প্রবাসে থেকে ইস্ট বেঙ্গল কে যারা মনে প্রাণে ইস্ট বেঙ্গল নিয়েই থাকে তাদের জন্য খেলা দেখার সুযোগ খুব একটা আসেনা যদিনা ইস্ট বেঙ্গল ক্লাব সেখানে খেলতে যায়। আমার প্রবাসে থাকার শুরু সেই ১৯৭৬ সালে যখন আমার বাবা গুয়াহাটি তে ট্রান্সফার হয়ে গেলেন। আমার ইস্ট বেঙ্গল সমর্থন ও সেই বছর থেকেই। গুয়াহাটিতে আমাদের বাড়ির কাছেই গুয়াহাটি স্টেডিয়াম। স্টেডিয়ামের সামনেই হোটেল, তখন সেটা স্টেডিয়াম গেস্ট হাউস বলে পরিচিত ছিলো। সেই বাড়িটা আমাদের বাড়ির থেকে দেখা যেতো আর কখনো যদি স্টেডিয়ামে কোনো অনুষ্ঠান হতো যেটা সন্ধ্যেবেলায় হতো তাহলে লাইট জ্বললে সেটাও বাড়ির থেকে দেখা যেতো, গোল হলে বা উল্লাস হলে চিৎকার ও শোনা যেতো বাড়ির থেকে। গুয়াহাটিতে তখন চলতো বরদলৈ ট্রফি। আমি তখন ওখানকার ডন বস্কো তে পড়ি। আসাম আন্দোলন শুরু হচ্ছে, চারিদিকে একটু একটু করে বাঙালি বিদ্বেষ ছড়াচ্ছে। গুয়াহাটি স্টেডিয়ামের লাগোয়া ইন্ডোর স্টেডিয়ামে আমি ব্যাডমিন্টন খেলতে যেতাম আর সুযোগ পেলেই ওখানকার ফার্স্ট ডিভিশন এর ফুটবল ম্যাচ গুলো দেখতাম কিন্তু বরদলৈ ট্রফি আলাদা ব্যাপার। ভেতরে ভেতরে ছটফট করলেও একা একা খেলা দেখতে যাওয়ার অনুমতি ছিলোনা।
১৯৭৮ এ ইস্ট বেঙ্গল গেলো বরদলৈ খেলতে। অসাধারণ দল সেবার। ভাস্কর, বিশ্বজিৎ দাস, তরুণ বসু, চিন্ময়, মনোরঞ্জন, শ্যামল ঘোষ, সত্যজিৎ মিত্র, সমরেশ চৌধুরী, প্রশান্ত ব্যানার্জী, সুবিমল ঘোষ, সুরজিৎ সেনগুপ্ত, উলগানাথান, রঞ্জিত মুখার্জী, মিহির বোস, সাব্বির আলি, অশোক চন্দ প্রমুখ খেলোয়াড় সমৃদ্ধ তারকাখচিত দল। আমি ছটফট করছি কিন্তু বাবা আমাকে একলা ছাড়বেনা। ইস্ট বেঙ্গলের খেলাগুলোও পড়েছে সপ্তাহের মাঝে। বাবার অফিস কাজেই খেলা আর দেখা হচ্ছেনা। সেই বছর ব্যাংককের পোর্ট অথরিটি দল দুর্দান্ত খেলছে। স্থানীয় একটি দলকে ১৭-০ হারিয়ে শুরু করেছে। স্থানীয় দল আসাম পুলিশের বিরুদ্ধে ১-০ এগিয়েও ১-১ ড্র করেছে। আসাম পুলিশ সেদিন প্রচন্ড মেরে খেলেছিলো। ইস্ট বেঙ্গল এদিকে আস্তে আস্তে গ্রূপের ম্যাচগুলো জিতে সেমিফাইনালে আসাম পুলিশের বিরুদ্ধে। দুই লীগের সেমিফাইনাল এ আমরা আসাম পুলিশকে হারিয়ে ফাইনালে যাই। প্রথম লেগেই মনে হয় মিহির বসু হ্যাটট্রিক করেন। উল্টোদিক থেকে পোর্ট অথিরিটি ফাইনালে ওঠে।
ফাইনালের দিন সকালে স্টেডিয়ামে গিয়ে দেখি বিশাল লম্বা লাইন। সকাল ৮টার থেকে টিকিট দেবে কিন্তু হঠাৎ প্রচন্ড গন্ডগোল শুরু। শোনা গেলো যে টিকিট নাকি সব শেষ, সব কালোবাজারে চলে গেছে। ৪ টাকার টিকিট ১০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। হঠাৎ মাউন্টেড পুলিশ চার্জ করতেই আমাকে নিয়ে আমার সঙ্গে যিনি ছিলেন তিনি বাড়ির দিকে দৌড় দিলেন। বুঝলাম খেলা দেখা আর হবেনা।
সেদিন কিরকম যেন একটা মেঘলা দিন, চারিদিকে কেমন যেন থমথমে। স্থানীয় লোকেরা খেপে আছে কারণ ইস্ট বেঙ্গল সেমিফাইনালে আসাম পুলিশ কে হারিয়েছে। বাড়িতে বসে রেডিও তে ধারাভাষ্য শুনছি। পোর্ট আক্রমণ করলেই সারা গ্যালারিতে গর্জন। বাড়ির থেকে দেখা যাচ্ছে গান্ধী পাহাড়ের ওপর প্রচুর লোক যারা ওখান থেকে খেলা দেখছে এমনকি ওই গেস্ট হাউসের সব থেকে উঁচু তলাতেও মাথার সারি। তীব্র উত্তেজনার খেলায় সেদিন ইস্ট বেঙ্গল ৪-২ তে জিতেছিল সুরজিৎ -২ আর মিহির -২ এর গোলে। মাঠের ধারে চেয়ার পেতে বসা লোকেরাও সেদিন গ্যালারির লোকেদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ইস্ট বেঙ্গল খেলোয়াড়দের ওপর ধারাবাহিক ভাবে চাপ সৃষ্টি করেছিলো এমনকি আমাদের খেলোয়াড় রা থ্রো করতে গেলেও নানান ভাবে হেনস্থা করা হচ্ছিলো। খেলার পরে প্রায় ঘুটঘুটে অন্ধকারে প্রায় ৪৫ মিনিট ইস্ট বেঙ্গল খেলোয়াড়রা মাঠের মধ্যেই বসে ছিলো। সেদিনকার সেই হেনস্থার জন্য ইস্ট বেঙ্গল পরবর্তী অনেক বছর বরদলৈ খেলতে যায়নি প্রতিবাদ স্বরূপ। পরের দিন স্কুলে গিয়েও হেনস্থা হতে হয়েছিলো স্থানীয়দের কাছে প্রিয় দল জিতেছে বলে।
পরে চাকরি সূত্রে দিল্লিতে এবং এখন বেঙ্গালুরু তে থাকার দরুন দিল্লির আম্বেদকর স্টেডিয়ামে ডিসিএম বা ডুরান্ড বা বেঙ্গালুরুর ফুটবল স্টেডিয়াম ও কান্তিরাভা তে আই লীগের খেলা দেখতে গেছি কিন্তু ১৯৭৮ এর সেই দিনটার কথা আজও ভুলিনি। খেলা নিজের চোখে না দেখলেও সেদিনকার ইস্ট বেঙ্গল দলটাকে কুর্নিশ জানাই কারণ তাদের মাঠ এবং মাঠের বাইরের বড়ো কঠিন লড়াই জিততে হয়েছিল।