দশক শেষে ইস্টবেঙ্গল: ফিরে দেখা

Share

Facebook
Twitter
WhatsApp

[fblike]

দেখতে দেখতে একবিংশ শতকের দ্বিতীয় দশকও শেষ হয়ে গেল। সেদিনের ছটফটে কিশোরটা আজ ধোপদূরস্ত চাকুরীজীবি, সেদিনের রগচটা তরুণরা আজ ঠান্ডা মাথায় জমিয়ে সংসার করছে। চুলে কয়েকটা রুপোলী রেখাও কি দেখা যাচ্ছে?

এই এক দশকে কতকিছুই পাল্টেছে – প্রিন্ট মিডিয়া, ভিজ্যুয়াল মিডিয়াকে ছাপিয়ে মানুষের জীবনের অবিচ্ছেদ্দ্য অঙ্গ হিসেবে উঠে এসেছে সোশ্যাল মিডিয়া। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স, বিগ ডেটার বদান্যতায় ক্যাশ লেনদেনের জায়গায় জনপ্রিয় হয়েছে অনলাইন পেমেন্ট। জীবনযাত্রায় এসেছে অনেক বেশী স্বাচ্ছন্দ্য।

তবে এত পরিবর্তনের ভীড়ে যেটা একবিন্দুও পাল্টায়নি, সেটা হলো লেসলি ক্লডিয়াস সরণীর ক্লাবটার প্রতি অপরিসীম ভালোবাসা, বুকের মশাল আর জার্সির লাল-হলুদ রংদুটোর প্রতি সীমাহীন আনুগত্য এবং কোটি কোটি সভ্য সমর্থকদের পাগলামো।

ইস্টবেঙ্গল – এই একটা নামের উপরেই তো বেঁচে আছে কয়েক কোটি মানুষ। যাদের শয়নে, স্বপনে ইস্টবেঙ্গল। যার টানে মৃত সন্তানের মুখাগ্নি করেও মানুষ ছুটে যায় ওই গ্যালারিতে, তার লাল হলুদ পরিবারের কাছে, ওই লাল হলুদ পতাকার নিচেই খুঁজে নেয় প্রিয়জন হারানোর বেদনা ভুলে নতুন করে জীবনযুদ্ধে ঘুরে দাঁড়ানোর লড়াইয়ের প্রেরণা। সেই জন্যই তো ইস্টবেঙ্গলকে নিয়ে সমর্থকেরা গান বাঁধেন –

তোর নামের সোয়াদ
যেন ভাটি গাং-এ জল
তুই জিতলে আমার মাটি জেতে
আমার ইস্টবেঙ্গল !!

কেমন গেল এই দশক ইস্টবেঙ্গলের জন্য? অধরা মাধুরী আইলিগ যেমন আসেনি গোটা দশক জুড়ে, তেমনই আবার এই দশকেই এসেছে এএফসি সেমিফাইনাল খেলার মতো এক অনন্য ঐতিহাসিক সম্মান।

আজ, এই দশক শেষে দাঁড়িয়ে চলুন দেখে নেওয়া যাক চাওয়া-পাওয়ার সেই হিসাবগুলো।

ট্রফি ও রেকর্ড:

  • কলকাতা লিগ – ৮টি, সাথে ২০১০-২০১৭ টানা ৮ বার কলকাতা লীগ জেতার এক অবিস্মরণীয় রেকর্ড।
  • আইএফএ শিল্ড – ২টি। ২০১২ সালে প্রয়াগ ইউনাইটেডকে টাইব্রেকারে ৪-২ গোলে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয় ইস্টবেঙ্গল। এছাড়াও ২০১৮ সালে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী মোহনবাগানের অনূর্ধ্ব-১৯ দলকে একই ব্যবধানে হারিয়ে শিল্ড ঘরে তোলে ইস্টবেঙ্গলের অনূর্ধ্ব-১৯ দল।
  • ফেড কাপ – ২টি। ২০১০-১১ মরশুমে ভাসুমের করা গোলে মোহনবাগানকে ১-০ ব্যবধানে হারিয়ে মর্গ্যানের কোচিংয়ে খেলা ইস্টবেঙ্গল। এরপর ২০১২ সালের ৩০শে সেপ্টেম্বর অতিরিক্ত সময়ে মননদীপ সিং এবং এডে চিডির করা গোলে ডেম্পোকে ৩-২ গোলে পরাস্ত করে শেষবারের মতো জাতীয় স্তরে কোনও ট্রফি জেতে ইস্টবেঙ্গল।
  • সুপার কাপ – ১টি। তখন সুপার কাপ হতো এক ম্যাচের, গত মরসুমের আইলীগ চ্যাম্পিয়ন বনাম গত মরসুমের ফেডকাপ জয়ী টিমের। ১৮ই অক্টোবর, ২০১১-তে দিল্লীর আম্বেদকর স্টেডিয়ামে এই ম্যাচে সালগাঁওকরকে সাডেন ডেথে ৯-৮ গোলে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয় ইস্টবেঙ্গল।
  • এএফসি কাপ – ২০১৩ সালের এই টুর্নামেন্টে বরাবরের মতো বিদেশী টিমগুলোর বিপক্ষে ঝলসে ওঠে ইস্টবেঙ্গল। কোয়ার্টার ফাইনালে ইন্দোনেশিয়ার সেমাং পাডাংকে হারানোর পর ফাইনালে ইস্টবেঙ্গল মুখোমুখি হয় প্রবল পরাক্রমশালী কুয়েত এফসির বিরুদ্ধে। ডেভিড বনাম গোলিয়াথের এই অসম লড়াইয়ে জিততে না পারলেও এএফসি কাপের সেমিফাইনালে উঠে এক অনন্য নজির গড়ে ইস্টবেঙ্গল।
  • মহামেডান প্ল্যাটিনাম জুবিলি কাপ – ২০১০ সালের ১৪ই নভেম্বর মোহনবাগানকে টাইব্রেকারে ৬-৫ গোলে হারিয়ে প্ল্যাটিনাম জুবিলি কাপ জেতে ইস্টবেঙ্গল।

এ তো গেল ট্রফি জয় এবং রেকর্ডের কচকচানি। ইস্টবেঙ্গল নিয়ে যখন আলোচনা হচ্ছে, তখন সেখানে চিরশত্রু মোহনবাগানের প্রসঙ্গ আসবে না, তা কি হয়? তাহলে চলুন দেখে নেওয়া যাক, এই দশকে ডার্বিতে ইস্টবেঙ্গলের পারফরম্যান্স কেমন ছিলো?

কলকাতা ডার্বি:

২০১০-১১ মরসুম থেকে ২০১৯-২০ মরসুমে এখনো পর্যন্ত মোট ৩৩ বার মুখোমুখি হয়েছে দুই দল।

মোট ম্যাচ – ৩৩
ইস্টবেঙ্গলের জয় – ১৪
মোহনবাগানের জয় – ৯
ড্র ১০

এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনা:

  • ৯ই ডিসেম্বর, ২০১২ – আইলিগের ফার্স্ট লেগের ম্যাচে বিরতির ঠিক আগে হরমনজিৎ খাবরার হেডারে ০-১ গোলে পিছিয়ে পড়ে মোহনবাগান। গোদের উপর বিষফোঁড়ার মতো বাগান অধিনায়ক ওডাফা ওকোলি লালকার্ড দেখেন। গ্যালারিতে ঝামেলা শুরু করে একশ্রেণীর মোহনবাগান সমর্থক। মাঠের ভিতর আধলা ইঁট ছুঁড়ে মোহনবাগানের খেলোয়াড় রহিম নবীর মাথা ফাটিয়ে দেওয়া হয়। পরে পাঁচ গোল খাওয়ার ভয়ে আর খেলতে নামেনি মোহনবাগান। পালিয়ে গিয়ে ইস্টবেঙ্গলকে ওয়াকওভার দিয়ে দেয় তারা। ইস্টবেঙ্গল সমর্থকরা এইদিনটিকে “পলায়ন দিবস” হিসাবেই চেনেন।
    ফলস্বরূপ, ইস্টবেঙ্গলকে ৩-০ গোলে জয়ী ঘোষণা করা হয়। আইলীগ থেকে দুবছরের জন্য সাসপেন্ড হয় মোহনবাগান। নামিয়ে দেওয়া হয় দ্বিতীয় ডিভিশনে। যদিও পরে তৎকালীন মোহনবাগান সভাপতি টুটু বসুর উদ্যোগে এবং এআইএফএফ প্রেসিডেন্ট প্রফুল্ল প্যাটেলের সঙ্গে সখ্যতার জেরে ২ কোটি টাকা জরিমানা দিয়েই এযাত্রা বেঁচে যায় তারা।
  • ৬ই সেপ্টেম্বর, ২০১৫ – কলকাতা লীগের এই ম্যাচে ৪-০ ব্যবধানে মোহনবাগানকে হারায় ইস্টবেঙ্গল। ফ্রিকিক থেকে জোড়া গোল করে ম্যাচের নায়ক ডু ডং হিউন। এই দশকের সমস্ত ডার্বি মিলিয়ে এটিই সবচেয়ে বড় ব্যবধান।
  • ৭ই সেপ্টেম্বর, ২০১৬ – কল্যাণী স্টেডিয়ামে আয়োজিত কলকাতা লিগের এই ম্যাচে পুনরায় ওয়াকওভার দেয় মোহনবাগান। মাঠেই আসেনি তারা। নিয়ম মেনে ইস্টবেঙ্গলকে ৩-০ গোলে জয়ী ঘোষণা করা হয়।

কোচ:

গত দশ বছরে ইস্টবেঙ্গল কোচের হটসিটে বসেছেন মোট ১৩ জন কোচ। এঁদের মধ্যে ট্রেভর জেমস মর্গ্যান প্রথম দফায় ২০১০-১১ থেকে টানা তিন মরসুম কোচ ছিলেন। সেই সময় তাঁর কোচিংয়ে ৭টি ট্রফি জেতে ইস্টবেঙ্গল। মর্গ্যানের দ্বিতীয় দফায় অবশ্য একবার কলকাতা লীগ জেতা ছাড়া আর কোনও সাফল্য আসেনি। এছাড়া ২০১৩-১৪ মরসুমে মার্কোস ফালোপা এবং তারপর ২০১৮-১৯ মরসুম থেকে প্রায় দুবছর টানা ইস্টবেঙ্গলের কোচ ছিলেন আলেহান্দ্রো মেনেন্দেজ। তাঁদের কোচিংয়ে ইস্টবেঙ্গল টিমের পারফরম্যান্স ফুটবল অনুরাগীদের বাহবা পেলেও ট্রফি অধরাই থেকে গিয়েছে।

সব মিলিয়ে মর্গান এবং কিছুটা আলেহান্দ্রো বাদে বাকিরা কেউই বিভিন্ন কারণে সেভাবে থিতু হতে পারেননি।

বিদেশী ফুটবলার:

গত দশ বছরে সর্বমোট ৪২ জন বিদেশী ফুটবলার লাল হলুদ জার্সিতে খেলে গিয়েছেন। বলাই বাহুল্য, এঁদের মধ্যে বেশিরভাগই প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ, যে কারণে সেই অর্থে খুব বেশী সর্বভারতীয় ট্রফি জিততে পারেনি ইস্টবেঙ্গল।

বিদেশীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশী নাইজেরিয়া থেকে আসেন ৮ জন, এর পরেই আলেহান্দ্রো জমানায় স্পেন থেকে আসেন ৭ জন।

বিদেশীদের মধ্যে আলাদা করে নাম উল্লেখ করতেই হবে পেন ওরজি, টোলগে ওজবে, চিডি, সুয়েকা, ওয়েডসন, প্লাজা, কাৎসুমি, খালিদ আউচো, এনরিকে, কোলাডো, জুয়ান মেরাদের।

তবে এই দশ বছরে খেলে যাওয়া বিদেশী খেলোয়াড়দের মধ্যে যাঁরা পাকাপাকিভাবে ইস্টবেঙ্গল জনতার মন জয় করে নিয়েছেন, তাঁরা হলেন উগা ওপারা, রন্টি মার্টিন্স, আল আমনা, জনি একোস্টা, ডু ডং।

আসুন এবারে দেখে নেওয়া যাক প্রতিটি মরশুম কেমন কেটেছে ইস্টবেঙ্গলের।

২০১০-১১:

মরশুমের শুরুতে ফিলিপ ডি রাইডারকে সরিয়ে কোচ হয়ে আসেন মর্গ্যান। কলকাতা লীগ জয় দিয়ে শুরু, তারপর আইলিগে রানার্স হলেও ফেড কাপে চ্যাম্পিয়ন হয় ইস্টবেঙ্গল।

২০১১-১২:

যথারীতি আবার কলকাতা লিগে চ্যাম্পিয়ন, আইলিগে রানার্স। তবে সুপার কাপে কিন্তু চ্যাম্পিয়ন হয় মর্গ্যানের টিম। ফেডকাপেও রানার্স হয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয় মর্গ্যান বাহিনীকে। এই বছরই আইলিগে হ্যালকে ৮-১ গোলে হারায় ইস্টবেঙ্গল। এটাই এখনও অব্দি আইলিগে ইস্টবেঙ্গলের সর্বাধিক ব্যবধানে জয়।

২০১২-১৩:

বলা যেতে পারে, এই দশকের সবচেয়ে সফল সিজন বোধহয় এটাই। কলকাতা লীগ ও ফেডকাপে চ্যাম্পিয়ন, আইলিগে তৃতীয়। তবে সবকিছু ছাপিয়ে উঠে আসে এএফসি কাপের ফলাফল। গ্রুপ স্টেজে একে একে মালয়েশিয়ার সেলাঙ্গর, সিঙ্গাপুরের ট্যাম্পাইন রোভার্সের মতো টিমদের হারিয়ে নকআউট স্টেজে পৌঁছায় ইস্টবেঙ্গল। প্রি-কোয়ার্টার ফাইনালে মায়ানমারের ইয়াঙ্গন ইউনাইটেডকেও ৫-১ গোলে উড়িয়ে দেয় লাল হলুদ ব্রিগেড। তবে এইসবের মধ্যেও কোচের আসন থেকে অব্যাহতি পান ট্রেভর জেমস মর্গ্যান।

ফেড কাপ হাতে ইস্টবেঙ্গল ব্রিগেড

২০১৩-১৪:

গত মরশুমে যেখানে শেষ করেছিল, ঠিক সেখান থেকেই শুরু করে ইস্টবেঙ্গল। কোচ হয়ে আসেন ব্রাজিলিয়ান মার্কোস ফালোপা। কলকাতা লীগে ফের চ্যাম্পিয়ন হলেও ফেডকাপে গ্ৰুপ স্টেজের বাধা টপকাতে ব্যর্থ হয় লাল হলুদ বাহিনী। কিন্তু এএফসি কাপে স্বপ্নের দৌড় তখনও শেষ হয়নি। কোয়ার্টার ফাইনালে ইন্দোনেশিয়ার সেমান পাডাংকে দুই লেগ মিলিয়ে ২-১ গোলে হারিয়ে এএফসি কাপের সেমিফাইনালে পৌঁছে যায় ইস্টবেঙ্গল; ভারতীয় ক্লাব ফুটবলের ইতিহাসে প্রথম দল হিসেবে।

তবে সেমিফাইনালে স্বপ্নভঙ্গ। অসম লড়াইয়ে সেই সময়ে এশিয়ার অন্যতম সেরা দল কুয়েত এফসির কাছে হেরে ক্লাবের ইতিহাসে সবচেয়ে সফল এএফসি অভিযান শেষ করে ইস্টবেঙ্গল।

এর পরেই বিদায়ঘণ্টা বেজে যায় মার্কোস ফালোপার। মরশুমের মাঝপথে নতুন কোচের দায়িত্ব নেন আর্মান্দো কোলাসো।

আইলিগে অল্পের জন্য রানার্স আপ হয় ইস্টবেঙ্গল।

২০১৪-১৫:

এই মরসুম থেকেই ইস্টবেঙ্গলের পারফরম্যান্স গ্রাফ পড়তে থাকে। কলকাতা লীগ জিতলেও আইলিগে চতুর্থ স্থানে শেষ করে ইস্টবেঙ্গল (পড়শী ক্লাব মোহনবাগান আইলীগ যেতে সেই বছর)। ফেডকাপেও গ্ৰুপ স্টেজ থেকেই বিদায় নেয় ইস্টবেঙ্গল।

২০১৫-১৬:

এই মরশুমে ২২ বছর বয়সী তরুণ ডু ডং হিউন আসেন ইস্টবেঙ্গলে। বছরটাকে ডু ডংয়ের বছর বললেও বোধহয় অত্যুক্তি হবে না। বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্যের কোচিংয়ে মোহনবাগানকে ৪-০ গোলে দুরমুশ করে ১৯৭৫-এর পাঁচ গোলের স্মৃতি ফিরিয়ে আনে দল; সৌজন্যে ডংয়ের বিশ্বমানের দুটো ফ্রিকিক।

ডু ডং-এর বিখ্যাত ফ্রি-কিক

এই বছর অপরাজেয় কলকাতা লীগ চ্যাম্পিয়ন হয় বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্যের ছেলেরা।

এরপর বাংলাদেশের শেখ কামাল আন্তর্জাতিক ক্লাব কাপে খেলতে গিয়েও সাফল্য পায় ইস্টবেঙ্গল। ভাঙা দল নিয়ে (প্রথম দলের বেশীরভাগ খেলোয়াড়ই তখন লোনে আইএসএল খেলছিলেন) অল্পের জন্য চ্যাম্পিয়নশিপ হাতছাড়া করলেও রানার্স ট্রফি নিয়ে ঘরে ফেরে তারা।

তবে আইলিগে আবার হতাশাই সঙ্গী হয় লাল হলুদের। এবার তৃতীয় হয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয় ইস্টবেঙ্গলকে।

২০১৬-১৭:

এই মরশুমে এএফসির ক্লাব তালিকায় ৭৪ নম্বরে উঠে আসে ইস্টবেঙ্গল, যা কিনা সমস্ত ভারতীয় ক্লাবদের মধ্যে সবার উপরে।

দ্বিতীয় দফায় ট্রেভর জেমস মর্গ্যান কোচ হয়ে আসলেও সেভাবে ফুল ফোটাতে পারেননি।

তবে এই মরশুমে এক অনন্য রেকর্ড করে ইস্টবেঙ্গল দল। পূর্বসূরিদের ১৯৭০-৭৫ এর টানা ছয়বারের কলকাতা লীগ চ্যাম্পিয়ন হওয়ার রেকর্ড ভেঙে টানা সাত বার চ্যাম্পিয়ন হয় তারা। তার চেয়েও বড় ঘটনা, লীগের প্রতিটা ম্যাচ জিতে, অলউইন রেকর্ড গড়ে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, এই বছরই ইস্টবেঙ্গলের মুখোমুখি হতে আবার অস্বীকার করে মোহনবাগান, এবং গত মরশুমে ৪-০ গোল হজম করার পর গত চার বছরে এই নিয়ে দ্বিতীয়বার ইস্টবেঙ্গলকে ওয়াকওভার দেয় গঙ্গাপাড়ের ক্লাবটি।

এই বছরই নতুন রূপে সেজে ওঠে ইস্টবেঙ্গল মাঠ। সদস্য গ্যালারীতে বসানো হয় লাল-হলুদ বাকেট সিট।

ইস্টবেঙ্গল মাঠের সদস্য গ্যালারীর বাকেট সিট

তবে কলকাতা লীগ জয়ের পর বরদলুই কাপে রানার্স হলেও আইলীগ ভাগ্যের হেরফের ঘটেনি। এবারেও একদম শেষ ল্যাপে গিয়েও শেষ পর্যন্ত তৃতীয় স্থানেই শেষ করে মর্গ্যানের দল।

২০১৭-১৮:

মর্গ্যান বিদায়ের পরে ইস্টবেঙ্গলের কোচ হয়ে আসেন গত মরশুমে আইজলকে আইলীগ চ্যাম্পিয়ন করা খালিদ জামিল। সিজনের শেষের দিকে তাঁর মাথার উপরে টিডি করে বসানো হয় আশিয়ানজয়ী সুভাষ ভৌমিককে।

মরশুমে পারফরম্যান্স খুব খারাপও ছিলো না। টানা আটবার কলকাতা লীগ জয় দিয়ে শুরু (এই দশকে সেটাই শেষবারের মতো লীগ জয়)। এরপর আইলিগে কাগজে কলমে চতুর্থ হলেও আসলে শেষদিন পর্যন্ত চ্যাম্পিয়ন হওয়ার সম্ভাবনা ছিল ইস্টবেঙ্গলের। কিন্তু শেষপর্যন্ত ঠোঁট আর কাপের মধ্যে দূরত্বটা রয়েই যায়।

এছাড়াও সুপার কাপে তৎকালীন আইএসএলের শক্তিশালী দুই ক্লাব মুম্বাই এফসি এবং এফসি গোয়াকে হারিয়ে ফাইনালে পৌঁছালেও শেষরক্ষা হয়নি। বেঙ্গালুরু এফসির কাছে ১-৪ গোলে হেরে রানার্স হয় ইস্টবেঙ্গল।

তবে খেলার মাঠে মরশুম যেমনই কাটুক, মাঠের বাইরে প্রকৃত অর্থেই অভিবাবকহীন হয়ে পড়ে ইস্টবেঙ্গল। দীর্ঘ রোগভোগের পর ২৮শে জুলাই, ২০১৭-য় চিরকালের জন্য ইস্টবেঙ্গলকে ছেড়ে চলে যান সবার প্রিয় স্বপন বল। এই ক্ষতি অপূরণীয়। ইস্টবেঙ্গল হারায় তার একনিষ্ঠ সৈনিককে।

প্রয়াত স্বপন বল মহাশয়

২০১৮-১৯:

এই মরশুম এক অন্যরকম মরশুম। শতবর্ষের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে থাকা ইস্টবেঙ্গলে শুরু হয় ১০০ বছর উদযাপনের প্রস্তুতি।

কিংফিশার চলে যাওয়ার পর ভারতীয় ফুটবলে প্রথমবার ইনভেস্টর মডেল আনে ইস্টবেঙ্গল। বেঙ্গালুরু স্থিত কোম্পানি কোয়েস কর্প ইনভেস্টর হিসেবে যোগ দেয় ইস্টবেঙ্গলে।এই বছরই ইস্টবেঙ্গলে আসেন সদ্য কোস্টারিকার হয়ে রাশিয়া বিশ্বকাপ খেলা ডিফেন্ডার জনি একোস্টা। এছাড়াও কোচ হয়ে আসেন রিয়েল মাদ্রিদের বি টিমের প্রাক্তন কোচ ও একদা জোসে মোরিনহোর সহকারী হিসেবে কাজ করা আলেহান্দ্রো মেনেন্দেজ গার্সিয়া।

আলেহান্দ্রো মেনেন্দেজ গার্সিয়া

প্রতিশ্রুতি জাগিয়ে আইলীগ অভিযান শুরু করলেও মাত্র এক পয়েন্টের জন্য আইলিগ হাতছাড়া হয় ইস্টবেঙ্গলের। আলেহান্দ্রো দায়িত্ব নেওয়ার আগে কলকাতা লিগে বাস্তব রায়ের কোচিংয়ে তৃতীয় স্থানে শেষ করে ইস্টবেঙ্গল।

তবে মোহনবাগানকে হারিয়ে এই বছর আইএফএ শিল্ড জেতে ইস্টবেঙ্গলের অনূর্ধ্ব-১৯ দল ।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, এই বছরই ইস্টবেঙ্গল মাঠে টালিগঞ্জ অগ্রগামীর বিরুদ্ধে কলকাতা লিগের ম্যাচে উদ্বোধন হয় ফ্লাডলাইটের, যা কিনা ময়দানের তিন প্রধানের মধ্যে সবচেয়ে বড়।

ইস্টবেঙ্গল মাঠের ফ্লাডলাইট

এছাড়াও ২৮শে অক্টোবর, ২০১৮-তে স্প্যানিশ লা-লিগার এল ক্লাসিকোর অফিশিয়াল স্ক্রিনিং হয় ইস্টবেঙ্গল মাঠে।

২০১৯-২০:

মরশুমটা সেই অর্থে আশানুরূপভাবে শেষ হয়নি। কোভিড পরিস্থিতিতে এমনিতেই সিজন বন্ধ হয়ে যায় মাঝপথে। তবে তার মধ্যেও কোচ আলেহান্দ্রো মেনেন্দেজের সঙ্গে আরো দুই মরশুম চুক্তি থাকলেও ক্লাবকর্তা এবং ইনভেস্টরদের মধ্যে সেই অর্থে বনিবনা না হওয়ায় সব কিছুই অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। একদিকে যখন কোয়েস বিদায় অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে, আরেকদিকে আইলিগে টিমের পারফর্মেন্সও আশাব্যঞ্জক হয়নি। তাই আইলিগের ডিসেম্বরের সেরা কোচ নির্বাচিত হলেও জানুয়ারিতেই বিদায় নেন আলেহান্দ্রো। করোনা পরবর্তী পরিস্থিতিতে মরশুম অসমাপ্তই থেকে যায়। কোয়েসের সঙ্গে বিচ্ছেদও হয় কিছুমাস পরেই।

তবে এই মরশুমে আপামর ইস্টবেঙ্গল সমর্থকরা একসুরে গেয়েছেন অরিজিৎ সিংয়ের গাওয়া গান “একশো বছর ধরে”

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, বহু বছর পর একশো বছর উদযাপনের অনুষ্ঠানে ইস্টবেঙ্গলে আসেন প্রবাদপ্রতিম ফুটবলার মজিদ বাসকার।

মজিদ বাসকার

মোটের উপর, বহু ঘাত-প্রতিঘাত, উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে গেলেও ইস্টবেঙ্গল সত্ত্বার কোনো পরিবর্তন হয়নি। একশো বছর আগে সুরেশচন্দ্র চৌধুরীরা যে স্বপ্ন নিয়ে ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, বর্তমান প্রজন্ম সেই ধারাকেই এগিয়ে নিয়ে চলেছে।

জীবনের পথচলায় সাফল্য, ব্যর্থতা আসতে থাকবে। আইএসএলে যোগদানের পরে ইস্টবেঙ্গল ক্লাব তথা ভারতীয় ফুটবল এখন এক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। আশা করা যেতেই পারে, নতুন ইনভেস্টর শ্রী সিমেন্টের আর্থিক পৃষ্ঠপোষকতায় এবং কোচ রবি ফাউলারের হাত ধরে ইস্টবেঙ্গল ক্লাব নতুন আগামীতে শীঘ্রই সাফল্যের সরণীতে ফিরে আসবে।

আশা করা যায়, নতুন দশকে ইস্টবেঙ্গল আবার তার পুরোনো মুকুট ফিরে পাবে, রাজ করবে ভারতীয় ফুটবলে। নতুন বছর নিয়ে আসুক অনেক অনেক সাফল্য ও গরিমা।

ইবিআরপি পরিবারের সকলকে ইংরেজি নববর্ষের একরাশ শুভেচ্ছা ও ভালোবাসা।

সকলে সুস্থ থাকবেন, ভালো থাকবেন।

League Table

PosClubPWDLFAGDPts
1Hyderabad FC129122471728
2Mumbai City FC1183032112127
3ATK Mohun Bagan127231712523
4Kerala Blasters FC117131914522
5FC Goa126152016419
6Odisha FC116141515019
7Chennaiyin FC114252123-214
8East Bengal114071320-712
9Bengaluru FC12318817-910
10Jamshedpur FC11128819-115
11NorthEast United FC1210111033-233

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.