করোনা পরিস্থিতি না থাকলে ম্যাচটা হতেই পারতো আইএসএলের অন্যতম হাইভোল্টেজ ম্যাচ। সোশ্যাল মিডিয়াতে দুদলের সমর্থকদের উপস্থিতি বাকি দলগুলোর জন্য ঈর্ষণীয়। গ্যালারীতে ইস্টবেঙ্গল সমর্থকদের গগনভেদী চিৎকার তো বিশ্বের সেরা টিমগুলোর শিরদাঁড়াতেও কাঁপুনি ধরিয়ে দেবে। এব্যাপারে পিছিয়ে নেই কেরালা ব্লাস্টার্সের সমর্থকরাও। তবে এই মুহূর্তে দুদলের অবস্থাই করুণ। পাঁচ ম্যাচ হয়ে যাওয়ার পরেও এখনও অব্দি জয়ের মুখ দেখেনি কোনো দলই।
অতএব, আত্মবিশ্বাসে কিছুটা ঘাটতি নিয়েই মাঠে নামবে দুই দল।
৯ বনাম ১১:
তুল্যমূল্য লড়াইয়ের সমস্ত গোলাবারুদই মজুত ছিল ইস্টবেঙ্গল আর কেরালা দুদলের অস্ত্রাগারে। গ্যারি হুপার বনাম জ্যাক মাঘোমা, ভিসেন্তে বনাম পিলকিংটন, রাহুল কেপি বনাম মহঃ রফিক, কোনি বনাম নেভিল, লিংডো বনাম সাহাল – টুকরো টুকরো ডুয়েল আশা করাই যেতো। তার বদলে দুটো টিমই লীগ টেবিলের তলায় ধুঁকছে। চোটে কাহিল ফক্স কবে মাঠে ফিরবেন কেউ জানে না। দ্রুত সুস্থ না হলে তাঁর বদলি হিসেবে ৩৩ বছর বয়সী ব্রিটিশ ফুলব্যাক ক্যালাম উডসের কথা শোনা যাচ্ছে। তবে কিরকম কন্ডিশনে আছেন, সময় বলবে।
কেরালার অবস্থাও শোচনীয়। গত ম্যাচেই বেঙ্গালুরুর কাছে চার গোল খেতে হয়েছে। দুই বিদেশী ডিফেন্ডার নিয়েও পাঁচ ম্যাচে তারাও হজম করেছে দশ গোল। গ্যারি হুপার এখনও অব্দি নিজের নামের প্রতি সুবিচার করেননি। ইস্টবেঙ্গল সমর্থকরা চাইবেন হুপারের অফফর্ম যেন এই ম্যাচেও অব্যাহত থাকে। গত ম্যাচে ফুলব্যাক লালরুয়াথারার পাশ দিয়ে দু গোল খেয়েছে কেরালা ডিফেন্স। রবি ফাউলার, টনি গ্রান্ট, জোসেফ ওয়ামস্লেদের নোটবুকে নিশ্চয়ই উঠেছে এই তথ্য।
চোটের কারণে কেরালা দলের সাহাল আব্দুল সামাদ অনিশ্চিত হলেও ইস্টবেঙ্গল শিবিরে স্বস্তির খবর – কার্ড সমস্যা কাটিয়ে ফিরে আসছেন ইউজেনসেন লিংডো। ফাউলার তাঁকে প্রথম দলে রাখেন কিনা সেটাই দেখার।
স্কট নেভিল:
ফক্সের বদলে নিজের পছন্দের জায়গা রাইট ব্যাক ছেড়ে সেন্ট্রাল ডিফেন্সে খেলতে নামা স্কট নেভিল এই মুহূর্তে ইস্টবেঙ্গল জনতার চোখে ভিলেন। অথচ ২০১৮-১৯ মরসুমে পার্থ গ্লোরি যখন সবচেয়ে কম গোল খেয়ে এ-লীগ প্রিমিয়ারশিপ চ্যাম্পিয়ন হয়, তখন নেভিল ছিলেন সেই দলের অন্যতম নির্ভরযোগ্য ডিফেন্ডার। কলকাতায় খেলে যাওয়া ক্যালাম ফার্গুসন থেকে ইস্টবেঙ্গলের ইতিহাসে অন্যতম সফল কোচ ট্রেভর মর্গ্যান – সকলের মুখেই ছিল নেভিলের ভূয়সী প্রশংসা।
এহেন খেলোয়াড়ের হলোটা কি? গত ম্যাচে ২২ বছর বয়সী ভারতীয় লিস্টন কোলাসো যেভাবে ইনসাইড-আউটসাইড করে মাটি ধরালেন, নেভিলের কেরিয়ারের ভিডিও ক্লিপিংসে ওইটুকু অংশ বাদই রাখতে চাইবেন। সমস্যাটা টেকনিকাল না মানসিক? রবি ফাউলার কিন্তু একবার মনোবিদ নিকোলা ম্যাকক্যালিয়গের সাথে একটা স্কাইপ কলে বসানোর কথা ভাবতেই পারেন।
ভিকুনা বনাম ফাউলার:
কোচ ভিকুনার কাছে এই পরিস্থিতি নতুন নয়। গত বছরও বাগান কোচ হিসেবে কলকাতা লীগ ও ডুরান্ডে ব্যর্থ হওয়ার পর আইলীগের শুরুটাও শোচনীয় হয়েছিল, চার্চিলের কাছে চার গোল খেয়ে। সেখান থেকে শেখ সাহিল, নাওরেমদের মতো জুনিয়রদের ভরসা জুগিয়ে এবং সেকেন্ড ট্রান্সফার উইন্ডোতে পাপা বাবাকর দিওয়ারার মতো স্ট্রাইকার এনে শেষ পর্যন্ত চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলেন। কেরালা ব্লাস্টার্সেও চাইবেন একইরকম ভাবে কামব্যাক করতে।
ফাউলার সপ্তম বিদেশী হিসেবে এইকে এথেন্স থেকে এনেছেন ২২ বছর বয়সী তরুণ নাইজেরিয়ান স্ট্রাইকার ব্রাইট এনোবাখারে-কে। ব্রাইটের ভবিষ্যৎ ইস্টবেঙ্গলে উজ্জ্বল কিনা, তা সময় বলবে। তবে এই মুহূর্তে ফাউলারের ডিফেন্সের যা অবস্থা গড়ের মাঠের মতো, ম্যাচে দু-তিন গোল না দিতে পারলে সমর্থকদের রক্তচাপ বাড়তে বাধ্য।
ইস্টবেঙ্গলের পজিটিভ:
তাহলে কি ইস্টবেঙ্গলে পজিটিভ কিছুই নেই? আলবাত আছে। দেবজিৎ মজুমদার গত কয়েকটা ম্যাচেই আবার সেভজিৎ হয়ে উঠেছেন। ডিফেন্সে ভরসা জোগাচ্ছেন তরুণ ইরশাদ আর অভিজ্ঞ শেহনাজ। গত ম্যাচে জোড়া গোল করে আত্মবিশ্বাসী মাঘোমা-ও। কিন্তু টিম হিসেবে কিছুতেই ক্লিক হচ্ছে না।
টিম যখন আটকে যায়, তখন দরকার পড়ে ব্যক্তিগত নৈপুণ্যের। একটা সোলো টার্ন, গোলার মতো একটা জাল কাঁপানো দূরপাল্লার শট, কোচের একটা বুদ্ধিদীপ্ত পরিবর্তন – যেখানে দশ পনেরো মিনিটের একটা স্পেলে খেলার গতিপথ বদলে যাবে। কিছু বছর আগেও কিন্তু পেন, টোলগে, জুনিয়র, ডগলাস, বাইচুং, টুলুঙ্গা, আলভিটোরা এভাবেই ধুঁকতে থাকা ইস্টবেঙ্গল টিমকে লড়াইয়ে ফিরিয়ে আনতেন। টিম হোটেলে প্রাক্তনদের ছবি টাঙানোর পাশাপাশি শ্রীসিমেন্ট কর্তৃপক্ষ কিন্তু পুরোনো সেই সব ম্যাচের ভিডিওগুলোও ফুটবলারদের আইপ্যাডে তুলে দেওয়ার কথা ভেবে দেখতে পারেন।
সমর্থকদের প্রত্যাশা:
ইস্টবেঙ্গলের বিদেশীদের বায়োডাটা কিন্তু যথেষ্ট চমকপ্রদ। দেশীয় ব্রিগেড একটু দুর্বল, এটা এখন সবাই জানে, এবং এই নিয়েই চলতে হবে। এমতাবস্থায় স্টেইনম্যান, পিলকিংটন, মাঘোমা, নেভিলদের মত হাইপ্রোফাইল বিদেশীরা একটু অতিরিক্ত দায়িত্ব নেবেন, ইস্টবেঙ্গল জনতা কি এটুকু আশা করতে পারেন না? ফাউলার নিজে লিভারপুলে খেলেছেন, উনি ভালো করেই জানেন শতাব্দীপ্রাচীন বড় এবং ঐতিহ্যমন্ডিত ক্লাবে সমর্থকদের প্রত্যাশা থাকবেই। বড় খেলোয়াড়রা এইরকম প্রেশার সিচুয়েশনেই তো নিজেদের সেরা খেলাটা বার করে আনেন।
একটা জয়ই পারে আবেগমথিত সমর্থকদের কটূক্তিগুলোকে প্রশংসায় পরিণত করতে। সাফল্য এলে সমর্থকদের কাঁধে চেপে এয়ারপোর্ট থেকে ফিরবেন, এই গ্যারান্টি দেওয়া যেতেই পারে। তবে আপাতত কিন্তু “সাথে আছি“, “পাশে আছি“, “ভরসা আছে” শব্দবন্ধগুলোকে ছাপিয়ে সমালোচনার সুরগুলো অল্প হলেও মাথাচাড়া দিচ্ছে।
ব্রিটিশ লেজেন্ড কি শুনতে পাচ্ছেন?