সুপার সানডে-র প্রথম ফাইনালে বাঙালির সবথেকে প্রিয় দুই দল ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা মুখোমুখি হয়েছিল রিও ডি জেনেইরো (Rio de Janeiro) ঐতিহাসিক মারাকানায় (Maracanã Stadium)। যতই খেলার মানের দিক থেকে ইউরো এগিয়ে থাকুক, শিল্প, আবেগ আর ব্যক্তিগত নৈপুণ্যের জন্য সব সময় আলাদা ভালোবাসা পেয়েছে ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা। তাই মহা রবিবারের দ্বিতীয় ফাইনালে (ইউরো ২০২০) রাত জাগার আগে বাঙালি ভোরে উঠেছিল নেইমার – মেসিদের স্বপ্নের ফুটবল দেখার জন্য।
১-০ গোলে ব্রাজিলকে হারিয়ে ২৮ বছর পর আবার কোন বড় প্রতিযোগিতা জিতলো আর্জেন্টিনা। সারা বিশ্ব জুড়ে ছড়িয়ে থাকা তাদের কোটি কোটি সমর্থকদের মুখে হাসি ফুটলো। তাদের শেষ ট্রফি ছিল সেই ১৯৯৩ কোপা আমেরিকা। এর সাথে নিজের ষষ্ঠ কোপায় খেলতে নেমে অবশেষে সিনিয়র লেভেলে দেশের হয়ে নিজের প্রথম ট্রফি জিতলেন এই প্রজন্মের অন্যতম সেরা ফুটবলার লিওনেল মেসি (Lionel Messi)।
পর্তুগিজ এবং ইংরাজিতে “Angel” শব্দের অর্থ হলো “দেবদূত”। ভারতীয় সময় রবিবার ভোরে যেন ফুটবল দেবতার দূত হয়েই মারাকানায় নেমেছিলেন এঞ্জেল ডি মারিয়া, যিনি ব্রাজিলের বিরুদ্ধে ফাইনালের আগে পুরো টুর্নামেন্টে প্যারাগুয়ে ছাড়া অন্য কোনও ম্যাচে প্রথম একাদশে জায়গা পাননি। ২৮ বছর ধরে আর্জেন্টিনার যে আন্তর্জাতিক ট্রফি খরা চলছিল, তাতে ইতি টানলেন ৩৩ বছর বয়সী এই উইঙ্গার। আর্জেন্টিনার রাজধানী বুয়েনস আইরেস থেকে ৩০০ কিমি দূরে রোজারিও শহরে এক কয়লা মজুরের পরিবারে ভ্যালেন্টাইন্স ডে’র দিনে জন্ম ডি মারিয়ার। ছেলেবেলায় রীতিমত হাইপারকাইনেসিস রোগে ভুগতেন দরিদ্র ঘরের এই বাচ্চাটি। ধন্যবাদ সেই ডাক্তারকে যিনি ডি মারিয়ার বাবা-মা মিগুয়েল এবং ডায়ানা-কে পরামর্শ দিয়েছিলেন ৩ বছর বয়সেই সন্তানকে খেলায় ভর্তি করার। ছোটবেলায় বুট কেনার পয়সা না থাকা ডি মারিয়ার মার্কেট ভ্যালু আজ প্রায় ৪০ মিলিয়ন ইউরো। বাঁপায়ে যিশুখ্রিস্টের এবং ডানপায়ে আর্জেন্টিনার পতাকার ট্যাটু আঁকানো ৫ ফুট ১০ ইঞ্চির এই মানুষটির গোল থেকেই প্রায় তিন দশকের শাপমুক্তি ঘটলো আর্জেন্টিনার।
আধুনিক ফুটবলের কিংবদন্তি লিওনেল মেসির (Lionel Messi) ট্রফি ক্যাবিনেটেও শেষমেশ জায়গা পেল আর্জেন্টিনার জার্সি গায়ে জেতা আন্তর্জাতিক ট্রফি। অবশেষে মিললো পোয়েটিক জাস্টিস (Poetic Justice)।
তবে সহজ ভাবে আসেনি এই জয়। আর্জেন্টিনা (Argentina national football team) রক্ষণের নাছোড়বান্দা লড়াই এই জয় এনে দিলো তাদের।
কোয়ার্টার ফাইনালে সরাসরি লাল কার্ড দেখে দু ম্যাচের জন্য সাসপেন্ড হয়ে টুর্নামেন্ট (2021 Copa América) থেকেই ছিটকে গিয়েছিলেন গ্যাব্রিয়েল জেসুস (Gabriel Jesus)। ফলে তাঁর জায়গায় জায়গায় ব্রাজিলের হয়ে শুরু করেন প্যাকেটা (Lucas Paquetá)। অপরদিকে আর্জেন্টিনার হয়ে শুরু করেন অভিজ্ঞ দি মারিয়া (Ángel Di María)। দুর্বল রক্ষণকে নির্ভরতা দিতে আর্জেন্টিনা কোচ স্কালোনি (Lionel Scaloni) খানিকটা ঝুঁকি নিয়েই শুরু থেকে নামান চোট থেকে ফেরা রোমেরোকে (Cristian Romero) ।
তবে সমর্থকদের হতাশ করে দুটো দলই প্রথমার্ধে অতি সাধারণ মানের ফুটবল উপহার দিলো। দু দলের রক্ষণই প্রতিপক্ষে মেসি আর নেইমারকে একেবারেই খেলতে দেননি । ফলত কোনো গঠনমূলক খেলা দেখা যায়নি দু দলের খেলায়। মাঝমাঠে দখল নিতে পারেনি কেউই।
খুব খারাপ ট্যাকলিং আর অত্যাধিক ফাউলে খুব দৃষ্টিকটু লাগছিলো খেলা। খেলার ৩ মিনিটের মাথাতেই খারাপ ফাউল করে প্রথম হলুদ কার্ড দেখেন ব্রাজিলের ফ্রেড (Fred)। তারপর পুরো খেলায় দুটো দলের খেলোয়াড়রা মোট ৯ টি হলুদ কার্ড দেখেছেন। দুটি দলই খুব ভাগ্যবান তারা ১১ জনে খেলা শেষ করতে পেরেছে।
২১ মিনিটে মাঝমাঠ থেকে রডরিগো ডি পলের (Rodrigo De Paul) ডান প্রান্তে বাড়ানো বল ক্লিয়ার করতে ভুল করেন আতলেতিকোর (Atlético Madrid) ডিফেন্ডার লোদি (Renan Lodi)। সেই ভুল থেকে বল পেয়ে গোলকিপারের মাথার ওপর থেকে ছোট চিপে সুন্দর গোল করে চলে যান দি মারিয়া (১-০)। কোনো বড় প্রতিযোগিতায় ফাইনালে এই প্রথম গোল করলেন তিনি। সেমিফাইনালেও রডরিগো ডি পলের বুদ্ধিদীপ্ত থ্রু থেকেই গোলমুখী আক্রমণ শুরু করেছিলেন মেসি। পর পর দুটো খেলায় গুরুত্বপূর্ণ পাস বাড়ালেন এই মাঝ মাঠের খেলোয়াড়।
৩০ মিনিটে আরো একবার ডানদিক থেকে ভেতরে ঢুকে বাঁপায়ে গোলে বিপদজনক শট নিয়েছিলেন দি মারিয়া (Ángel Di María)। এর আগে কয়েকটি খেলায় পরিবর্ত হিসেবে নেমে নজর কাড়ায় আজ কোচ শুরু থেকে নামিয়েছিলেন দি মারিয়াকে। সুযোগকে সম্পূর্ণ কাজে লাগিয়ে সারা খেলাতেই বেশ ভালো খেললেন তিনি। যদিও দ্বিতীয়ার্ধে পুরোটা খেলেননি তিনি। প্রথমার্ধের একদম শেষ দিকে খানিকটা খেলায় ফেরার চেষ্টা করেছিল ব্রাজিল (Brazil national football team)। তবে তা থেকে কয়েকটা কর্নার আদায় করা ছাড়া বিশেষ কোনো লাভ হয় নি।
দ্বিতীয়ার্ধে অবশ্য পুরোটাই খেলা হয় আর্জেন্টিনার অর্ধে। মাঝমাঠের দখল পুরোটাই ছিল ব্রাজিলের কাছে। শুরুতেই গোল করার লক্ষ্যে ফ্রেডের জায়গায় লিভারপুলের (Liverpool F.C) আক্রমণাত্মক মাঝমাঠের খেলোয়াড় ফার্মিনহোকে (Roberto Firmino) নামান ব্রাজিল কোচ তিতে (Tite)। এর ফলে আক্রমণভাগে লোক বাড়ে ব্রাজিলের। মাঝখান থেকে নেইমারের আর ডান প্রান্তে রিচার্লিসনের যুগলবন্দী দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতেই একাধিক বার বিপদ তৈরি করে আর্জেন্টাইন রক্ষণে। ৫১ মিনিটে ওটামেন্ডিকে (Nicolás Otamendi) পরাস্ত করে রিচারলিসন (Richarlison de Andrade) গোল করেই দিয়েছিলেন ডানদিক থেকে ঢুকে। একটুর জন্য অফসাইড হয় বাতিল হয় সেই গোল। ৬২ মিনিটে আবার ডান প্রান্তে ফাঁকায় নেইমারের (Neymar Jr.) থেকে বুদ্ধিদীপ্ত বল পান রিচারলিসন। বক্সের মধ্যে থেকে রিচারলিসনের নেওয়া শট গোলকিপার আটকে দেন।
গোল করার লক্ষ্যে এরপর পর পর পরিবর্তন করেন ব্রাজিল কোচ। আক্রমণভাগে বামপ্রান্তে ভিনিসিয়াস জুনিয়র (Vinícius Júnior), স্ট্রাইকারে গ্যাব্রিয়াল (Gabriel Barbosa) আর সাইডব্যাক এমার্সনকে (Emerson) নামান তিনি। রিয়েল মাদ্রিদের (Real Madrid CF) ভিনিসিয়াস জুনিয়র হতাশ করলেও চেষ্টা করলেন গ্যাব্রিয়াল আর বার বার ওভারল্যাপে উঠে আসা এমার্সন। সব মিলিয়ে এই সময় বেশ চাপ ছিল ব্রাজিলের। তবে নেইমার বা ফার্মিনহো পরিষ্কার কোনো সুযোগ তৈরি করতে পারেননি। সারা খেলায় নেইমারের বিপদজনক দৌড় গুলোকে বক্সের কাছাকাছি পৌঁছাতেই দেয়নি আর্জেন্টিনা।
অন্যদিকে নিজেদের রক্ষণকে আরো জমাট করার লক্ষে রদ্রিগেজ (Guido Rodríguez), তাগলিয়াফিকো (Nicolás Tagliafico), পেজেলা-দের নামান (Germán Pezzella) আর্জেন্টিনার কোচ লিওনেল স্ক্যালোনি (Lionel Scaloni)। এ প্রসঙ্গে বলতেই হয় এই প্রতিযোগিতায় এখনো অবদি দুর্বল রক্ষণ বিপদে ফেললেও আজ দারুন লড়াই করলো আর্জেন্টিনীয় রক্ষণ। বিশেষত প্রায় পুরো দ্বিতীয়ার্ধেই রক্ষণে প্রবল চাপ আসলেও সেভাবে গোল করার সুযোগ দেয়নি তারা ব্রাজিলকে। আর যে কয়েকবার রক্ষণকে অতিক্রম করে সুযোগ পেয়েছিলো ব্রাজিল আর্জেন্টিনার গোলরক্ষক এমিলিয়ানো মার্টিনেজের (Emiliano Martínez) অনবদ্য গোলকিপিংয়ে গোলের দরজা খোলে নি। সারা প্রতিযোগিতায় ভালো খেলা মার্টিনেজ আজও নিজের জাত চেনালেন। ৮৭ মিনিটে খুব কাছ থেকে জটলার মধ্যে নেওয়া গ্যাব্রিয়ালের শট বাঁচিয়ে শেষ মুহূর্তে ব্রাজিলকে সমতায় ফিরতে দেননি। সঙ্গত কারণেই অ্যাস্টন ভিলার (Aston Villa) এই গোলকিপার প্রতিযোগিতার সেরা গোলরক্ষকের পুরস্কার পেলেন।
তবে ৮৮ মিনিটে প্রতি আক্রমনে ২-০ করার সহজ সুযোগ পেয়েছিলেন মেসি। মাঝেমাঠ থেকে নিজেই বল নিয়ে এসে ডান প্রান্তে বল বাড়িয়ে নিজে বক্সে ঢুকে যান মেসি। ডি পলের ফিরতি বলে একা গোলকিপারকে পেয়েও গোল করতে পারেননি তিনি। এরপর ৫ মিনিট অতিরিক্ত সময় দিলেও আর ফিরতে পারেনি ব্রাজিল। নিজেদের ১৫-তম ট্রফি জিতে কোপা জয়ের অংকে সবার ওপরে থাকা উরুগুয়েকে স্পর্শ করলো লা আলবিসেলেস্তে-রা (La Albiceleste)। সেটাও আবার ব্রাজিলের নিজের মাঠে ঐতিহ্যের মারাকানায়। দুৰ্ভাগ্য আজকের মাঠে বেশি দর্শকের প্রবেশাধিকার ছিল না এই জয় উপভোগ করার জন্য।
আরও একটি অবাক করা পরিসংখ্যান হল মারাদোনা (Diego Maradona) আর পেলে (Pelé) কেউ কখনও কোপা আমেরিকা জেতেননি। আজকের খেলার আগে অব্দি নেইমার বা মেসিও কেউই কোপা জেতেননি। অন্তত মেসি আজ তার বিখ্যাত পূর্বসূরীদেরকে এই পরিসংখানে পিছিয়ে দিলেন। এবারের টুর্নামেন্টে আর্জেন্টিনার ১২ টি গোলের মধ্যে মেসি নিজে ৪ টি গোল করে এবং ৫ টি গোল করিয়ে নিঃসন্দেহে এই প্রতিযোগিতায় একার কাঁধে দলকে টেনেছেন। প্রতিযোগিতার সর্বোচ গোলদাতাও তিনি। তবে প্রতিযোগিতার সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার মেসির সাথে যুগ্মভাবে নেইমারকে দেওয়াটা খানিকটা অবাক করলো। কারণ ব্রাজিলের ১২ টি গোলের মধ্যে নেইমারের নিজের গোল ২ টি আর তিনি গোল করিয়েছেন মাত্র ৩ টি।
সবশেষে কোপার ফাইনাল খেললেও দুটো দলের খেলা আহামরি লাগেনি। সারা প্রতিযোগিতাতেই দুটো দলই বড় বেশি মেসি বা নেইমার নির্ভর ছিল। পরের বছর বিশ্বকাপে ইউরোপের বাকি দলগুলোর সাথে অন্তত লড়াইয়ের জায়গায় যেতেও অনেক উন্নতি করতে হবে নিজেদের খেলায়। নাহলে কোপা জিততে পারলেও মেসিদের বিশ্বকাপ অভিযান সুখের হবে না।