ওয়েম্বলি (Wembley) স্টেডিয়ামে ইংল্যান্ডের ৩০০তম আন্তর্জাতিক ম্যাচ। জার্মানির বিরুদ্ধে ইউরো ২০২০-এর (EURO 2020) প্রি-কোয়ার্টার ফাইনাল। সপরিবারে উপস্থিত ছিলেন প্রিন্স উইলিয়াম্ (Prince William)। ছিলেন ডেভিড বেকহ্যাম (David Beckham) এবং ‘পারফেক্ট’ খ্যাত গায়ক এড শীরান (Ed Sheeran)-ও। আর ছিল প্রায় হাজার চল্লিশ ব্রিটিশ সমর্থক। গ্যারেথ সাউথগেটের (Gareth Southgate) ছেলেরা তাঁদের নিরাশ করেন নি।
ডাই ম্যানশ্যাফ্টের (Die Mannschaft) হয়ে লেরয় সানে (Leroy Sané), গন্যাব্রি (Serge Gnabry) আর গুন্দোয়ানের (İlkay Gündoğan) জায়গায় শুরু করেন টমাস মুলার (Thomas Muller), টিমো ওয়ার্নার (Timo Werner) এবং গোরেৎজকা (Leon Goretzka)। গুন্দোয়ানের হালকা চোট থাকায় তাকে নামানোর ঝুঁকি নেন নি জোয়াকিম লো (Joachim Low)। গোরেৎজকা পেলেন হাঙ্গেরির বিরুদ্ধে তাঁর বহুমূল্য সমতা ফেরানোর গোলের পুরস্কার। গন্যাব্রি কিছুতেই তাঁর ক্লাবের হয়ে ফর্মের ধরে-কাছে পৌঁছতে পারেননি এই ইউরোতে। যদিও চেলসির (Chelsea F.C.) হয়ে খেলা কাই হ্যাভর্ৎজ (Kai Havertz) এবং ওয়ার্নারের খেলা ব্রিটিশ রক্ষণের কাছে মোটেই অপরিচিত নয়। থ্রি লায়ন্সদের (The Three Lions) হয়ে জ্যাক গ্রিলিশের (Jack Grealish) জায়গায় শুরু করেন ত্রিপিয়ের (Kieran Trippier)। দুই কোচ-ই মূলত ৪-৩-৩ ছকে দল সাজান।
প্রথম দশ মিনিট জার্মানির দাপট থাকে খেলায়। জোশুয়া কিমিচ (Joshua Kimmich), গিন্টার (Matthias Ginter) এবং গোজেন্সের (Robin Gosens) উপর ভরসা করে উইং ধরে আক্রমণ তোলে জার্মানি। কিন্তু এরপর থেকেই ব্রিটিশ রক্ষণ, বিশেষ করে দুই সাইডব্যাক তাঁদের ডানা ছেঁটে দেয়। জার্মান আক্রমণের সরবরাহ বিভাগ ছিল চূড়ান্ত নিষ্প্রভ। প্রথম হাফে বলার মতন ঘটনা বেশ কম।
প্রথম দশ মিনিটের পর থেকে রাইস (Declan Rice) এবং ফিলিপ্স (Kalvin Phillips) জার্মানদের মাঠের মাঝখানে একেবারেই জায়গা দেয়নি। প্রথমার্ধে সুযোগ বলতে রাহীম স্টার্লিংয়ের (Raheem Sterling) বাঁকানো শট শরীর ছুড়ে বাঁচান ম্যানুয়েল ন্য়য়ার (Manuel Neuer) এবং ওয়ার্নারের নীচু শট পা দিয়ে প্রতিহত করেন পিকফোর্ড (Jordan Pickford)। এছাড়া কিমিচের বিপজ্জনক ক্রসে পৌঁছতে ব্যার্থ হন গোজেন্স।
যদিও সবচেয়ে সহজ সুযোগ আসে প্রথমার্ধে মূলত সান্ধ্যভ্রমণ করতে থাকা ব্রিটিশ অধিনায়কের কাছে। মুলারের দুর্বল ব্যাকপাস্ থেকে গোলের খুব কাছে পৌঁছে যান হ্যারি কেন (Harry Kane)। তাঁর প্রথম টাচে ন্য়য়ার পরাস্ত হলেও বল নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়, এবং কোনোক্রমে বিপন্মুক্ত করেন ম্যাট হামেলস (Mats Hummels)। পড়ে পাওয়া চোদ্দ আনা হেলায় হারায় ইংল্যান্ড। উনিশ বর্ষীয় আর্সেনাল একাডেমির ছাত্র বুকায়ও সাকা (Bukayo Saka), জার্মান রক্ষণকে বাঁ দিক থেকে নিয়ন্ত্র বেগ দিয়ে গিয়েছেন।
দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতেই হ্যাভর্ৎজের ভলি অসাধারণ ক্ষিপ্রতার সাথে বাঁচান এভারটনের (Everton FC) হয়ে খেলা গোলরক্ষক। এরপরেই আবার আক্রমণের খিদে হারিয়ে ফেলে জার্মানরা। লোর পরিকল্পনা ছিল অদ্ভুত। জার্মানির মন্থর গতির আক্রমণ এই ম্যাচেও প্রকট ছিল। প্রথম হাফের অতিরিক্ত সময়ে ফিরতি আক্রমণে পেনাল্টি বক্সে বল নিয়ে যাওয়ার বদলে বক্সের সামনে স্কোয়ার পাস্ খেলে রেফারির বাঁশির অপেক্ষা করা রীতিমতো দৃষ্টিকটু। তাঁদের ম্যাচ জেতার মূল সমীকরণ কাজ করছে না দেখেও, বিরতির পর তারা খেলায় বৈচিত্র্য আনার চেষ্টা করেনি। শুধু নিজেদের অর্ধে নিজেদের মধ্যে স্কোয়ার এবং ব্যাকপাস খেলে গেছে। সামনের দিকে বল বাড়াবার খুব একটা আগ্রহ ছিল না। এতে ইংরেজ মিডফিল্ড এবং রক্ষণভাগ অনেক স্বস্তিতে থাকে। রক্ষণে ঠায় দাঁড়িয়ে ছিল স্টোন্স (John Stones) এবং ওয়াকার (Kyle Walker)। ক্রমশ কেন, স্টার্লিংয়ের সাথে শ’ (Luke Shaw), ত্রিপিয়ের এবং গ্রিলিশদের মধ্যে দূরত্ব কমতে থাকে।
জার্মান অর্ধে এই অতিরিক্ত জায়গাটা কাজে লাগিয়েই স্টার্লিং ইংল্যান্ডের হয়ে প্রথম গোল করেন ৭৫ মিনিটে। গ্রিলিশ নামার পরেই ব্রিটিশ আক্রমণে ধার বাড়তে থাকে। স্টার্লিংয়ের দুর্দান্ত দৌড়ের থেকে বল পেয়ে জার্মান বক্সের ডান দিক থেকে নিখুঁত ভাবে গ্রিলিশ তা ফিরিয়ে দেন স্টার্লিংয়ের পায়ে গোল বক্সের ভিতর (১-০)। শেষ ২০ ম্যাচে ১৫ গোল করে ‘ষ্টার’ স্টার্লিং স্বপ্ন দেখাচ্ছেন ইংল্যান্ডকে।
যদিও গোলের ছয় মিনিটের মাথায় নায়ক থেকে খলনায়ক হতে বসেছিলেন স্টার্লিং। ম্যাগুইরের (Harry Maguire) উদ্দেশ্যে তার ভয়াবহ ব্যাকপাস হ্যাভর্ৎজ হয়ে পৌঁছয় মুলারের কাছে। কিন্তু ২০১০ ফিফা বিশ্বকাপের ‘গোল্ডেন বুট’ এবং চার বছর পরে ‘সিলভার বুট’ বিজেতা এক গোলকীপারকে সামনে পেয়েও বল মারলেন বাইরে। দ্বিতীয়ার্ধে ম্রিয়মান সাকাকে তুলে গ্রিলিশকে নামানোর পরিকল্পনা চূড়ান্ত সফল। ছিয়াশি মিনিটে এস্টন ভিলার (Aston Villa) উইঙ্গার প্রথম গোলের মতোই নির্ভুল ক্রস রাখেন জার্মান গোলকীপার এবং ডিফেন্সের নাগাল এড়িয়ে হ্যারি কেনের মাথায়, ‘উৎসবের আলো’ জ্বললো ওয়েম্বলিতে (২-০)।
১৯৬৬ সালের পরে এই প্রথম ইংল্যান্ড জার্মানিকে (Germany national football team) কোনো বড়ো টুর্নামেন্টে হারালো। ইংল্যান্ডের (England national football team) জার্সি গায়ে ৫৭টি ম্যাচ খেলা সাউথগেট আজ জাতীয় দলের ম্যানেজার হিসেবে আটান্নতম ম্যাচটি খেললেন। ইংল্যান্ড যে দুর্দান্ত ফুটবল খেলেছে তা নয়। তবে, কৌশলগত ভাবে জার্মানদের পর্যুদস্ত করলেন তিনি। জার্মানির ধীরস্থির আক্রমণে মেসুট ওজিল (Mesut Özil) বা মাইকেল বালকের (Michael Ballack) মতন কেউ না থাকায় বলের উপর দখল থাকলেও ডিফেন্স চেরা পাস বেরোয়না। ক্রুস তাঁর নিজের সুসময়ের ছায়ামাত্র। বাকি জার্মানদের গোল খাবার পর ঘুম ভাঙলেও শুধুমাত্র হ্যাভর্ৎজ গোটা ম্যাচ জুড়েই চেষ্টা করে গেছেন বিপক্ষ রক্ষণে হানা দেবার। ১৯৭টি ম্যাচ, পনেরো বছর জার্মান জাতীয় দলের কোচ থাকার পর জোয়াকিম লো তাঁর ব্যাটন তুলে দিচ্ছেন তাঁর এক সময়ের সহকারী বায়ার্ন মিউনিখের (Bayern Munich) সদ্য প্রাক্তন ম্যানেজার হ্যান্সি ফ্লিকের (Hansi Flick) হাতে।
পঁচিশ বছর আগের ইউরোর সেমিফাইনালে টাইব্রেকার মিস করে জার্মানির কাছে হারে যে ক্ষত তৈরী হয়েছিল সাউথগেটের বুকে তাতে এতদিনে প্রলেপ পড়লো।
গ্রুপ-এফ ‘গ্রুপ অফ ডেথ’ প্রমাণিত হলো গ্রুপ লিগের ম্যাচগুলি শেষ হতেই। ২০১৬ ইউরোপ জয়ী এবং ২০১৮ বিশ্বসেরাদের পর নক্ষত্র পতন শেষ হলো ২০১৪ বিশ্বজয়ীদের বিদায়ের সাথে।