জার্মানদের শরীরে নাকি আমৃত্যু লড়াইয়ের জন্য একটি অতিরিক্ত ফুসফুস থাকে! মরার আগে না মরার একটা শেষ প্রচেষ্টা থাকে! জার্মানি মানেই নাকি শিল্প থেকে শক্তি বেশী! ঠিক হয়তো সেই কারণেই একটা তেল খাওয়া মেশিনের মত জার্মান ফুটবলার রাও গোটা ৯০ মিনিট জুড়ে লড়ে চলে। আর মাথা ঠান্ডা রেখে চুপিসারে গোটা ম্যাচের নিয়ন্ত্রণ নিজেদের দখলে রাখে।
এরকম বহু খেলোয়াড় আমরা দেখেছি যারা কিনা নিজেদের শৈল্পিক ফুটবলের মাধ্যমে আমাদের মন জয় করে এসেছে। আর এমন কিছু খেলোয়াড় আছে যারা নিঃশব্দে গোটা ম্যাচটাকে পরিচালনা করে কিন্ত খ্যাতির ছটা থেকে একটু দূরেই থাকে। এসসি ইস্টবেঙ্গলের হয়ে সেই কাজটাই করে চলেছেন জার্মানি অনুর্ধ-২০ খেলা ভিলে ম্যাটি স্টেইনম্যান। সদ্য ২৬ এ পা রেখেছেন আর গোল করে ইস্টবেঙ্গলকে জিতিয়ে জন্মদিনের উদযাপনটা সেরেছেন।
বেঙ্গালুরুর সাথে শেষ ম্যাচে চোট পেয়ে উঠে যাওয়ার আগে অবধি আইএসএলের ১০টি ম্যাচের প্রতি ম্যাচেই প্রায় ৯০ মিনিট করে খেলে দলের মাঝমাঠের ইঞ্জিনটা ভালোভাবেই সচল রেখেছেন। ম্যাটির খেলার দর্শনটা অনেকটা আরেক বিখ্যাত জার্মানের সাথে বেশ মিল খায়। নাম টনি ক্রুস। ক্রুসের মতই বক্স টু বক্স উঠে নেমে খেলার ক্ষমতা, সাথে অনবদ্য দূরদর্শিতা এবং অসাধারন পাসিং দক্ষতার এক অসামান্য মেলবন্ধনের নাম হলো স্টেইনম্যান। ছোট্ট একটা টোকায় বলটা বিপক্ষের পাশ দিয়ে নিয়ে যাওয়ার ধরণ আর ক্রসফিল্ড ও ফরোয়ার্ড থ্রু গুলো কিন্তু রিয়ালে খেলা ওই জার্মান ইন্টারন্যাশনালের মতই লাগে কিছুটা হলেও।
এখনও ইস্টবেঙ্গলের খেলা মোট ৩৭৩৭ পাসের মধ্যে ৪৬৬টি প্রায় ১২.৫% পাস এসেছে স্টেইনম্যানের পা থেকে। যার প্রায় ৭৯% সঠিক। একই ভাবে ইস্টবেঙ্গল দলের খেলোয়াড়দের মধ্যে সবথেকে বেশি ৫৬২টি টাচও কিন্ত তারই। দলের হয়ে যুগ্ম সর্বাধিক ৩টি গোল (অপরজন মাঘমা) এবং সর্বোচ্চ ২টি এসিস্ট করে প্রথম ১০ রাউন্ডের শেষে ইস্টবেঙ্গলকে লড়াই এ রাখার পিছনে তার অবদান অনস্বীকার্য।
শুধু আক্রমণেই নয় ডিফেন্সের প্রয়োজনে বিপক্ষকে ট্যাকেল (৩৫টি) করার ক্ষেত্রেও ম্যাটি ইস্টবেঙ্গলের যোদ্ধাদের মধ্যে সবার উপরে। সর্বোপরি এমন কোনো ভুল এখনও অবধি করেননি যাতে বিপক্ষ গোল করেছে বা গোলে শট করতে পেরেছে।
ইস্টবেঙ্গল সমর্থকরা যখন আইএসএলের প্রথম গোলটা পাওয়ার জন্য অস্থির হয়ে পড়েছিল ঠিক ততটাই কিন্ত পুরো দলের সাথে চেষ্টা করে চলেছিলেন তিনি, নিজেকে উজাড় করে। বেশ কিছু অসামান্য বল তিনি রেখেছিলেন যেগুলো হয়তো এখনকার পুরো ফিটনেসের ইস্টবেঙ্গল খেলোয়াড়রা হলে ঠিকই এ জালে জড়াতো।
ইস্টবেঙ্গলের আইএসএলের প্রথম গোলের ক্ষেত্রে পিলকিনটন থেকে বলতে পাওয়ার পরে যে বলটা মাঘমার জন্য রেখেছিলেন তা থেকে গোল না করাটাই হয়তো মাঘমার ধৃষ্টতা হত। ওড়িশা এফসির বিপক্ষে মাঘমার বিস্ময়কর গোলটাও কিন্তু ছিল ভিলে ম্যাটি স্টেইনম্যানের ফার্স্ট টাইম থ্রু থেকেই। হায়দ্রাবাদ এফসির বিপক্ষে একটা হেডার ও একটা ঠান্ডা মাথার প্লেসমেন্ট হোক বা বেঙ্গালুরু এফসির বিপক্ষে সেকেন্ড পোস্টে দুর্দান্ত ফ্লিক করে ফিনিশ; ম্যাটি কিন্তু নিজের মেজাজেই গোটা মাঠে বিরাজ করে। এফসি গোয়ার বিপক্ষে ২-৩ জনকে হেলায় কাটিয়ে অল্পের জন্য গোল থেকে লক্ষ্যভ্রষ্ট নাহলে সেইদিনই হয়তো ব্রাইটের মোহময়ী গোল ছাড়াও আরও একটা বিশ্বমানের গোল দেখতে পেত ইস্টবেঙ্গল সমর্থকরা এবং ম্যাচটা থেকে ওরকম জঘন্য রেফারিং এর পরেও ৩ পয়েন্ট ঘরে তুলতে পারতো ইস্টবেঙ্গল।
কখনও বল নিয়ে ‘জিদান টার্ন’ নিয়ে বিপক্ষকে বোকা বানানোই হোক, কখনও বল কেড়ে নিয়ে আক্রমণ তৈরি করা হোক বা প্রয়োজনে খেলার গতি বাড়িয়ে কমিয়ে খেলার ছন্দ নিজেদের দিকে নেওয়াই হোক; ম্যাটিই কিন্তু এসসি ইস্টবেঙ্গল মাঝমাঠের ‘আসল শক্তি’।
গোয়া ম্যাচের শেষ দিকে শারীরিক সমস্যার জন্য তাকে তুলে নিতে বাধ্য হয় টিম ম্যানেজমেন্ট। পরের ম্যাচেই হয়তো মাঠে ফিরে আবার মাঝমাঠের ব্যাটনটা নিজের হাতে তুলে নেবেন স্টেইনম্যান। কারণ ময়দানে কথিত আছেই যে জার্মান রক্ত আর ইস্টবেঙ্গলের লড়াই অত তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যায়না। আর এই জার্মান মেশিন যত দৌড়াবে ইস্টবেঙ্গলের লীগ টেবিলে ওঠার গতিও ততই বাড়বে।