যখন ইস্টবেঙ্গল (SC East Bengal) সমর্থকরা বিদেশী ফুটবলারদের নাম ঘোষণার অপেক্ষায়, গতকাল সন্ধ্যায় তখন হঠাৎ চমক দিয়ে রবি ফাউলারের (Robbie Fowler) বিদায়বার্তা আসে। তার জায়গায় আসছেন রিয়েল মাদ্রিদ কাস্তিলার (Real Madrid Castilla) স্প্যানিয়ার্ড কোচ ম্যানুয়েল ম্যানোলো ডায়াজ (Manuel ‘Manolo’ Diaz)। সমর্থকদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। ফাউলারের ম্যাচ অনুমান ক্ষমতা, প্ল্যান-বি, খেলোয়াড় পরিবর্তন ইত্যাদি নিয়ে অধিকাংশ সভ্য-সমর্থক মোটেই খুশি নন। তবে একেবারে শেষ দিকে দলের দায়িত্ব নেওয়া ফাউলারের উপর কি পুরো দোষ চাপিয়ে দেওয়া যায়? এক ঝলকে দেখে নেওয়া যাক ইস্টবেঙ্গলের গত মরসুমের খেলোয়াড়রা ট্রান্সফার উইন্ডোর শেষে কোথায় দাঁড়িয়ে আছে।
গত মরসুমেও ইস্টবেঙ্গল কোনো রকমে শেষ মুহূর্তে শ্রী সিমেন্টকে (Shree Cement) ইনভেস্টর হিসেবে নিয়ে এসে আই এস এলে (ISL) যোগদান করে। রবি ফাউলারের মতন লিভারপুলের (Liverpool) কিংবদন্তী খেলোয়াড়কে প্রশিক্ষক হিসেবে এনেও এগারো দলের মধ্যে নবম স্থানে শেষ করে তারা। প্রথম সাত ম্যাচে তিন পয়েন্ট যোগাড় করা লাল-হলুদ অংকের হিসেবে শেষ চারের লড়াই-এ টিকে থাকে অন্তিম চার রাউন্ড পর্যন্ত। এবং লীগ শেষ করে, ঠিক শুরুর মতন করেই। প্রথম তিনটি ম্যাচের মতন শেষ তিন ম্যাচেও জয়ের মুখ দেখেনি ফাউলারের ছেলেরা।
শুধুমাত্র ভারতীয় খেলোয়াড়দের নিয়েই আলোচনা করা যাক। দল গঠন হয়েছিল দুই ভাগে। আই এস এলে যোগদান নিশ্চিত হবার আগে কর্মকর্তারা বেশ কিছু স্বনামধন্য খেলোয়াড়কে নথিভুক্ত করান। শ্রী সিমেন্ট দায়িত্ব নেবার পর আরো কিছু খেলোয়াড়কে নিয়ে আসা হয়, এবং প্রি -কন্ট্রাক্টে সই করানো বেশ কিছু খেলোয়াড় বাদ পড়েন আই এস এলের টীম থেকে।
ফাউলারের ইস্টবেঙ্গল থেকে ছাঁটাই হওয়া সত্বেও মেহতাব সিংহকে (Mehtab Singh) তুলে নেয় মুম্বাই সিটি এফ সি, আর কমলপ্রীত সিংহ (Kamalpreet Singh) পাড়ি দেন ওড়িশা এফ সি-তে (Odisha FC)। গতবারে ইস্টবেঙ্গলের হয়ে খেলে এই বছর আই এস এলের কোনো দলে গেছেন মাত্র পাঁচ জন ফুটবলার। তারা হলেন দেবজিৎ মজুমদার (Debjit Majumder) এবং নারায়ণ দাস (Narayan Das) (চেন্নাইয়িন এফ সি), (Chennaiyin FC) মোহাম্মদ ইরশাদ (Mohammed Irshad) (নর্থইস্ট ইউনাইটেড এফ সি) (Northeast United FC), সার্থক গলুই (Sarthak Golui) এবং হারমানপ্রীত সিংহ (Harmanpreet Singh) (বেঙ্গালুরু এফ সি) (Bengaluru FC)। প্রীতম কুমার সিংহ (Pritam Kumar Singh) লাল-হলুদ জার্সিতে মাঠে নামার সুযোগ না পেলেও এই বছর হায়দরাবাদ এফ সি (Hyderabad FC) তাকে তাদের দলে নিয়েছে। ইস্টবেঙ্গল একাডেমির ছাত্র বিদ্যাসাগর সিংহ (Vidyasagar Singh) ট্রাও এফ সি-র (TRAU FC) হয়ে আই-লীগে (I-League) সর্বোচ্চ গোলদাতা হবার পর তাকে দলে নিয়েছে বেঙ্গালুরু এফ সি। নাওরেম তান্ডমবা সিংহ (Naorem Tondomba Singh) সুদেভা দিল্লির (Sudeva Delhi FC) হয়ে খেলে তিন বছরের জন্য সই করেছেন মুম্বাই সিটি এফ সি-তে (Mumbai City FC)। ট্র্যান্সফার উইন্ডো বন্ধ হবার পর নর্থইস্ট ইউনাইটেডে ডাক পান ক্লাব না পাওয়া শেহনাজ সিংহ (Sehnaj Singh)।
আই-লীগের ক্লাবে যারা গেছেন তারা হলেন, গুরতেজ সিং (Gurtej Singh), রিনো এন্টো (Rino Anto), কীগান পেরেরা (Keegan Pereira) এবং সি কে ভিনীত (CK Vineeth) (রাউন্ডগ্লাস পাঞ্জাব এফ সি) (Roundglass Punjab FC), সামাদ আলি মল্লিক (Samad Ali Mallick) এবং গিরিক খোসলা (Girik Khosla) (শ্রীনিধি ডেকান) (Sreenidi Deccan FC), মনোজ মহম্মদ (Manoj Mohammed), মিলান সিংহ (Milan Singh) এবং লালরামচুলভা (Lalramchullova) (মহামেডান এস সি) (Mohammedan SC), অভিষেক আম্বেকার (Abhishek Ambekar) এবং পিন্টু মাহাতা (Pintu Mahata) (সুদেভা দিল্লি এফ সি), বিকাশ সাহনি (Vikas Singh Saini) (চার্চিল ব্রাদার্স) (Churchill Brothers SC)। রক্ষিত দাগার (Rakshit Dagar) ইস্টবেঙ্গল থেকে যান সুদেভা দিল্লি এফ সি-তে, এবং এই বছর সই করেছেন গোকুলাম কেরালা এফ সি-তে (Gokulam Kerala FC)।
রানা ঘরামি (Rana Gharami) গেছেন আই লীগ-২ (I League-2)-এর ক্লাব এফ সি বেঙ্গালুরু ইউনাইটেডে (FC Bengaluru United)। পি সি রোহলুপুইয়া ২০২৪ সাল অবধি চুক্তিবদ্ধ হয়েছেন মুম্বাই সিটি -২-এর (Mumbai City FC-2) সাথে। ক্যালকাটা কাস্টমসের (Calcutta Customs) হয়ে খেলবেন প্রকাশ সরকার (Prakash Sarkar)। লালরিন্দিকা রালতে (Lalrindika Ralte) গত বছর রিয়েল কাশ্মীর এফ সি-র (Real Kashmir FC) হয়ে খেললেও তার চুক্তির মেয়াদ শেষ হবার পর এখনো ক্লাব পান নি। ক্লাব না পাওয়া বা অনিশ্চিত মরসুমের সম্মুখীন আরো কিছু খেলোয়াড়দের মধ্যে আছেন জেজে লালপেখলুয়া (Jeje Lalpekhlua), ইউজেনসন লিংডো (Eugeneson Lyngdoh), বলবন্ত সিংহ (Balwant Singh), গুরবিন্দর সিংহ (Gurwinder Singh), কেভিন লোবো (Cavin Lobo), রফিক আলী সর্দার (Mohammad Rafique Ali Sardar), অনিল চাওয়ান (Anil Chawan), নবীন গুরুং (Novin Gurung) এবং শুভম সেন (Suvam Sen)।
গত মরসুমের অনেকেই ইস্টবেঙ্গলের হয়েই খেলবেন ২০২১-২২ মরসুমের আই এস এল। তাদের অনেককেই হয়তো স্বাভাবিক পছন্দের খাতিরে রাখা হচ্ছেনা। বরঞ্চ পাঁচ দিনে দল গড়ার অসাধ্য সাধন করতে নামা ম্যানেজমেন্টের উপায়ান্তর-ও ছিল না। এদের অধিকাংশই তরুণ, তরতাজা। ইস্টবেঙ্গলের সেরা খেলোয়াড়দের ক্লাইম্যাক্সের জন্য অপেক্ষা করতে হয়নি। তারা অনায়াসে অন্য আই এস এল দলের ডাক পেয়েছেন এবং যোগদান করেছেন। অতয়েব বোঝাই যাচ্ছে যে ২০২০-২১ মরুসুমের ইস্টবেঙ্গলের দলের খেলোয়াড়দের মধ্যে কতখানি আই এস এলে খেলার রসদ ছিল বা রয়েছে। একটু অপেক্ষা করে দেখা যাক গত মরসুমের খেলোয়াড়রা অন্য দলে গিয়ে প্রথম একাদশে জায়গা করে নিতে পারেন কিনা। বিশেষ করে এই বছর যখন অতিরিক্ত একজন ভারতীয় খেলোয়াড় মাঠে থাকবেন। গত বছর লাল-হলুদ জনতা দুই ভাগে ভাগ হয়ে গেছিলো রবি ফাউলারকে কেন্দ্র করে। তার সৈন্যরা যে অপুষ্টিতে ভুগছিলেন তার একটা পরিচয় পাওয়া যায় অন্যান্য ক্লাবে এই মরসুমের জন্য তাদের চাহিদা দেখলে।
অনিশ্চয়তা ইস্টবেঙ্গল সমর্থকদের প্রতিদিনের সঙ্গী হয়ে গেছে। শেষ মুহূর্তে মুখ্যমন্ত্রীর মমতা ব্যানার্জীর নির্দেশে খেলা হচ্ছে বটে, দল-ও গঠন হচ্ছে যুদ্ধকালীন তৎপরতায় চূড়ান্ত পেশাদারিত্বের সাথে। ট্রান্সফার উইন্ডো বন্ধ হবার পর লোনেও আর খেলোয়াড় আনা যায়না, একান্তই ফ্রি প্লেয়ার না হলে। মাঝারি মানের আফ্রিকানরা ইউরোপ বা মধ্য-প্রাচ্যের লীগেই খেলতে আগ্রহী। সেই সব দেশে নীচুর সারির লীগ-ও চালু হয়ে গেছে। আই এস এল খুব স্বল্প-মেয়াদী টুর্নামেন্ট। তার উপর স্যালারি ক্যাপকে মান্যতা দিয়ে ভালো বিদেশী নিতান্তই দুর্লভ। একান্তই যদি কোচ বদলের মতন চমক বিদেশী চয়নেও না হয়ে থাকে, অর্থাৎ আগেভাগে বিদেশী বেছে রাখা আছে।
অধিকাংশ লাল-হলুদ সমর্থকদের খুশি করে কোচ পরিবর্তন হলো। যিনি এলেন তিনি আলেহান্দ্রো মেনেন্দেজের (Alejandro Menéndez) সোনালী স্মৃতি উস্কে দিয়েছেন। তাঁর অপূর্ণ কাজটি সম্পূর্ণ করার দায়িত্ব এখন ম্যানোলোর হাতে। অপেক্ষা শেষ বেলায় ভাগ্য এবং পেশাদারিত্বের মেলবন্ধনে কিছু ভালো বিদেশী খেলোয়াড়ের। দীর্ঘ আঁধারের পর, আগুনের স্ফুলিঙ্গ দেখা যাচ্ছে। তা থেকে মশাল কতটা জলে তার অপেক্ষায় আপামর লাল-হলুদ জনতার দিন গোনা শুরু।