আই এস এল ( ISL ) এ গোয়ার তিলক ময়দানে (Tilak Maidan) আজ নিজেদের দ্বিতীয় খেলায় মুখোমুখি হয়েছিল এস সি ইস্ট বেঙ্গল (SC East Bengal) এবং এটিকে মোহনবাগান (ATK Mohun Bagan) । এটিকে মোহনবাগানের সংযুক্তিকরণ সংক্রান্ত প্রবল বিতর্কের মধ্যেও আপামোর ফুটবলপ্রেমী বাঙালি তথা ভারতবাসীর কাছে এটা নিঃসন্দেহে প্রতিযোগিতার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ খেলা ছিল । তবে গতবারের মতো এই বছরও এত গুরুত্বপূর্ণ খেলা এত শুরুতে হওয়া মোটেই অভিপ্রেত নয়। বিশেষ করে কর্মকর্তাদের চুড়ান্ত অসহযোগিতার শেষ মুহূর্তে প্রায় নতুন করে দল তৈরি করা এসসি ইস্ট বেঙ্গলের জন্য যাদের দলে এখনো সেভাবে বোঝাপড়া তৈরিই হয় নি।
প্রথম খেলায় জামশেদপুরের (Jamshedpur FC) সাথে ড্র করা ইস্ট বেঙ্গল দলে আজ ৪ টি পরিবর্তন ছিলো। রক্ষণে রাজু (Raju Gaikwad), জয়নার লরেন্সো (Joyner Lourenco), মাঝমাঠে সীডেল (Darren Sidoel) আর আক্রমণভাগে নাওরেম মহেশকে (Naorem Mahesh Singh) প্রথম দলে রেখেছিলেন প্রশিক্ষক মানালো ডিয়াজ (Manolo Díaz)। রয় কৃষ্ণা (Roy Krishna) হুগো বুমসদের (Hugo Boumous) শক্তিশালী আক্রমণভাগের কথা ভেবেই ইস্ট বেঙ্গল প্রশিক্ষক আজ ৫ জনের রক্ষণ নিয়ে দল সাজিয়েছিলেন। ২ জন বিদেশী মার্সেলা (Tomislav Mrcela) আর পার্সের (Franjo Prce) সাথে রাজু ,জয়নার লরেন্সো আর জাইরু আজ শুরু করেন রক্ষণে ।
অপরদিকে প্রথম খেলায় সহজেই জয় পাওয়া এটিকে মোহনবাগান স্বাভাবিকভাবেই ভাবেই দলে কোনো পরিবর্তন আনেনি।
আগের খেলার জমাট রক্ষণ দেখে ইস্ট বেঙ্গল সমর্থকদের আশা ছিলো রক্ষণটা অন্তত নির্ভরতা দেবে আজকের খেলায়। প্রথম ১০ মিনিটে রক্ষণ আর মাঝমাঠে ভালোই শুরু করেছিলো ইস্ট বেঙ্গল। মাটিতে বল রেখে নিজেদের মধ্যে বেশ কিছু পাস খেলা দেখা যাচ্ছিলো । তবে খেলার ওপর ইস্ট বেঙ্গলের এই নিয়ন্ত্রণ এইটুকু সময়েই ছিলো।
এরপর পুরোটাই ছিলো এটিকে এমবির নিয়ন্ত্রণে। ১১ মিনিটেই ডান দিক থেকে প্রীতমের (Pritam Kotal) বাড়ানো বল থেকে বক্সের মাথায় ফাঁকায় দাঁড়ানো রয় কৃষ্ণা গোল করতে ভুল করেননি। বোঝা গেলোনা দুজন বিদেশী ডিফেন্ডার থাকা সত্ত্বেও কি করে কৃষ্ণা ফাঁকায় দাঁড়িয়ে ছিলেন।
এই গোলের রেশ কাটতে না কাটতেই ১৩ মিনিটে কাউকোর (Joni Kauko) মাঝ মাঠ থেকে সুন্দর বাড়ানো বল থেকে মনভীর (Manvir Singh) গোলার মতো শট এ গোল করে গেলেন। এত জোরে শট টি ছিলো যে প্রথম পোস্টে বল থাকলেও অরিন্দম (Arindam Bhattacharya) কিছু করতেই পারেননি। যদিও এক্ষেত্রে বিকাশ জাইরুর পাশ থেকে মানবীর এত সহজে বেরিয়ে যাওয়াটা অনেক বেশি অবাক করলো ।
এরপর ২৩ মিনিটে লিস্টনের (Liston Colasso) গোলটা পুরোটাই অরিন্দমের উপহার। হুগো বুমসের সাধারণ একটা বলকে অকারণে এগিয়ে এসে ধরতে গিয়ে অরিন্দমের হাত থেকে বল বেরিয়ে যায়। গোল করতে ভুল করেননি লিস্টন। এই মুভ থেকেই চোট লাগার ফলে অরিন্দম বসে যান। পরিবর্তে নামেন শুভম সেন।
প্রথমার্ধের বাকি সময়টাও ইস্ট বেঙ্গলকে আর খেলায় ফিরে আস্তে দেননি হাবাসের (Antonio López Habas) ছেলেরা। প্রত্যেকটা বিভাগেই অনেক এগিয়ে ছিলো এটিকেএমবি (ATK MB)। একটি হলুদ কার্ড দেখা ছাড়া সীডেলকে (Darren Sidoel) সেভাবে চোখেই পড়েননি। রফিক (Mohammed Rafique) সহ মাঝমাঠে খেলা বাকি খেলোয়ারাও কেউই পেরোসেভিচের (Antonio Perošević) জন্য কোনো বল বাড়াতে পারেননি। প্রথমার্ধের একদম শেষে রফিক বক্সের মধ্যে একটি ছোট পাস রেখেছিলেন পেরোসেভিচের জন্য যেটা থেকে নেওয়া শট থেকে ইস্ট বেঙ্গল খেলার প্রথম কর্নার পায়।
দ্বিতীয়ার্ধে আর গোল হয়নি। এটিকে মোহবাগানের তাগিদ কম থাকলেও মনভীর, কাউকো, ডেভিড উইলিয়ামস (David Willams) এবং রয় কৃষ্ণা বেশ কয়েকবার ত্রাসের সৃষ্টি করেন। তবে দ্বিতীয়ার্ধে দুটি আক্রমণাত্মক পরিবর্তন আনেন কোচ। বিরতির পরেই ডিফেন্ডার তোমিস্লাভ মার্সেলের জায়গায় আসেন প্লেমেকার আমির দারভিসেভিচ (Amir Dervišević) এবং খেলার এক ঘন্টার মাথায় ড্যারেন সিডেলের জায়গায় মাঠে নামেন চিমা (Daniel Chima Chukwu)। ফলতঃ ইস্টবেঙ্গল বেশ কয়েকটি সুযোগ তৈরী করে। যদিও লাল-হলুদের পক্ষে খেলার শেষে গোলমুখী শটের সংখ্যা থাকে শূন্যই। ইস্টবেঙ্গলের খেলার ধরণে আসে লক্ষণীয় পরিবর্তন। দারভিসেভিচ খুব শ্লথ হলেও ওনার মূল শক্তি হলো বাঁ পায়ে। আক্রমণভাগে ফিন্কির মতন ছড়িয়ে দিতে পারেন বিপক্ষ রক্ষণকে বিভ্রান্ত করা সব বল। পেরোসেভিচ এবং নাওরেম মহেশ সিংএর খেলায় প্রাণের সঞ্চার হয়েছিল আমির নামার পর। চিমা নামার পর এটিকে মোহনবাগান রক্ষণ ব্যস্ত হয়ে পড়ে। তবে দারভিসেভিচ মন্থর হওয়ায় তার পাশে কোনো ভালো মানের ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার না পেলে মাঝমাঠে দখল রাখা মুশকিল। একই সাথে ওনার ধীর গতির জন্য ‘ফলস নাইন’ খেলায় অবদান রাখতে খুব একটা সফল হবেন বলে মনে হয়না। অতয়েব আমির মাঝমাঠে খেললে দুই বিদেশী ফরওয়ার্ড বা পেরোসেভিচের সাথে একজন ভালো ভারতীয় স্ট্রাইকার না হলে আক্রমণ হলেও তার বিষদাঁত ভেঙে যাবে। গত এক বছর প্রায় খেলার মধ্যে ছিলেন না চিমা অথবা মার্সেলাকে তাদের সেরা খেলার জায়গায় আসতে আরো সময় দিতে হবে। চিমা এবং পেরিসেভিচের মধ্যে বোঝাপড়া তৈরী হলে বিপক্ষ দলের ঘুম কেড়ে নিতে পারে ইস্টবেঙ্গল। যদিও ভারতীয় খেলোয়াড়দের মধ্যে একজনও নেই যিনি মাঝখান থেকে খেলা তৈরী করতে পারেন। গোলের খোঁজে মাঝমাঠ আর আক্রমণভাগে তিনজন বিদেশী খেলোয়াড়কে নামালে রক্ষণ সামলাতে এক বিদেশীর সাথে ভরসা রাখতে হবে আদিল খান এবং রাজু গায়কোয়াড়দের উপর। আজ তারা দুজনেই সফল। যদিও রাজুর চোট ম্যানোলোর কপালে ভাঁজ ফেলবে নিশ্চিত।
মোহাম্মদ রফিক মন্দের ভালো। দ্বিতীয়ার্ধের শুরুর দিকটায় সামনের দিকটায় খেললেও, চিমা নামার পরে অনেকটা সেন্ট্রাল ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডারের ভূমিকায় খেলতে দেখা যায় রফিককে। অমরজিৎ সিংকে দূরবীন দিয়ে খুঁজতে হয়েছে। রফিক বরঞ্চ তুলনায় ভালো ছিল। পার্সে এবং মার্সেলো জামশেদপুরের ভয়ংকর ফরওয়ার্ড লাইনকে আটকে দিলেও আজ এতো জীর্ণ দেখালো তার একটা কারণ পাঁচ ডিফেন্ডারের পরিকল্পনায় দুটি প্রান্ত ভীষণ দুর্বল ছিলো। জামশেদপুরের বিপক্ষে হীরা মন্ডল (Heera Mondal) নিদ্রাহীন প্রহরীর মতো রক্ষণ সামলালেও, বলের উপর নিয়ন্ত্রণ আর খেলা তৈরী করার ক্ষমতা দুটোই বেশ কম ছিলো। আজ তিনি আর সুযোগ পাননি। পর পর দুই ম্যাচে সুযোগ পাওয়া তরুণ খেলোয়াড় হামান্তে (Lalrinliana Hnamte) আজো ব্যর্থ হলেন। বরঞ্চ খেলার একদম শুরুর দিকে তার একটা অত্যন্ত খারাপ ফাউল থেকে যদি লাল কার্ড দেখাতেন রেফারী তাহলেও কিছু বলার ছিল না। বিকাশ জাইরুর রক্ষণ নিয়ে যত কম বলা যায় ততই ভালো। দীর্ঘদেহী মনভীরের পাশে ৫ ফুট ৩ ইঞ্চির বিকাশ রীতিমতো খাবি খাচ্ছিলেন। জয়নার লরেন্সো নিজের সামর্থ্য অনুযায়ী চেষ্টা করলেও লিস্টনের দৌড়ের বিরুদ্ধে এক অসম লড়াই ছিল আজ। আই এস এলে বিদেশী স্টপার ফুল ব্যাকের আধিপত্যে ভারতীয় রাইটব্যাক আর লেফটব্যাকের মুড়িমুড়কি। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো ইনভেস্টর আর ক্লাব কর্মকর্তাদের দড়ি টানাটানিতে শেষ বাজারে যুদ্ধে নামা এস সি ইস্টবেঙ্গলের হাতে ভালোমানের প্রকৃত সাইডব্যাকও নেই। অঙ্কিত মুখার্জী (Ankit Mukherjee) এখনো পুরোপুরি সুস্থ নন। হীরা এতো বড়ো মঞ্চে এই প্রথম। সবশেষে বলতে হয় এরম গুরুতূপূর্ণ খেলায় ৩-০ পিছিয়ে থাকা অবস্থায় হঠাৎ করে মাঝখানে সুযোগ পেয়ে ভালো খেললেন পরিবর্ত গোলকীপার শুভম সেন।
শেষ মুহূর্তের জোড়া-তালির টীম, সামনের বছরের গ্যারান্টি কারুর কাছে নেই। খেলোয়াড়, কোচ, সমর্থক, এমনকি কর্মকর্তারাও জানেন না ক্লাবের ভবিষ্যৎ কি। রাজনীতি, আন্দোলন আর কাদা ছোড়াছুড়িতে কালিমালিপ্ত শতবর্ষের ইতিহাস। তবে, একটা দু বছরের সেট দল, যার প্রথম দলের সাত ভারতীয়দের মধ্যে পাঁচজন জাতীয় দলের নিয়মিত খেলোয়াড়, তিন বছর ধরে দলটির সাথে থাকা স্বনামধন্য কোচ; সেই দলের বিরুদ্ধেই ভারতের মাটিতে কেরিয়ারের দ্বিতীয় ম্যাচেই উত্তপ্ত ডার্বি। এই আবেগের ডার্বিতে কেউ আন্ডারডগ হয়ে নামতে চায় না, হেরে ফিরতে চায় না। রিয়েল মাদ্রিদ কাস্তিয়ার (Real Madrid Castilla) প্রাক্তন ম্যানেজার ভারতের এল-ক্লাসিকোর (El Clásico) উন্মাদনা নিয়ে কতটা পড়াশুনো করেছেন জানা নেই। তবে চব্বিশ মিনিটের মধ্যে তিন গোল খেয়েও হারার আগেও না হারার যে লড়াইটা, বিশেষ করে দ্বিতীয়ার্ধে উনি চালিয়ে গেলেন তা ফিরতি ডার্বি হয়তো একতরফা হতে দেবে না।
আর এটিকে মোহনবাগান এই খেলায় আবার প্রমান করলো এই প্রতিযোগিতার তারা সেরা দল। রয় কৃষ্ণা ছাড়া প্রত্যেক পসিশনে একাধিক খেলোয়াড় আর সেট টিম নিয়ে ভালো কিছু না হওয়াটাই অঘটন হবে।