হিরো আইএসএল ২০২০-২১ এর লীগ পর্যায়ের দুই-তৃতীয়াংশ শেষ। টুর্নামেন্ট পৌঁছে গেছে তার বিজনেস এন্ডে। লীগ টেবিলের চিত্রটাও ধীরে ধীরে অনেকটাই পরিষ্কার হতে শুরু করেছে। আর এখানেই এসসি ইস্টবেঙ্গল সমর্থকদের জন্য লীগের মানচিত্র এখনও পর্যন্ত খুব একটা আশাব্যঞ্জক নয়। এইমুহূর্তে লীগের বর্তমান অবস্থান এরকম:
আইএসএলের প্রথম লেগের এফসি গোয়া বনাম এসসি ইস্টবেঙ্গল ম্যাচে দুরন্ত ফুটবল উপহার দিয়েছিলো দুই দলই। ম্যাচের প্রথমার্ধ যদি এফসি গোয়ার হয়ে থাকে, দ্বিতীয়ার্ধ ছিল দশজনে খেলা এসসি ইস্টবেঙ্গলের। সেইদিন এসসি ইস্টবেঙ্গলের অধিনায়ক ড্যানি ফক্সকে অন্যায় লালকার্ড না দেখলে কে বলতে পারে, পুরো পয়েন্ট নিয়েই হয়তো মাঠ ছাড়তো রবি ফাউলারের ছেলেরা।
সেই ম্যাচ স্মৃতিতে থাকবে আরও একটা কারণে। বাইশ বছর বয়সী নাইজেরীয় স্ট্রাইকার ব্রাইট এনোবাখারের বিশ্বমানের করা গোল। যেই গোল এবছরের একাধিক নেগেটিভের ভিড়ে (রেফারিং, ফ্র্যাঞ্চাইজিদের ব্যবসায়িক ক্ষতি ইত্যাদি) এইমুহূর্তে আইএসএলের সেরা বিজ্ঞাপন।
এবারের একনজরে দেখে নেওয়া যাক দুই যুযুধান টিমের হালহকিকৎ।
এফসি গোয়া:
গতবারের সার্জিও লোবেরার কোচিংয়ে লীগ চ্যাম্পিয়নরা এবারে এখনও লীগ শীর্ষে থাকা মুম্বাই সিটি এফসির চেয়ে দশ পয়েন্টে পিছিয়ে। ফলে বড় অঘটন না ঘটলে লীগ চ্যাম্পিয়নশিপ হাতছাড়াই হতে চলেছে এফসি গোয়ার। এসসি ইস্টবেঙ্গলের বিরুদ্ধে নামার আগে গত ৬ ম্যাচ অপরাজিত থাকা এফসি গোয়ার অবস্থা যথেষ্ট নড়বড়ে। চোট ও কার্ড সমস্যায় গোয়া শিবির যেন মিনি হাসপাতাল। গত ম্যাচে কেরালা ব্লাস্টার্স এফসির বিরুদ্ধে লালকার্ড দেখে নেই স্প্যানিশ ডিফেন্ডার ইভান গঞ্জালেজ। অপর বিদেশী ডিফেন্ডার অস্ট্রেলিয়ান জেমস ডোনাশে-ও চোটে কাবু হয়ে এই ম্যাচে বাইরে। তবে জানুয়ারী ট্রান্সফার উইন্ডোতে হায়দ্রাবাদ এফসি থেকে লোনে এফসি গোয়াতে এসেছেন ভারতীয় জাতীয় দলের ডিফেন্ডার আদিল খান। তবে হায়দ্রাবাদ এফসি-র হয়ে এই মরশুমে এখনও পর্যন্ত ৫টি ম্যাচে মাত্র ৩৪ মিনিট মাঠে নেমেছেন তিনি। ফলে কতটা আত্মবিশ্বাস নিয়ে নতুন টিমের হয়ে মাঠে নামবেন তিনি, সেই নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়।
অর্থাৎ, এসসি ইস্টবেঙ্গলের বিরুদ্ধে দেশীয় ডিফেন্স নিয়েই দল সাজাতে বাধ্য হবেন স্প্যানিশ ম্যানেজার হুয়ান ফেরান্দো। ব্রাইট-মাঘোমারা কি পারবেন এফসি গোয়ার ডিফেন্সের দুর্বলতা কাজে লাগাতে?
তবে ডিফেন্স নড়বড়ে হলেও এফসি গোয়ার মাঝমাঠ এবং আক্রমণভাগ যেকোনও বিপক্ষের কাছেই মাথাব্যথার কারণ। চোটের জন্য নেই জাতীয় দলের মিডফিল্ডার ব্র্যান্ডন ফার্নান্ডেজ এবং তরুণ স্ট্রাইকার ঈশান পন্ডিতা। তারপরেও এফসি গোয়া এই প্রতিযোগিতার অন্যতম শক্তিশালী দল। স্পেনীয় আলবার্তো নগুয়েরা এবং এডু বেডিয়া এফসি গোয়ার মাঝমাঠের চালিকাশক্তি। এছাড়াও লাল-হলুদের বিরুদ্ধে আক্রমণভাগে থাকবেন আরেক স্প্যানিশ জর্জে ওর্টিজ। স্প্যানিশ ত্রিফলাকে আটকানোই প্রধান চ্যালেঞ্জ এসসি ইস্টবেঙ্গলের ডিফেন্স ও মাঝমাঠের কাছে। এছাড়াও দেশীয় জেসুরাজ, রেবেলো, লেনি রডরিগেজ, মুরগাওঁকর-রা যথেষ্ট বেগ দেবেন এসসি ইস্টবেঙ্গলকে।
১২ ম্যাচে ৯ গোল করে এখনও পর্যন্ত সর্বোচ্চ গোলদাতার লড়াইয়ে শীর্ষস্থানে আছেন ৩৭ বছর বয়সী ইগর অ্যাঙ্গুলো। যদিও কোচের সাথে ঝামেলায় গত তিন ম্যাচ ধরে মাঠেই নামছেন না তিনি। এসসি ইস্টবেঙ্গলের বিরুদ্ধেও তাঁর খেলার সম্ভাবনা কম।
এসসি ইস্টবেঙ্গল:
গত ম্যাচে লীগশীর্ষে থাকা এবং তর্কাতীতভাবে এই মরশুমের সবচেয়ে শক্তিশালী টিম মুম্বাই সিটি এফসিকে দ্বিতীয়ার্ধে চেপে ধরেও একগোলে হারতে হয় শতাব্দীপ্রাচীন ক্লাবকে। লাল-হলুদ শিবিরে সুখবর, চেন্নাইন এফসি ম্যাচে লালকার্ড দেখা অজয় ছেত্রী সাসপেনশান কাটিয়ে দলে ফিরছেন। খুব সম্ভবত বেশীরভাগ সমর্থকদের অপছন্দের মিলন সিংয়ের বদলে প্রথম একাদশে ফিরতে পারেন তিনি। তবে এফসি গোয়া ম্যাচে টিমের দেশীয় স্কোয়াডে দু-একটা চমক থাকলেও থাকতে পারে।
এছাড়াও তরুণ গোলরক্ষক শঙ্কর রায়ের বদলে হায়দ্রাবাদ এফসি থেকে লোনে একযুগ পরে লাল হলুদ জার্সি গায়ে চাপানো অভিজ্ঞ গোলরক্ষক সুব্রত পালের জায়গা হতে চলেছে রিজার্ভ বেঞ্চেই। জীবনের সেরা ফর্মে থাকা দেবজিৎ মজুমদারই শুরু করবেন এসসি ইস্টবেঙ্গলের তেকাঠির নিচে।
তবে সত্যি বলতে, এইমুহূর্তে লীগ টেবিলের যা অবস্থা, টিম কম্বিনেশন নিয়ে বেশী কচকচানি না করাই ভালো। ১৩ ম্যাচে ১২ পয়েন্ট পেয়ে এগারো দলের লীগে দশ নম্বরে রয়েছে লিভারপুল কিংবদন্তি রবি ফাউলারের দল। যদি ৩০ পয়েন্টকেও চতুর্থ স্থানের জন্য ম্যাজিক ফিগার হিসেবে ধরা হয়, তাহলেও বাকি আর ৭টা ম্যাচের মধ্যে ৬টা ম্যাচ জিততে হবে এসসি ইস্টবেঙ্গলকে, এবং লীগের শেষ ল্যাপের দৌড়টা শুরু করতে হবে এফসি গোয়ার বিরুদ্ধেই। এরপরেও মাথায় রাখতে হবে গোলপার্থক্যও, যা এইমুহূর্তে -৬। ফলে রীতিমত মিরাকল ঘটাতে হবে লাল হলুদ ব্রিগেডকে। হায়দ্রাবাদ এফসি, নর্থইস্ট ইউনাইটেডরা কিন্তু দ্রুত এগোচ্ছে শেষচারের দিকে।
ব্রিটিশ কোচ রবি ফাউলার এবং তাঁর সহকারী টনি গ্র্যান্ট, রেনেডি সিং-রা গত অনেক ম্যাচেই পয়েন্ট নষ্টের জন্য রেফারিংয়ের সমস্যা, নিম্নমানের দেশীয় ব্রিগেড, প্রি-সিজনের জন্য কোনও সময় না পাওয়া অথবা মাত্র পনেরো দিনের প্র্যাকটিসে মাঠে নেমে পড়া – ইত্যাদি নানান কারণ দেখিয়েছেন। ওনারা কেউ ভুল বা মিথ্যা বলেননি। আর সেইজন্যই ইস্টবেঙ্গল সমর্থককূলের অধিকাংশই তাঁদের অসহায়তা এবং পরিস্থিতির গুরুত্ব বুঝে এতদিন ধৈর্য্যসহকারে সমগ্র কোচিং স্টাফের পাশে দাঁড়িয়েছেন। তবে ১৩ ম্যাচের পরে আর বোধহয় কোনও কারণই যথেষ্ট নয়। টিম গুছিয়ে নেওয়ার পর্যাপ্ত সময় পেয়েছেন টিম ম্যানেজমেন্ট। টিমের শক্তিবৃদ্ধির জন্য জানুয়ারী ট্রান্সফার উইন্ডোও পেয়েছেন।
এবার টিমের পালা সমর্থকদের কিছু ফিরিয়ে দেওয়ার। এসসি ইস্টবেঙ্গলের মতো লক্ষ লক্ষ সমর্থকপুষ্ট ক্লাবে সাফল্যের চাপ থাকবেই। লিভারপুল এফসিতে “ভগবান” আখ্যা পাওয়া রবি ফাউলারের কাছে সেটা নিশ্চয়ই অজানা নয়। যখন সব আশা শেষ বলে মনে হয়, যখন সব বিশেষজ্ঞ বাতিলের খাতায় ফেলে দেয়, ঠিক সেইসময়েই সবরকম প্রতিকূলতাকে জয় করে ফিনিক্স পাখির মতো জেগে ওঠাই তো একশো বছর ধরে ইস্টবেঙ্গলের ইউএসপি। শেষ চারের লীগের পাশা কি ওল্টাতে পারবেন লাল হলুদের খেলোয়াড়রা? এফসি গোয়া ম্যাচ থেকেই কি ঘুরতে শুরু করবে ভাগ্যের চাকা?
চতুর্থ স্থানের লড়াইয়ে থাকা বেশিরভাগ টিমই নিজেদের মধ্যে পয়েন্ট নষ্ট করে এসসি ইস্টবেঙ্গলকে বারংবার লড়াইয়ে ফিরিয়ে আনছে। সাম্প্রতিক অতীতে ভাগ্যলক্ষ্মী কিন্তু এরচেয়ে বেশী খুব একটা সুপ্রসন্ন হননি ইস্টবেঙ্গলের উপর।
আপামর লাল হলুদ সমর্থকদের এখন অপেক্ষা শেষ ল্যাপে এক স্বপ্নের দৌড় শুরু করার।