবেশদ্বার বাংলাদেশের দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের খুলনা জেলা বাংলাদেশের তৃতীয় বৃহত্তম জেলা। শিল্প বাণিজ্য, প্রকৃতি ও লোকজ সংস্কৃতির এই অভূতপূর্ব মিলন ঘটেছে এই জেলায়। রূপসা, ভৈরব, চিত্রা, পশুর, কপোতাক্ষ সহ উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নদী বৈচিত্র্যে ভরপুর খুলনা জেলায় রয়েছে চিংড়ি শিল্প ও জাহাজ নির্মাণ শিল্প। খুলনা জেলার পেশাভিত্তিক লোকজ সংস্কৃতির মধ্যে উল্লেখযোগ্য পালকির গান, ওঝার গান, বাওয়ালীদের গান, গাছ কাটার গান, গাড়োয়ানের গান, জেলেদের গান, কবিরাজের গান, ঘোল তৈরীর গান, চুন তৈরীর গান, কুমারের গান, হাবু গান, ধান কাটার গান, ধুয়া গান ইত্যাদি। এছাড়া আছে তালের পাখা, শোলার খেলনা, বাঁশ ও বেতের পাত্র, মাটির পাত্র, পুতুল ও খেলনা, মাদুর, কাঠের খেলনা ইত্যাদি তৈরি কাজে নিয়োজিত পেশার মানুষের দ্বারা গড়ে ওঠা লোকজ সংস্কৃতি। খুলনা জেলার বিভিন্ন এলাকায় মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে আছে অনেক কিংবদন্তী। সংগৃহিত কিছুসংখ্যক কিংবদন্তির হচ্ছে- বনবিবি, ভূতের বাড়ি, গোরা ডাকাতের বাড়ি, নদীর নাম রূপসা, মিছরী দেওয়ান শাহ, চাঁদবিবি, সোনার কুমড়ো, গাজীর ঘুটো, দুধ পুকুর, কুদির বটতলা, শ্বেত পাথর, পীর ধরম চাঁদ, আলম শাহ ফকির, মহেশ্বরপাশার জোড় মন্দির, ল্যাটা ফকির প্রভৃতি।
খুলনা জেলার দর্শনীয় জায়গা ও ঐতিহাসিক স্থান গুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো: সুন্দরবন, সুন্দরবনের বিভিন্ন পর্যটন স্পট (করমজল, দুবলার চর, কটকা, হিরণ পয়েন্ট), কুঠিবাড়ি, দক্ষিণডিহি, পিঠাভোগ, রাড়ুলী, সেনহাটি, বকুলতলা, শিরোমণি, বীরশ্রেষ্ঠ রুহুল আমিনের সমাধি সৌধ, চুকনগর, গল্লামারী, খানজাহান আলী কর্তৃক খননকৃত বড় দীঘি, মহিম দাশের বাড়ি, খলিশপুর সত্য আশ্রম ইত্যাদি। খুলনা জেলার দিঘলিয়া উপজেলার সেনহাটি গ্রাম কবি কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদারের জন্মস্থান। বাংলা সাহিত্যে কবির ‘দুটি কবিতা’ শীর্ষক ক্ষু্দ্র কবিতাটি কালজয়ী স্থান পেয়েছে। ‘যে জন দিবসে মনের হরষে জ্বালায় মোমের বাতি’ কিংবা ‘চিরসুখী জন ভ্রমে কি কখন ব্যথিত বেদন বুঝিতে পারে’ কবিতা বাঙালি জীবনে অবশ্যপাঠ্য হিসেবে বিবেচিত। মুক্তিযুদ্ধে খুলনার বীরত্ব-গাথার স্মৃতিবিজড়িত আরেকটি স্থান শিরোমণি। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হলেও খুলনা স্বাধীন হয়েছিল এক দিন পর ১৭ ডিসেম্বর ১৯৭১ তারিখে। এখানে একটি স্মৃতিসৌধ স্থাপন করা হয়েছে। অধিনায়ক ক্রিকেটার মাশরাফি মর্ত্তুজা, অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসান, রুবেল হোসেন এই জেলার কৃতি সন্তান। ষাট গম্বুজ মসজিদ বাগেরহাট জেলায় অবস্থিত । ১৫ শতকের দিকে উলঘ খান-ই-জাহান এই মসজিদটি নির্মাণ করেন । ১৯৮৫ সালে ইউনেস্কো ঘোষিত বিশ্বঐতিহ্য কেন্দ্র হিসেবে ঘোষিত হয় । মসজিদের ভেতরে ৬০টি স্তম্ভ বা পিলার আছে। এই ৬০টি স্তম্ভ ও চারপাশের দেয়ালের ওপর তৈরি করা হয়েছে গম্বুজ। মসজিদটির নাম ষাট গম্বুজ (৬০ গম্বুজ) মসজিদ হলেও এখানে গম্বুজ মোটেও ৬০টি নয়, গম্বুজ, ১১টি সারিতে মোট ৭৭টি।
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পূর্ব পুরুষের নিবাস খুলনা জেলার রূপসা উপজেলার পিঠাভোগ গ্রামে। খুলনা আঞ্চলিক প্রত্নতাত্ত্বিক অধিদফতর এর পরীক্ষামূলক সমীক্ষায় পিঠাভোগ গ্রামে রবীন্দ্রনাথের পূর্ব পুরুষের ভিটার ভিত্তিপ্রস্তরের সন্ধান পাওয়া গেছে। এখানে কবিগুরুর একটি আবক্ষ মূর্তি স্থাপন করা হয়েছে। প্রতিবছর এখানে রবীন্দ্র জন্মবার্ষিকী উদযাপন করা হচ্ছে। কলকাতার জোড়া সাঁকোর বিখ্যাত ঠাকুর পরিবারের সঙ্গে দক্ষিণ ডিহির সম্পর্ক নিবিড়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মা সারদা সুন্দরী দেবী জন্ম গ্রহণ করে ছিলেন এই দক্ষিণডিহি গ্রামে। রবীন্দ্রনাথের কাকি ত্রিপুরা সুন্দরী দেবী এই গ্রামের -ই মেয়ে। রবীন্দ্রনাথের স্ত্রী মৃণালিনী দেবী দক্ষিণ ডিহির -ই মেয়ে। তাঁর ভালো নাম ভবতারিণী, বিবাহের পর তাঁর নাম রাখা হয় মৃণালিনী দেবী। যৌবনে কবি কয়েক বার তাঁর মায়ের সঙ্গে দক্ষিণডিহি গ্রামের মামা বাড়িতে এসেছিলেন। এখানে কবিগুরু ও কবিপত্নীর আবক্ষ মূর্তি স্থাপন করা হয়েছে। ২৫শে বৈশাখ ও ২২শে শ্রাবণে এখানে নানা আয়োজনে রবীন্দ্রজয়ন্তী ও কবিপ্রয়াণ দিবস পালন করা হয়। বাংলা সাহিত্যের প্রবাদপুরুষ ঔপন্যাসিক বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় – এর স্মৃতিধণ্য খুলনার জেলা প্রশাসকের বাংলো। ১৮৬০-১৮৬৪ সাল খুলনার ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ও ডেপুটি কালেক্টর থাকাকালীন সময়ে এই বাংলোই ছিল তাঁর বাসস্থান। ভৈরব নদের তীরে অবস্থিত এই বাংলোর বকুলতলায় বসেই কবি রচনা করেছিলেন তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস এবং বাংলা সাহিত্যের প্রথম প্রেমের উপন্যাস ‘কপালকুন্ডলা’। বিশ্ববরেণ্য বিজ্ঞানী আচার্য্যপ্রফুল্লচন্দ্র রায়(পি,সি,রায়) – এর জন্মভূমি। ১৮৬১ সালের ২ আগস্ট খুলনার পাইকগাছা উপজেলার কপোতাক্ষ নদের তীরবর্তী রাড়ুলীতে স্যার পি.সি. রায় জন্ম গ্রহণ করেছিলেন।
খুলনার জনপ্রিয় খাবার নারকেল। এখাকার জলবায়ু নারকেল গাছ হওয়ার জন্য অনেক বড় ভূমিকা পালন করে। খুলনা গলদা চিংড়ির জন্য অনেক প্রসিদ্ধ। এছাড়া চুইঝালের মাংস, সন্দেশ, সরপুরিয়া অন্যতম উল্লেখযোগ খাবার।
3 Comments
#খুলনা❤️💛
# জয় ইস্টবেঙ্গল ❤️💛
#ভারত মাতা কি জয়❤️💛
❤️💛
Joy EB