এবছরের কোপা আমেরিকার (2021 Copa América) সবচেয়ে কঠিন ম্যাচটা বোধহয় ভারতীয় সময় শনিবার ভোরে খেলে ফেললো ব্রাজিল। দ্বিতীয়ার্ধের একদম শুরুতে লুকাস প্যাকেতার করা একমাত্র গোলে চিলিকে (Chile national football team) হারিয়ে এবছরের কোপা আমেরিকার সেমিফাইনালে পৌঁছে গেল তিতের (Tite) প্রশিক্ষণাধীন ব্রাজিল টিম (Brazil national football team)।
চিলির বিরুদ্ধে কোয়ার্টার ফাইনাল ম্যাচে নামার আগে নিজেদের গ্রুপ বি-এর শেষ ম্যাচে দুর্বল ইকুয়েডরের বিরুদ্ধে ১-১ গোলে ড্র করেই সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছিলো অ্যালিসন বেকার (Alisson Becker), রবার্তো ফার্মিনো (Roberto Firmino)-দের । যদিও সেই ম্যাচে মাঠে নামেননি নেইমার। তবে আজ চিলির বিরুদ্ধে টুর্নামেন্টে নিজেদের প্রথম নকআউট ম্যাচে পূর্ণশক্তির দল নিয়েই খেলতে নেমেছিলো ব্রাজিল। গোলে ফিরলেন বেকারের তুলনায় তিতের প্রথম পছন্দ এডারসন মোরেস। সেন্টার ব্যাকে মিলিতাও-এর (Éder Militão) বদলে প্রথম এগারোতে ঢুকলেন বর্ষীয়ান থিয়াগো সিলভা (Thiago Silva)। মাঝমাঠেও ফেরেন রিয়েল মাদ্রিদ (Real Madrid CF) তারকা ক্যাসেমিরো (Casemiro)। আক্রমণভাগে প্রথম থেকেই শুরু করেন গ্যাব্রিয়েল জেসাস, রিচারলিসনরা (Richarlison)। গত ম্যাচে বিশ্রাম পাওয়ার পর তরতাজা হয়ে মাঠে ফেরেন নেইমারও। অপরদিকে চিলির হয়ে প্রথম এগারোতে ফিরে আসেন ইন্টার মিলানে (Inter Milan) খেলা আলেক্সিস স্যানচেজ (Alexis Sánchez)।
গ্রুপ এ থেকে ৪ ম্যাচে মাত্র ৫ পয়েন্ট পেয়ে চতুর্থ হয়ে কোয়ার্টার ফাইনালে উঠেছিল চিলি। অন্যদিকে গত ১১ ম্যাচে অপরাজিত থাকা ব্রাজিল ম্যাচটা ফেভারিট হিসেবেই শুরু করেছিল। মজার বিষয়, এর আগে কোপায় শেষবার দুই দল একে অপরের মুখোমুখি হয়েছিলো প্রায় ১৪ বছর আগে, ২০০৭ সালে। সেবারও ছিল কোয়ার্টার ফাইনাল। ওই ম্যাচে রবিনহোর (Robinho) জোড়া গোলের সুবাদে চিলিকে ৬-১ গোলে উড়িয়ে দিয়েছিলো ব্রাজিল।
কিন্তু আজকের ম্যাচটা মোটেও সহজ হল না ব্রাজিলিয়ানদের জন্য। বরং দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতেই ৪৯ মিনিটের মাথায় গ্যাব্রিয়েল জেসুস (Gabriel Jesus) ফুটবল ভুলে হঠাৎ কুংফু-ক্যারাটে করে লালকার্ড দেখে টিমকে বিপদের মুখে ঠেলে দিয়েছিলেন। যদিও লালকার্ডটি ছিল অনিচ্ছাকৃত। ফলে ম্যাচের প্রায় অর্ধেকটাই ব্রাজিলকে খেলতে হলো ১০ জনে।
পাঁচজনের ডিফেন্স নিয়ে দল সাজিয়েছিলেন চিলির কোচ মার্টিন লাসার্তে (Martín Lasarte)। প্রথম ২০ মিনিটে ব্রাজিল দাঁত ফোটাতে পারেনি চিলির ডিফেন্সে। বরং ডিফেন্স জমাট রেখে উইং দিয়ে প্রতিআক্রমণে ম্যাচের রাশ নিয়ন্ত্রণ করছিলেন আর্তুরো ভিদালরা। খেলার ২২ মিনিটে প্রথমবার পেনিট্রেট করতে সমর্থ হয় ব্রাজিল। বামপ্রান্ত থেকে নেইমার (Neymar Jr.) বক্সের মধ্যে ঠিকানা লেখা ক্রস রাখেন রবার্তো ফার্মিনোর জন্য। ঠিক করে পা ছোঁয়ালেই গোল হতে পারতো। কিন্তু একা গোলকিপারকে পেয়েও বল জালে ঠেলতে ব্যর্থ হন তিনি। প্রথমার্ধে এটাই ছিল ব্রাজিলের কাছে সেরা সুযোগ।
এছাড়া প্রথমার্ধে ব্রাজিলের আক্রমণ বলতে ৩২ মিনিটে রাইট ব্যাক ড্যানিলোর (Danilo) দূরপাল্লার শট যা ক্রসবার উঁচিয়ে চলে যায়, ৩৭ মিনিটে গ্যাব্রিয়েল জেসাসের একটা নিচু ক্রস, যেটা থেকে নেইমার গোল পেলেও পেতে পারতেন। কিন্তু চিলির তারকা গোলরক্ষক ক্লডিও ব্রাভো (Claudio Bravo) গোলমুখ ছোট করে দেওয়ায় বল গোলে ঢোকেনি। তবে বিরতির ঠিক আগে গোল পাওয়ার ভালো সুযোগ এসেছিলো গ্যাব্রিয়েল জেসাসের সামনে। ৪৩ মিনিটে নেইমার ভালো বল বাড়ান ম্যানচেস্টার সিটির (Manchester City F.C.) ফরোয়ার্ডের জন্য। বাঁপায়ে ভালো শটও নিয়েছিলেন জেসাস। কিন্তু ব্রাভোর হাতের আঙ্গুল ছুঁয়ে বল বেরিয়ে যায় বারের উপর দিয়ে।
বরং প্রথমার্ধে গোল পেতে পারতো চিলিও। ২৭ মিনিটে ফার্মিনো মাঝমাঠে বল রিসিভ করতে গিয়ে জমা দিয়ে দেন চিলির ভারগাসের (Eduardo Vargas) পায়ে। ডানদিক থেকে দৌড়ে কাট করে ভিতরে ঢুকে ভারগাসের নেওয়া গড়ানো শট চমৎকার সেভ দেন এডারসন (Ederson Santana de Moraes)।
দ্বিতীয়ার্ধের প্রথম ৫ মিনিট বেশ ঘটনাবহুল। ম্যাচের সবচেয়ে দুটো গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটলো এই সময়ই। খেলা শুরু হতেই বিরতিতে পরিবর্ত হিসেবে নামা লুকাস প্যাকেতা (Lucas Paquetá) কোচের আস্থার প্রতি পূর্ণ মর্যাদা দিলেন। হয়ে উঠলেন সুপার সাব। নামার দুমিনিটের মাথায়, অর্থাৎ ম্যাচের ৪৭ মিনিটে অসাধারণ টিমগেমের নমুনা রেখে দৃষ্টিনন্দন একটা গোল উপহার দিল ব্রাজিল। বামপ্রান্ত থেকে ওভারল্যাপে উঠে আসা রেনান লোডির (Renan Lodi) থেকে বল পান ক্যাসেমিরো। সেখান থেকে তিনি ওয়ান টাচ খেলেন ডি বক্সে দাঁড়ানো প্যাকেতার সাথে। প্যাকেতার ওয়ানটাচ যায় নেইমারের কাছে। তাঁর সামনে তখন দুজন ডিফেন্ডার থাকলেও ছোট্ট আরেকটা ওয়ানটাচ ব্যাকহিলে আবার বল পেয়ে যান প্যাকেতা। ছোট বক্সের মাথা থেকে সাইড ভলিতে ম্যাচের একমাত্র গোলটি করতে ভুল করেননি তিনি (১–০)।
এরপরেই ম্যাচের সেই কুৎসিত দৃশ্য। খামোকা মাঝমাঠের একটা নির্বিষ বলে চিলির লেফটব্যাক ইউজেনিও মেনা-র (Eugenio Mena) মুখে বুট তুলে লালকার্ড দেখলেন গ্যাব্রিয়েল জেসাস (Gabriel Jesus)। একেবারেই অপ্রয়োজনীয় তো বটেই, সঙ্গে বিপদে ফেলে গেলেন দলকেও। প্রায় পুরো দ্বিতীয়ার্ধটাই দশজনে খেলতে হলো ব্রাজিলকে।
এরপরেই ব্রাজিলের উপর চাপ বাড়াতে থাকে চিলি। ব্রাজিল বক্সের আশেপাশে ফ্রিকিকও আদায় করে। ৫৩ মিনিটে পুলগারের (Erick Pulgar) ফ্রিকিক অল্পের জন্য লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়। ৬২ মিনিটে ব্রাজিলের জালে বল ঢুকিয়েও দেন চিলির ভারগাস। কিন্তু ব্রাজিলের চওড়া কপাল থাকায় গোলের পরে ভার চেকের সময় দেখা যায়, মাত্র ইঞ্চিকয়েকের জন্য অফসাইড ছিলেন ভারগাস (Eduardo Vargas)। বরাতজোরে বেঁচে যায় হলুদ-নীল জার্সিধারীরা।
ম্যাচের শেষ ১৫-২০ মিনিটে চিলি যথেষ্ট চেপে ধরেছিলো ব্রাজিলকে। ৭০ মিনিটে বেন ব্রেরেটনের (Ben Brereton) হেড ব্রাজিলের ক্রসবারে লেগে ফিরে আসে। ৭৮ মিনিটে আর্তুরো ভিদালের (Arturo Vidal) একটা বিষাক্ত শট অসামান্য দক্ষতায় বাঁচান এডারসন। একগোলের লিডের সরু সুতোর উপর ঝুলে থাকা ব্রাজিল ডিফেন্সে তখন ত্রাহি ত্রাহি রব। যদিও শেষ পর্যন্ত ব্রাজিলের গোলমুখ খুলতে পারেনি চিলি, যাঁরা পরপর দুবার ২০১৫ এবং ২০১৬-তে কোপা আমেরিকা চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল, দুবারই আর্জেন্তিনাকে হারিয়ে।
ভারতীয় সময় আগামী মঙ্গলবার ভোরবেলা কোপার প্রথম সেমিফাইনালে পেরুর (Peru national football team) মুখোমুখি হবে ব্রাজিল। অপরদিকে ভারতীয় সময় রবিবার ভোর ৬:৩০টার সময় ইকুয়েডরের (Ecuador national football team) বিরুদ্ধে কোয়ার্টার ফাইনাল খেলতে নামছে আর্জেন্তিনাও (Argentina national football team)।