সিলেট একটি প্রাচীন জনপদ। সিলেটের ভূমির গঠন, তাম্রশাসন, শিলালিপি, চীনা পরিব্রাজক হিউয়েন-সাঙ, ইবনে বতুতার ভ্রমন বৃত্তান্ত ইত্যাদি থেকে এর নিদর্শন পাওয়া যায়। কিন্তু এর প্রচীনত্ব কতটুকু তা আজো নিশ্চিতভাবে নির্ণয় করা যায়নি। প্রাচীনকালে সিলেট অঞ্চল ছিলো কামরূপ রাজ্যের অন্তর্ভূক্ত। কামরূপের রাজা ছিলেন ভগদত্ত, সিলেটের লাউড় পাহাড়ে ভগদত্তের একটি উপরাজধানী ছিলো। ঐ পাহাড়ের একটি স্থানকে এখনো ভগদত্ত রাজার বাড়ি বলা হয়। ‘যোগিনীতন্ত্রে’ কামরূপের সীমানা বর্ণিত আছে সেই সাথে সিলেটের সীমা সম্পর্কেও রয়েছে একটি শ্লোক। এতে শ্রীহট্ট শব্দের উল্লেখ ছিলো। বিভিন্ন তন্ত্রেমন্ত্রেও সিলেটের উল্লেখ আছে। তন্ত্রগুলোতে সিলেটকে শ্রীহট্ট, শিরিহট্ট, শিলহট্ট, বা শিলহট বলা হয়েছে। একসময় সিলেট জেলায় একজন ধনী ব্যক্তির এক কন্যা ছিল। তার নাম ছিল শিলা। ওই ব্যক্তি তার কন্যার স্মৃতি রক্ষার্থে একটি হাট অর্থাৎ বাজার গড়ে তোলেন। তিনি এর নাম রাখেন ‘শিলার হাট’। এই বাজারের নাম বিভিন্নভাবে পরিবর্তিত হয়ে ‘সিলেট’ নামের উৎপত্তি হয়। আরেকটি জনশ্রুতি হলো, পাথরকে বলা হয় শীলা। পাথরের প্রাচুর্যের সুবাদে এই এলাকাকে সিলেট বলা হয়। সিলেট শব্দের অনুসর্গ ‘সিল’ মানে ‘শীল’ আর উপসর্গ ‘হেট’ মানে হাট অর্থাৎ বাজার। প্রাচীনকাল থেকে এই জেলায় পাথর (শীল) ও হাটের (ব্যবসা ও বাণিজ্যের) প্রাধান্য ছিল বলে ‘শীল’ ও ‘হাট’ শব্দদ্বয় মিলে ‘সিলেট’ শব্দের উৎপত্তি হয়েছে বলে অনেকে মনে করেন। ১৯১৯ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সিলেট ভ্রমণকালে এই অঞ্চলকে শ্রীভূমি আখ্যা দিয়েছেন।
প্রাচীনকালে প্রখ্যাত চীনা বৌদ্ধ ধর্মীয় পন্ডিত এবং বিশ্ববিখ্যাত পরিব্রাজক হিউয়েন সাঙ ৬৪১ খ্রীষ্টিয় সালে জলপথে এই অঞ্চলে এসেছিলেন। তখন তিনি আমাদের এই অঞ্চলকে ‘শিলা চটলো’ নামে আখ্যা দিয়েছিলেন। প্রাচীন গৌড় রাজ্যই বর্তমান (বিভাগীয় শহর) সিলেট অঞ্চল বলে ঐতিহাসিকভাবে স্বীকৃত। দশম শতাব্দিতে এ অঞ্চলের কিছু অংশ বিক্রমপুরের চন্দ্রবংশীয় রাজাদের দ্বারা শাসিত হয় বলে জানা যায়। ১২০৪ খ্রিস্টাব্দে বখতিয়ার খিলজির বঙ্গবিজয়ের মধ্য দিয়ে এই অঞ্চল মুসলমানদের দ্বারা অধিকৃত হয় এবং ১৩০৩ খ্রিস্টাব্দে আউলিয়া শাহ জালাল দ্বারা গৌড় রাজ্য বিজিত হলে, দিল্লীর সুলতানদের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয়ভাবে মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। তখন আউলিয়া শাহ জালালের নামের সাথে মিল রেখে গৌড় নামের পরিবর্তে এই শহরের নামকরণ করা হয় জালালাবাদ। বিশ্ব বিখ্যাত আরেক পর্যটক ইবন বতুতা সিলেট এসেছিলেন মরক্কো থেকে ১৩৪৬ সালে এবং এ অঞ্চলের নাম ‘কামরূপের বনভূমি’ বলেছেন। ১৫৭৫ খ্রিস্টাব্দে শক্তিশালী মোগল সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হলে এ অঞ্চলের ভৌগোলিক সীমানার অনেক পরিবর্তন ঘটে। এছাড়াও এ অঞ্চল যখন বিট্রিশ শাসনাধীন তখন ব্রিটিশরা একে সিলহেট নামকরণ করেছিলো। এভাবে কালক্রমে এ অঞ্চল ‘সিলেট’ নামে পরিচিত ও প্রতিষ্ঠিত হয়ে ওঠে। ১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দে সিলেট বিভাগ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর অধিক্ষেভুক্ত হয়। ১৭৭২ খ্রিস্টাব্দে গঠিত হয় (সাবেক) সিলেট জেলা যার সাড়ে তিন থানা ১৯৪৭ থেকে ভারতের অন্তর্ভুক্ত।
সিলেট অঞ্চলের স্বতন্ত্র্য ভাষা, বর্ণমালা, সংস্কৃতি ও রীতিনীতির কারণেই বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চল থেকে সহজেই সিলেটকে আলাদা করা যায়। সাহিত্য চর্চা ক্ষেত্রেও সিলেটের রয়েছে গৌরবময় ঐতিহ্য। বাংলাদেশের একমাত্র সিলেটিদের আছে নিজস্ব বর্ণমালা যা সিলেটি নাগরী লিপি নামে পরিচিত। নাগরীর অক্ষর মাত্র ৩২টি। যুক্ত বর্ণ সাধারণত ব্যবহৃত হয় না। এ পর্যন্ত ৮৮টি মুদ্রিত গ্রন্থসহ(নাগরী হরফে) ১৪০টি গ্রন্থের সন্ধান পাওয়া গেছে। ১৯৪৭ পূর্ববর্তীকালে কলকাতার শিয়ালদহেও নাগরী লিপির প্রেস ছিল। চর্যাপদই হচ্ছে বাংলা সাহিত্যের আদি নিদর্শন। চর্যার শব্দাবলীর সাথে সিলেট ও আসাম বেল্টের কথ্য ভাষার বা আঞ্চলিক শব্দের যথেষ্ট মিল রয়েছে। সিলেটের আঞ্চলিক ভাষার বেশ কিছু শব্দ চর্যাপদ রচনায় হুবহু ব্যবহার করা হয়েছে। বৈষ্ণব ধর্মের প্রবর্তক শ্রীচৈতন্যকে কেন্দ্র করে যে পদাবলী সাহিত্যের সূচনা হয় বাংলা সাহিত্যে তাঁর গুরুত্ব অপরিসীম। এই পদাবলী সাহিত্যে এককভাবে সিলেটের অবদান সর্বাধিক। শ্রীচৈতন্যের প্রধান প্রধান পার্ষদ ছিলেন সিলেটী। সিলেটের গোলাপগঞ্জ থানার ঢাকাদক্ষিণের যদুনাথ কবিচন্দ্র গৌরাঙ্গ বিষয়ক পদাবলীর জন্য বিখ্যাত। অদ্বৈত জীবন কাব্যের রচয়িতা হরিচরণও ছিলেন সিলেটের সন্তান। ভবানন্দের হরিবংশের সব পুঁথি পাওয়া গেছে সিলেটে। সিলেটকে লোক সাহিত্যের খনি বলা হয়ে থাকে, লোক সাহিত্যের এই খনি থেকে এখনো মূল্যবান সম্পদ সংগ্রহের কাজ চলছে। গুরু সদয় দত্ত সংগৃহীত ১৯৬৬ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত “শ্রীহট্টের লোক সংগীত”, শশীমোহন চক্রবর্তী সংগৃহীত “শ্রীহট্টীয় প্রবাদ প্রবচন”, অধ্যাপক পদ্মনাথ ভট্টাচার্যের “শ্রীহট্ট ভট্টসঙ্গীত”, চৌধুরী গোলাম আকবর সংগৃহীত ১৯৬৮ সালে বাংলা একাডেমী থেকে প্রকাশিত “সিলেট গীতিকা” প্রভৃতি গ্রন্থ এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য। বৃহত্তর সিলেটের সর্বত্র ছড়িয়ে আছেন মরমি কবি এবং বিশিষ্ট রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। কারুশিল্পী শ্রী জনার্দন ১৬৩৭ সালে মুর্শিদাবাদের নবাবের জন্য জাহান কোষ নামে একটি তোপ তৈরি করেন। সপ্তদশ শতকে বিবি মরিয়ম ও কালে জমজম নামে দুটি কামান ঢাকা গিয়ে তৈরি করেন৷ আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার, অনুবাদক, রম্যরচয়িতা ও বহুভাষাবিদ সৈয়দ মুজতবা আলী জন্মগ্রহণ করেন ১৯০৪ খ্রিষ্টাব্দের ১৩ সেপ্টেম্বর অবিভক্ত ব্রিটিশ ভারতে আসামের অন্তর্ভুক্ত সিলেটের করিমগঞ্জে। হাসন রাজা, রাধা রমন, শাহ আব্দুল করিমের গান বিদেশেও সমাদৃত। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক জেনারেল এমএজি ওসমানী সিলেটের সন্তান এবং বাংলাদেশের গৌরবের বিজয়ের এক উজ্জ্বল অংশ।
মহাপ্রভু শ্রী চৈতন্য দেবের মন্দির বাংলাদেশের সিলেট জেলার গোলাপগঞ্জ উপজেলার একটি দর্শনীয় স্থান। শ্রী চৈতন্য দেবের পূর্ব পুরুষরা ছিলেন পূর্ববাংলার শ্রীহট্টের ঢাকা দক্ষিন শহরের আদিবাসিন্দা (অধুনা সিলেট, বাংলাদেশ)। শ্রীউপেন্দ্র মিশ্র তার পুত্র জগন্নাথ মিশ্রের প্রতিভা দেখে শাস্ত্রাদি অধ্যায়নের জন্য তৎকালীন বিদ্যাচর্চার পীঠস্থান নবদ্বীপে পাঠিয়েছিলেন। তখন থেকেই জগন্নাথ মিশ্রের নবদ্বীপে বসবাস শুরু হয়। প্রকৃতি কন্যা হিসাবে সারাদেশে এক নামে পরিচিত সিলেটের জাফলং। খাসিয়া জৈন্তা পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত জাফলং প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপরুপ লীলাভূমি। পিয়াইন নদীর তীরে স্তরে স্তরে বিছানো পাথরের স্তূপ জাফলংকে করেছে আকর্ষণীয়। স্বচ্ছ নীল জলরাশি আর দুধারের অপরুপ সোন্দর্য, দীর্ঘ নৌ পথ ভ্রমনের সাধ যেকোন পর্যটকের কাছে এক দূর্লভ আর্কষণ। তেমনি এক নির্জন মনকাড়া স্থান লালাখাল। বাংলাদেশের সবোর্চ্চ বৃষ্ঠিপাতের স্থান এবং রাতের সৌন্দর্যে ভরপুর এই লালাখাল সিলেট জেলার জৈন্তাপুর উপজেলার সন্নিকটে অবস্থিত। সারি নদীর স্বচ্ছ জলরাশির উপর দিয়ে নৌকা অথবা স্পীডবোটে করে আপনি যেতে পারেন লালা খালে। ভারতের চেরাপুঞ্জির ঠিক নিচেই লালাখালের অবস্থান। বাংলাদেশের যে কয়টি অঞ্চলে চা বাগান পরিলক্ষিত হয় তার মধ্যে সিলেট অন্যতম। সিলেটের চায়ের রঙ, স্বাদ এবং সুবাস অতুলনীয়। সিলেট বিভাগের বিস্তীর্ণ এলাকা হাওর সমৃদ্ধ। বর্ষায় এর অপরূপ সৌন্দর্য দেখতে সারাদেশ থেকে ছুটে আসেন ভ্রমণ পিপাসী মানুষ। হাকালুকি, টাঙ্গুয়ার হাওর, শনির হাওর – এগুলো হচ্ছে হাজার প্রজাতির মাছের আবাস। সিলেটে রয়েছে ছোট বড় অনেক নদী। এর মধ্যে সুরমা ও কুশিয়ারা অন্যতম। মনিপুরী সিলেট তথা বাংলাদেশের আদি সম্প্রদায়ের অন্যতম জনগোষ্ঠি। নগর সিলেটের মির্জাজাঙ্গালে অবস্থিত মনিপুরী রাজবাড়ী প্রাচীন স্থাপত্য কীর্তির অন্যতম নির্দশন। এ ভবনের নির্মাণ শৈলী সিলেট অঞ্চলের কৃষ্টি-সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। ঊনবিংশ শতাব্দীতে সিলেট নগরীর মির্জাজাঙ্গালে রাজবাড়ীটি স্থাপিত হয়। প্রভাবশালী রাজা গম্ভীর সিং এর স্মৃতিধন্য এ বাড়িটি আজ অবহেলিত ও বিলীন প্রায়। সিলেটে দীর্ঘদিন অবস্থানের সুবাদে মনিপুরিদের সাংস্কৃতিক সম্ভারের নানা দিক এ অঞ্চলে ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। যা এখনো প্রতীয়মান হয় মনিপুরী নৃত্য, গান ও পোষাক ছাড়াও সিলেটের কৃষ্টি সংস্কৃতিতে। ইতিহাস-ঐতিহ্যের নানা উপকরণে সমৃদ্ধ সিলেট সুবিদবাজারে মণিপুরি মিউজিয়াম। এতে রয়েছে কয়েকশো বছরের পুরনো ঘন্টা, যুদ্ধে ব্যবহৃত সরঞ্জামাদি, ধর্মীয় অনুষ্ঠানের জিনিসপত্র এবং মণিপুরীদের তৈরী হ্যান্ডলুম। মণিপুরিদের কৃষ্টি-কালচারকে তুলে ধরাই মিউজিয়াম প্রতিষ্ঠার মূল লক্ষ্য। মরমী কবি হাসন রাজা ও পরিবারের অন্য সদস্যদেও স্মৃতি সংরক্ষণের উদ্যোগ সিলেট নগরীর প্রানকেন্দ্র জিন্দাবাজারে গড়ে তোলা হয়েছে মিউজিয়াম অব রাজাস। মিউজিয়ামে হাসন রাজা ও একলিমুর রাজা চৌধুরীর মূল্যবান ব্যবহার্য জিনিসপত্র ও গানের পান্ডুলিপি শোভা পাচ্ছে।
সিলেট বা শ্রীহট্টের ইতিহাস গতানুগতিক প্রাচীন বঙ্গদেশ বা বাংলাদেশ হতে ভিন্ন। কারণ বঙ্গীয় ব-দ্বীপের ভৌগোলিক ভিন্নতার কারণে। পাহাড়/টিলা, বিশাল হাওর ও অসংখ্য নদ-নদী এই ভূ–ভাগকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে। সিলেট অঞ্চল প্রাকৃতিক ও খনিজ সম্পদের ভরপুর। এছাড়া প্রবাসী অধ্যুষিত হওয়ার কারণে সিলেট অঞ্চল বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চল থেকে অর্থনৈতিকভাবেও বেশ সমৃদ্ধশালী। প্রাকৃতিক, খনিজ ও অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতার মতোই সিলেটের সুপ্রাচীন ইতিহাসও রয়েছে। মুর্তা বেতের তৈরি সিলেটের শিতল পাটি আজ বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃত। চা- এর জন্য বিখ্যাত সিলেট। কমলালেবু চাষের জন্য সিলেটকে ‘কমলার ঘর’ বলা হয়ে থাকে। আখনী পোলাও সিলেটের বিখ্যাত খাবার। সাতকরা জিনিসটা সিলেটে যতটা জনপ্রিয় তেমন আর কোথাও নয়। টক জাতীয় এই ফলটির স্বাদ অন্য সব ফল থেকে বেশ আলাদা। খাবারের আনুষঙ্গিক হিসেবে ব্যবহার হয়। আবার সাতকরার আচারও খুব ভালো।এই সাতকরা দিয়ে রান্না করা মাংসের খ্যাতি দেশজোড়া। সিলেটের প্রসিদ্ধ খাবারের মধ্যে হিদলের শিরা ও ভর্তা- হিদল বা সিদল এক জাতের মাছের শুটকি, মশলাদার মুরগির টিক্কা মশলা, নুনর বড়া থেকে শুরু মিষ্টান্ন জাতীয় তুশা শিন্নি প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।