এস সি ইস্টবেঙ্গল তাদের প্রথম হিরো আইএসএল অভিযানের দশম খেলায় মুখোমুখি হয়েছিল বেঙ্গালুরু এফ সি-র বিরুদ্ধে। সাবেকি আই-লীগ খেলা ক্লাবগুলির মধ্যে যেহেতু এই দুটিই এখন আইএসএলে টিঁকে আছে, তাই এই খেলা ছিল পুরানো প্রতিদ্বন্দ্বিতা আর একবার ঝালিয়ে নেওয়া।
ইস্টবেঙ্গল কোচ রবি ফাউলার দল নামিয়েছিলেন ৫-৩-২ ছকে, যা আক্রমনের সময় হয়ে যাচ্ছিলো ৩-৫-২। উল্টোদিকে বেঙ্গালুরু নেমেছিলেন ৪-৩-৩- ছক সাজিয়ে, যদিও তা মাঝে মাঝে বদলে যাচ্ছিলো ৪-২-৪ বা ৩-৪-৩ ছকে।
খেলার শুরু থেকেই কলকাতার দৈত্যদের বেশ আক্রমণাত্মক ও আত্মবিশ্বাসী লাগছিলো। আগের দিনের মতোই হারমানপ্রীত বিপক্ষের দুই স্টপারের সামনে দাঁড়িয়ে উইথ বল স্টপারকে প্রেস করছিলেন। দুই হাফ স্পেসকে রক্ষা করছিলেন মাঘমা ও ব্রাইট। উদ্দেশ্য ছিল যাতে মাঝমাঠে বেঙ্গালুরু পাস না খেলতে পারে ও তাদের উইং-এর দিকে সরে যেতে হয়।
উইং-এ বল গেলে নারায়ণ ও অঙ্কিত উঠে এসে প্রেস করছিলেন। ডিপ ডিফেন্সের সামনের জায়গাটায় ছিলেন স্টাইনম্যান ও মিলন। মাঝমাঠের এই পাঁচজনের ব্লক ও দুই উইং-এ দুই সাইডব্যাক বেঙ্গালুরুর আক্রমণকে নিষ্ক্রিয় করে দিতে অনেকটাই সক্ষম হয় বিশেষ করে খেলার প্রথমার্ধে।
উল্টোদিকে বেঙ্গালুরুও মাঝমাঠে একটা ব্লক তৈরি করেছিল। তাদের লক্ষ্য ছিল ইস্টবেঙ্গলকে নিচ থেকে খেলা তৈরি করতে না দেওয়া। ফক্সকে মার্ক করছিলেন ক্লেটন। দুই দিকে উদান্তা ও সুনীল ছিলেন দুই হাফ স্পেস। দেলগাদো ও সুরেশ যথাক্রমে স্টাইনম্যান ও মিলনকে মার্ক করছিলেন। ব্রাইটকে মার্ক করছিলেন পারতালু।
কিন্তু ইস্টবেঙ্গল নিচ থেকে খেলা তৈরির বিশেষ চেষ্টা না করে ডাইরেক্ট খেলা শুরু করে। যেহেতু ক্লেটন ফক্সকে মার্ক করছিলেন তাই নেভিল ক্রসফিল্ড বল ফেলা শুরু করেন বেঙ্গালুরুর রাইট ব্যাক-এর পিছনে।
সেটাকে সামাল দেওয়ার জন্য দেলগাদো আর সুরেশ নিজেদের জায়গা বদল করে নেন। এবার দেলগাদো সরে আসেন নেভিলের দিকে ও তার সাথে সুনীল এগিয়ে এসে নেভিলকে প্রেস করা শুরু করেন।
এই পরিপ্রেক্ষিতে ইস্টবেঙ্গল ও নিজেদের খেলার ধরন বদলে নেয়। এবার ব্রাইট নিচে নেমে আসেন ও লম্বা বল ফেলা শুরু করেন বেঙ্গালুরুর লেফট ব্যাকের পিছনে।
ব্রাইটের এই বলগুলি ও তার সাথে অঙ্কিতের দৌড় বেঙ্গালুরুর জন্য খুব বিপজ্জনক হয়ে ওঠে। এই সময়ে ইস্টবেঙ্গলের ফর্মেশন আক্রমণের সময় হয়ে যায় ৩-৩-৪।
এইরকম একটি আক্রমণ থেকে ইস্টবেঙ্গল নিজেদের প্রথম গোলটি তুলে নেয়। যদিও এক্ষেত্রে বলটি বাড়িয়েছিলেন রাজু। রাজুর লম্বা বল বেঙ্গালুরু রক্ষণের বাঁ দিকের ফাঁকা জায়গায় পড়ে। অঙ্কিত সেটা ধরে একটি ক্রস রাখেন। উল্টোদিক থেকে মাঘোমা ভিতরে সরে আসেন বেঙ্গালুরুর রাইট ব্যাককে সাথে নিয়ে। সেই ফাঁকা জায়গা থেকে একটি মাইনাস রাখেন নারায়ণ, যেটা লক্ষ্যে পৌঁছে দেন নিঃশব্দে উঠে আসা স্টাইনম্যান।
ব্রাইট এবং মাঘোমার নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ বেশ ভালো ছিল। দুজনেই ক্রমাগত জায়গা অদলবদল করায় তাঁদের মার্ক করা খুবই কঠিন হচ্ছিলো। এই সময় হারমানপ্রীতের অভিজ্ঞতার অভাব বাধা হয়ে দাঁড়ায়। যেমন এই ছবিতে দেখা যাচ্ছে হারমানপ্রীত যদি ভেকের পিছন দিয়ে দৌড়ান তাহলে খুব সহজ সুযোগ তৈরি হতে পারে। কিন্তু তিনি দুই স্টপারের মাঝখান দিয়ে দৌড়ে অফসাইড হয়ে গেলেন। এর ফলে ব্রাইটের কাছে তাঁকে পাস বাড়ানোর কোনো উপায় রইলো না।
দ্বিতীয়ার্ধে বেঙ্গালুরু একটি খুব সুন্দর ট্যাকটিক্যাল বদল আনে তাদের খেলার ধরণে। বেঙ্গালুরুর খেলার মূল চাবিকাঠিটি থাকে দেলগাদোর হাতে যিনি এতক্ষন বেশ নিষ্প্রভ ছিলেন কারণ তাঁকে খুব বেশি বল পেতে দেননি ইস্টবেঙ্গলের মাঝমাঠ। এবার দেলগাদো জায়গা বদল করে অনেকটা নিচে নেমে এসে প্রায় তৃতীয় স্টপার এর জায়গা থেকে খেলতে শুরু করেন। এর সাথে কোচ মুসা নামান অফসেটকে, যিনি ক্লেটন-এর জায়গাটা নেন ও ক্লেটন সরে আসেন ডান দিকে। এই বদলটি বেঙ্গালুরুর খেলার ধরণ অনেকটাই পাল্টে দেয়।
দেলগাদোর পজিশনিং ইস্টবেঙ্গলের জন্য সমস্যা তৈরি করছিলো।
দেলগাদো যিনি এতক্ষন মাঝমাঠের ব্লকে হাঁসফাঁস করছিলেন, এবার অনেকটা জায়গা পেয়ে যান ও মাপা বল বাড়াতে শুরু করেন অফসেটের উদ্দেশ্যে। অফসেট ও কিছুটা নিচে নেমে বিটুইন দা লাইন খেলতে শুরু করেন। এই বদলটি ইস্টবেঙ্গল ডিফেন্সের জন্য সমস্যা তৈরি করে। বিশেষ করে দেলগাদোকে কে মার্ক করবেন সেটা নিয়ে। আবার অফসেট যখন বিটুইন দা লাইন আসছিলেন তখন রাজু একটা সমস্যায় পড়েন যে তিনি তাঁকে ফলো করবেন না নিজের জায়গায় থাকবেন। নিজের জায়গায় থাকলে অফসেট বল নিয়ে ঘোরার জায়গা পাচ্ছিলেন যেটা বিপজ্জনক। আবার তাঁকে ফলো করলে পিছনে ফাঁকা জায়গা তৈরি হচ্ছিলো। এই সমস্যার ফলে বেঙ্গালুরু এই পর্যায়ে বেশ কয়েকটি সুযোগ তৈরি করে কিন্তু দেবজিতের দক্ষতায় ইস্টবেঙ্গলের রক্ষণ দুর্গ অটুট থাকে।
এর পরে ইস্টবেঙ্গল আবার খেলার রাশ নিজের হাতে নিয়ে নেয়. মাঘোমা নিচে নেমে এসে বল ধরে খেলার গতি শ্লথ করে দেন। তার সাথে ব্রাইট ওপরে উঠে যান। আহত স্টাইনম্যানের জায়গায় নামেন অ্যারন। অ্যারন ও ব্রাইটের যুগলবন্দিতে এই সময় ইস্টবেঙ্গল ও গোলসংখ্যা বারবার সুযোগ পেয়েছিলো, কিন্তু শেষ পর্যন্ত এক গোলের ব্যবধানই থেকে যায়।
পরিশেষে বলা যায়, লীগের শুরুতে যেই দলটিকে অনেক বিশেষজ্ঞই প্রায় খরচের খাতায় ফেলে দিয়েছিলেন তারাই আস্তে আস্তে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। এর পরের খেলাগুলির দিকে অনেক আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে থাকবে ফুটবল মহল।