ইতিমধ্যেই হিরো আইএসেলের দ্বিতীয় পর্ব শুরু হয়ে গেছে, আর শেষ কয়েকটা ম্যাচের নিরিখে কিন্তু অন্যতম সেরা দল এসসি ইস্টবেঙ্গল। মূলত জানুয়ারিতে সই করানো খেলোয়াড়দের নিয়ে ২০২১ সালে ৪ ম্যাচে ২ টো জয় পাওয়া হয়ে গেছে লাল হলুদ ব্রিগেডের, আর পরিসংখ্যান ঘাটলে এটাও জানা যাচ্ছে যে ফাউলার বাহিনী শেষ ৬ ম্যাচ অপরাজিত, তার মধ্যে ২ বার ৩ পয়েন্ট তুলে এনেছেন তারা, অথচ প্রথম ৫ ম্যাচে মাত্র ১ পয়েন্ট ঝুলিতে ছিল লাল হলুদ বাহিনীর, আর গোলের মুখ দেখতেও ৪ ম্যাচ অপেক্ষা করতে হয় তাদের।
তাহলে এত বড় পরিবর্তনের কারণ কি? আপাতদৃষ্টিতে দেখে অনেক কারণই মনে হচ্ছে, কিছুটা কোচিং স্টাফের দৃঢ় সংকল্প, বিদেশিদের ফর্মে ফিরে আসা, ভারতীয়দের ফিটনেস লেভেলে উন্নতি, ইত্যাদি। তবে সবচেয়ে বড় কারণ কিন্তু জানুয়ারিতে দলের ফাঁক ফোকর গুলো ঢাকার জন্যে সঠিক খেলোয়াড় সই করানো। হ্যাঁ, একটু ভেবে দেখলেই বোঝা যাচ্ছে লীগের ১১টি দলের মধ্যে এই ট্রান্সফার উইন্ডোতে সবথেকে সক্রিয় দেখিয়েছে ইস্টবেঙ্গলকেই, আর এর যতটা ক্রেডিট যায় ফাউলার সাহেবের ম্যানেজমেন্টের, ঠিক ততটাই যাওয়া উচিত শ্রী সিমেন্ট কর্তৃপক্ষের। আর এই জানুয়ারি উইন্ডোতে সই করা কোন খেলোয়াড় কতটা ভালো পারফর্ম করছে, একটু সংক্ষেপে দেখে নেওয়া যাক।
১. রাজু গাইকোয়াড়:
প্রাক্তন ইস্টবেঙ্গল তারকাকে সই করানোর সময় সমর্থকরা দুভাগে ভাগ হয়েছিলেন। এক দলের কথা ছিল ডিফেন্সের যা হতশ্রী চেহারা তাতে রাজুর মতো একজন অভিজ্ঞ ভারতীয় ডিফেন্ডারের যোগ দেওয়া অবশ্যই জরুরি, অপর দিকে অন্যদের ধারণা ছিল গত ১-২ বছর অফফর্মে থাকা রাজু কে সই করানো বোকামি ছাড়া আর কিছুই নয়। সত্যি তো, কেরালার হয়ে খেলার সময় নিজের ফর্মের জন্যে প্রথম এগারো থেকে বাদ পড়েন রাজু, পরের দিকে কার্যত বাতিলের খাতায় ফেলে দেওয়া হয় তাকে।
তবে রাজুর ভাগ্যের চাকা এখন ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে গেছে। এখন তিনি কোচ রবি ফাউলারের অন্যতম ভরসা হয়ে উঠেছেন, এমনকি তাকে ছাড়া ইস্টবেঙ্গলের ডিফেন্সের বেহাল চেহারা কাল কেরালা ম্যাচেই দেখা গেছে। বাঁদিকে ফক্স ও ডান দিকে নেভিলের সাথে ভালো বোঝাপড়া গড়ে নিয়েছেন তিনি, আর এই যুক্তিটির পুষ্টি করার জন্যে বেঙ্গালুরুর ম্যাচই যথেষ্ট। সুনীল ছেত্রী, উদান্তা সিং ও ক্লেইটন সিলভাদের আক্রমণকে কার্যত ভোঁতা করে ছেড়েছিলো ইস্টবেঙ্গলের ডিফেন্স, বিশেষত ক্লেইটনকে অসম্ভব ভালো মার্ক করেছিলেন রাজু।
রাজুর অন্যতম বড় অস্ত্র “লং থ্রো”। বিপক্ষের বক্সের আশেপাশে থ্রো পেলে রাজুর বিষাক্ত থ্রো সোজা বক্সের ভেতরে গিয়ে পড়ে যেটা একটা কর্নারের থেকে কোনো অংশে কম নয়। সঠিক ভাবে সদ্ব্যবহার করতে পারলে খুবই সহজে একটা গোলস্কোরিং সুযোগ তৈরি হয়ে যায় ঠিক যেভাবে পিলকিংটন ওড়িশার বিরুদ্ধে প্রথম গোলটা করেছিলেন রাজুর থ্রো থেকে, এমনকি গোয়ার বিরুদ্ধেও ফক্স এরকমই একটি সুযোগ হাতছাড়া করেন যেখানে আবারও একটি অসাধারণ থ্রো বক্সের মধ্যে করেছিলেন রাজু।
আমাদের দিক থেকে রেটিং- ৮/১০
২. অঙ্কিত মুখার্জি:
ইস্টবেঙ্গল একাডেমি থেকে গ্রাজুয়েট হওয়া অঙ্কিত ২০১৮ সালে এটিকে দলে সই করেন। প্রথম মরসুমে ১০ ম্যাচ খেলে ১ গোল করার পর আর সেভাবে সুযোগ পাননি তিনি, আর এই বছর জানুয়ারিতে নিজের ছেলেবেলার ক্লাব ইস্টবেঙ্গলে ফিরে আসেন। মূলত সাইড ব্যাকের সমস্যা মেটাতে দলে আনা হয় অঙ্কিতকে।
প্রথম ম্যাচে ওড়িশার বিরুদ্ধে বিরতির পর নামেন তিনি, আর রাইট ব্যাক হিসাবে খেলা শুরু করেন। তবে তখন ম্যাচে ওড়িশার আধিপত্য চলছিল যার সামনে ইস্টবেঙ্গলের কোনো প্রতিরোধই কাজ করছিল না। এমন সময় ডান প্রান্ত দিয়ে দুবার বল নিয়ে বিপক্ষের বক্সে ছুট মারেন অঙ্কিত, আর সেখান থেকেই খেলাটা আবার ইস্টবেঙ্গলের নাগালে আসে। সেই দুবারই ফাইনাল টাচের অভাবে আক্রমণ ভেস্তে যায়, তবে এর পর থেকে ব্রাইট এর সাথে বোঝাপড়া বাড়িয়ে খেলায় ইস্টবেঙ্গলের আধিপত্য তৈরি করতে বিশেষ ভূমিকা নেন অঙ্কিত।
এছাড়াও বেঙ্গালুরুর বিরুদ্ধে উইং ব্যাক হিসেবে খেলেও নজর করেন এই বঙ্গসন্তান। ডান প্রান্ত থেকে অনবরত আক্রমণে সক্রিয় ভাগ নিয়েছিলেন তিনি আর গোলটির ক্ষেত্রে প্রথম মাইনাসটিও অঙ্কিতের পা থেকেই বেরোয়। তবে আশ্চর্যজনক ভাবে ভারতের সেরা খেলোয়াড় সুনীল ছেত্রীকে গোটা ম্যাচে শান্ত রাখেন অঙ্কিত, যা থেকে প্রমান হয় আক্রমণের সাথে রক্ষণ ভাগেও যথেষ্ট পারদর্শী তিনি।
আমাদের দিক থেকে রেটিং- ৭/১০
৩. ব্রাইট এনোবাখারে:
২২-বছর বয়সী নাইজেরিয়ান ব্রাইটের আগমনে ইস্টবেঙ্গলের ভাগ্যও যেনো আরো “উজ্জ্বল” হয়ে গেছে। সমর্থকদের প্রিয় উজ্জ্বলদা ৪ ম্যাচ খেলে নিজের ঝুলিতে ২ টো গোল আর একটি আসিস্ট ঢুকিয়ে নিয়েছেন। কম বয়সী খেলোয়াড়দের যে কেরম ফিটনেস হওয়া উচিত ব্রাইটকে দেখলেই বোঝা যায়।
ওড়িশার বিরুদ্ধে “ডেবিউ” করা ম্যাচে একার হাতে ম্যাচের রাশ টানলেন তিনি, যখন ওড়িশা ভয়ঙ্কর ভাবে ইস্টবেঙ্গলের অর্ধে জাঁকিয়ে বসেছিলো। ডিপ লায়িং মিডফিল্ডার মতো ডিফেন্স থেকে বল নিয়ে নিজেই একার কৃতিত্বে বিপক্ষের বক্সের কাছে চলে যেতে সক্ষম তিনি। মূলত স্ট্রাইকারের অভাবে দলে আনা হলেও ব্রাইট ইস্টবেঙ্গলের কাছে তাদের “মেসির” থেকে কম কিছুনা।
এই তুলনাটা আনার কারণও আছে। ব্রাইট যে প্রথম গোলটা পেলেন, সেটা একটা নাম্বার ৯ নয়, বরং একটা নাম্বার ১০ এর মত খেলে পেলেন। হারমানকে জায়গা দিয়ে তার পেছন থেকে কখন যে বক্সে ঢুকে গেছিলেন তিনি, ওড়িশার ডিফেন্ডাররা তা কোনো ভাবেই টের পেলোনা, আর মার্কিং না থাকার জন্যে সহজেই গোল করে বেরিয়ে গেলেন তিনি। গোয়ার বিরুদ্ধে মাঝমাঠের একটু দূর থেকে বল নিয়ে সাপের মতো এঁকেবেঁকে ৪-৫ জনকে কাটিয়ে বিশ্বমানের যে গোলটা করলেন সেরকম গোল মেসিও বার্সেলোনার হয়ে অনেকবার করেছেন। আবার বেঙ্গালুরুর বিরুদ্ধে যেভাবে মাঝমাঠ এবং আক্রমণ ভাগকে একই সাথে সাহায্য করলেন সেটাও কিন্তু একজন ক্লাসিক নাম্বার ১০ এর কাজ। গোলের সময় অঙ্কিতকে দেওয়া ডায়াগোনাল পাসটা ব্রাইটের জাত চেনানোর জন্যে যথেষ্ঠ। এবার হয়তো বুঝলেন ইস্টবেঙ্গলের ব্রাইট আর বার্সেলোনার মেসির মধ্যে এত মিল কোথায়।
আমাদের দিক থেকে রেটিং- ৯/১০
৪. অজয় ছেত্রী:
ইতিমধ্যেই সমর্থকদের তোপের নিশানা হয়ে গেছেন মিলান সিং, আর হবেননাই বা কেনো! পরপর এত ম্যাচে এক বারের জন্য হলেও তিনি নজর কাড়তে ব্যর্থ। উল্টে তারই দোষে কয়েকবার কার্যত গোল হজম করতে হতো লাল হলুদ ব্রিগেডকে। আর এই জায়গাতেই অজয় ছেত্রী ফাউলারের তুরুপের তাস। অন্তত নিজের প্রথম ম্যাচে যা খেল দেখালেন ২১ বছরের অজয় তাতে তিনি যে নিজের নাম প্রথম একাদশে পাকা করে ফেলেছেন তা আর আলাদা করে বলতে হবেনা।
কেরালার বিরুদ্ধে দ্বিতীয়ার্ধে নামার পর কার্যত একার হাতে ডিফেন্স আর মাঝমাঠের মধ্যে যোগাযোগ রাখলেন অজয়। এই কারণেই মাত্তি স্টেইনম্যান (পরে পিলকিংটন) আরো উপরে উঠে খেলতে পারছিলেন। মাঠে নেমে প্রথম দু-একটা টাচ ঠিক মতো না হলেও তার পর আর একটাও ভুল চোখে পড়েনি অজয়ের। যেরকম রিসিভিং, সেরকম পাসিং। নিখুঁত ভাবে কয়েকবার দুটো উইংয়ে লং বল বাড়াতেও দেখা গিয়েছিল তাকে।
তবে অজয়ের ক্ষেত্রে সব থেকে ভালো মুহূর্ত আসে ম্যাচের ৮৫ মিনিটের মাথায়। বক্সে নিখুঁত একটা ভাসানো বল বাড়ান তিনি, যাতে আমাদী হলোয়ে মাথা ছোঁয়াতে পারলেই আসিস্টের খাতায় নাম চলে যেতো তার। কিন্তু মাথার বদলে পা লাগাতে গিয়েই সুবর্ণ সুযোগ হাতছাড়া করেন আমাদী। ফলস্বরূপ ইস্টবেঙ্গলের সমতা ফেরাতে আরো ১০ মিনিট লেগে যায়। তবে অজয়ের যোগ দেওয়ার পর ইস্টবেঙ্গলের মাঝমাঠ আরো শক্তপোক্ত হয়েছে এতে কোনো সন্দেহ নেই। আশা রাখা যায় নিকট ভবিষ্যতে অজয় তথা পুরো ইস্টবেঙ্গল দলের জন্যেই ভালো সময় অপেক্ষা করছে।
আমাদের দিক থেকে রেটিং- ৮/১০