এখনও যদি বাংলার কোনও মাঠেঘাটে কয়েকজন কিশোর তরুণদের ফুটবল খেলতে দেখা যায়, একটু খুঁজলেই কারও না কারোর গায়ে দেখা যাবে নীল-সাদা বা সবুজ-হলুদ জার্সি। প্রোমোটিং, মুঠোফোন, পড়াশুনোর ইঁদুরদৌড়ের জাঁতাকলে পড়ে বাঙালির পা থেকে ফুটবল লুপ্তপ্রায় হলেও ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা নস্ট্যালজিয়া এখনও একইরকম বিদ্যমান।
পঁচিশ বছর পিছিয়ে যাওয়া যাক। সে এক দিন ছিল বটে। যাঁরা আশি বা নব্বইয়ের দশকে এই বঙ্গে জন্মেছেন, তাঁরা প্রায় সকলেই এই ব্যাপারে নিজেদের প্রতিবিম্ব দেখতে পাবেন। এমনকি সত্তরের প্রজন্মও একই রকম অভিজ্ঞতা নিয়ে তাঁদের যৌবনকাল অতিবাহিত করেছেন। পেলে, গ্যারিঞ্চা, সক্রেটিসদের দৌলতে ৭০-এর দশক থেকেই ব্রাজিলীয় জোগা বোনিতো-তে কাবু ফুটবলপ্রিয় বাঙালি।
৮৬-তে মারাদোনা-বুরুচাগারা বিশ্বকাপ জিতলেন। তখন থেকে লাতিন আমেরিকার এই দেশটির ফুটবলের সঙ্গে বাঙালির আত্মিক যোগাযোগ শুরু। ১৯৯০-এ মারাদোনার বাঁপায়ের জাদুতে ফের সম্মোহিত হয় আপামর বিশ্ব। বাদ যায়নি বাংলাও। ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগানের চিরশত্রুতার বাইরেও ফুটবল রাইভ্যালরির এক নতুন দিগন্ত খুললো এদেশে, বিশেষত বাংলায়। অজান্তেই কখন যেন বাঙালদের প্রাণের ছেলে কৃশানু হয়ে উঠলেন ভারতের মারাদোনা।
১৯৯৪-তে প্রথমবারের জন্য ফুটবল বিশ্বকাপের আসর বসলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। একই সময়ে বিশ্বায়নের আঁচ লাগতে শুরু করেছে এশিয়াতে। কোকাকোলা, পেপসি জাতীয় বহুজাতিক সংস্থাগুলোও নিজেদের ব্যবসা বাড়াতে শুরু করেছে ভারতে। ফলে সেই সময় থেকেই শুরু হলো ভারতে বিশ্বফুটবলের বিপণন। উপরি পাওনা হিসেবে ব্রাজিলের অধিনায়ক দুঙ্গার হাতে উঠলো বিশ্বকাপ। বাঙালির বসার ঘরে (ড্রইংরুম শব্দটা তখনও আমাদের মজ্জায় ঢোকেনি) ঢুকে গেল রাত জেগে ফুটবল দেখার নেশা।
এ নেশা কি যে সে নেশা? জগমোহন ডালমিয়ার হাত ধরে শচীন, আজহারউদ্দিন-রাও তখন জাতীয় নায়ক। তবে বাংলায় ফুটবলের জনপ্রিয়তাতে ভাগ বসাতে পারেননি তাঁরা। কিন্তু গোটা দিন জুড়ে ক্রিকেট খেলা দেখার জন্য তবু কিছু কম্প্রোমাইজ করা যেত। বাড়ির সবচেয়ে খুদে সদস্যের উপর দায়িত্ব পড়তো ওয়ানডে শুরুর আগে ছাদে উঠে অ্যান্টেনা ঘোরানোর। কিন্তু ভারতীয় দলের খেলা তো তবু দূরদর্শনে দেখা যেত। কিন্তু বিদেশী ফুটবলের কি হবে?
কালার টিভি, তাতে কেবল কানেকশন তখনও সাধারণ জীবনে বেশ মহার্ঘ্য ব্যাপার। তার উপর মাঝরাতে খেলা। কিন্তু সন্ধ্যেবেলা মুড়ি তেলেভাজা খেয়ে সারারাত অম্বলে ভোগা মধ্যবিত্ত বাঙালি কি এত সহজে রণে ভঙ্গ দেওয়ার বান্দা? কখনই না। ফলে পাড়ায় পাড়ায় বসতো খেলা দেখার আসর। তখনও বাংলায় ক্লাব কালচার ছিল। কিন্তু আজকের আধুনিক প্রজন্ম (Gen Z) ক্লাব বলতে যেটা বোঝে, এটা মোটেও সেরকম ছিল না।
ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার খেলার দিনগুলো যেন এক অঘোষিত ছুটি। অকাল দুর্গোৎসবের আবহ। স্কুল-কলেজ, বাস-ট্রেন, অফিস-চায়ের দোকান সর্বত্র গুরুগম্ভীর আলোচনা। বাঙালির কাছে তখন গুগল ছিল না। ফলে যে সমস্ত মানুষ একটু খেলাধুলার খোঁজখবর রাখতেন, ফুটবলারদের তথ্য ঠোঁটস্থ রাখতেন, পাড়ায় অফিসে তাঁকে বেশ সম্ভ্রমের চোখেই দেখা হতো।
ক্লাবের কথা হচ্ছিল। ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা ম্যাচের তিনদিন আগে থেকে শুরু হতো হৈহৈ রৈরৈ। যেন এক মহাযজ্ঞের তোড়জোড়। পুরো এলাকা তখন মুড়ে ফেলা হতো দুই দেশের পতাকায়। পাড়ায় পাড়ায় ক্লাবগুলোর সে কি কম্পিটিশন! পূর্বপাড়ায় যদি ৩০ ফুট লম্বা ব্রাজিলের ফ্ল্যাগ লাগানো হয়, পশ্চিমপাড়ায় ৫০ ফুট লম্বা আর্জেন্টিনার পতাকা আসবেই আসবে। অনেকটা এই প্রজন্মের ইস্ট-মোহনের টিফো প্রতিযোগিতার মতো। যুদ্ধকালীন তৎপরতায় পাড়ার মোড়ে অস্থায়ী ছাউনি তৈরী হয়ে যেত, যেখানে বসে বা দাঁড়িয়ে একসাথে পুরো পাড়া ম্যাচ দেখবে। একফালি ত্রিপলে বসার জায়গা পাওয়া মানে লটারি লাভ। নইলে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই ৯০ মিনিট কাটাতে হতো। এরসাথে যুক্ত হতো পুরো এলাকাকে হলুদ-সবুজ বা নীল-সাদা প্লাস্টিকের রিবনে মুড়ে দেওয়া। হঠাৎ করে দেখলে কেউ ভিরমি খেতেই পারেন – তিনি কলকাতা বা মফস্বলের কোনও পাড়ায় রয়েছেন, নাকি পৌঁছে গেছেন রিও ডি জেনেইরো অথবা বুয়েনস আইরেসে।
আসলে খেলাটা তো ফুটবল। গরীবের খেলা। প্রান্তিক মানুষের খেলা। তাই মধ্যবিত্ত মানসিকতার বাঙালি ব্রাজিল-আর্জেন্টিনাকে খুব দ্রুত আপন করে নিতে পেরেছিলো।
মনে আছে শিবশঙ্কর পাত্র-কে? ৮৬-র বিশ্বকাপে মারাদোনাকে দেখে যাঁর আর্জেন্টিনা প্রেম শুরু। ২০১৮ বিশ্বকাপের আগে পেশায় চা-বিক্রেতা শিবশঙ্কর বাবু নিজের গোটা বাড়িটাই রাঙিয়ে ফেললেন নীল-সাদা রঙে। লিওনেল মেসির মধ্যে যিনি এখনও মারাদোনাকে খোঁজেন, যিনি এখনও স্বপ্ন দেখেন মারাদোনার মতো মেসিও আগামী বছর বহুপ্রতীক্ষিত বিশ্বকাপটায় চুমু খাবেন? ফুটবল নিয়ে পাগলামিতে বাঙালীকে টেক্কা দেবে কোন জাতি?
অথবা মনে আছে কলকাতার সেই রাস্তাটিকে, যে রাস্তার চারপাশ সাধারণত মাড়ান না সমাজে তথাকথিত ভদ্র বলে পরিচিত বাঙালিরা। হ্যাঁ, সোনাগাছির কথাই বলা হচ্ছে। ২০১৮ সালের বিশ্বকাপের আগে সেই কুখ্যাত গলিও তো সেজে উঠলো ব্রাজিলের হলুদ-সবুজ গ্র্যাফিটিতে। আসলে ফুটবল এরকমই। মানুষের মধ্যে কোনো ভেদাভেদ করে না।
তবে, বাঙালির ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা উৎসাহে অনেকটাই ভাঁটা পড়লো করোনা অতিমারীর জন্য। এমনিতেই এখন সবার পকেটে স্মার্টফোন থাকায় একসাথে বসে খেলা দেখার সংস্কৃতি অবলুপ্ত। তার বদলে এসেছে কে কত জ্ঞানী, সোশ্যাল মিডিয়াতে তা জাহির করার এক ভয়ঙ্কর প্রতিযোগিতা। নব্বইয়ের দশকে খেলা দেখা ছিল প্রায় “মিশন ইম্পসিবল”, ফলে ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা তুমুল রেষারেষির মধ্যেও মানুষ খেলাটা উপভোগ করতো। আর এখন ঘুম থেকে উঠে ইউটিউবে হাইলাইটস দেখেও ফেসবুকে আমি ঠিক, তুমি ভুল – এটা প্রমাণ করার এক অদম্য জেদ। ফলে এখন আর কেউ বন্ধুবান্ধবদের সাথে ঘুরতে বেরিয়ে রোনাল্ডো নাজারিও ডি লিমা, বাতিস্তুতার পোস্টার কেনে না, বরং ফেসবুক, হোয়াটস্যাপে রোনাল্ডো-মেসি-নেইমারদের মতো ঈশ্বরদত্ত প্রতিভাদেরও ট্রল, মিম শেয়ারে ব্যস্ত।
তবে ফুটবলজ্বরে এখনও আক্রান্ত হয় বাঙালি। এখনও একটা বড় অংশই ফুটবলটাকে, ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার যুগ যুগ ধরে চলা প্রতিদ্বন্দ্বিতাকে তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করেন। বন্ধুদের সঙ্গে খুনসুটিও করেন।
কথায় আছে, পৃথিবীর যে প্রান্তেই থাকুক না কেন, মহালয়ার দিন বাঙালী ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র চালাবেই। তবে বাঙালি শুধু যে মহালয়ার দিনেই ভোরে ওঠে তা নয়, ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা ম্যাচের দিনও ওঠে। আর তাই তো রবিবাসরীয় সকালেও ছুটির আমেজ কাটিয়ে ঘুমচোখে টিভির সামনে আবারও বসবে ফুটবলপাগল ভেতো বাঙালি। ঘন্টাদুয়েকের জন্য ঘটবে অকাল বঙ্গভঙ্গ। ব্রাজিল না আর্জেন্টিনা – শেষ হাসি যেই হাসুক, বাঙালির ফুটবল রসনার তৃপ্তিতে যে কোনও কমতি থাকবে না, তার গ্যারান্টি এখনই দিয়ে দেওয়া যায়।