আবার একটি মাইলফলক ছুঁলো ইউরো ২০২০, যখন এই টুর্নামেন্টের ইতিহাসে প্রথম বার কোনও দল নিজেদের প্রথম দুটো ম্যাচ হারার পরেও নকআউট রাউন্ডে পৌঁছলো। আর সেই দলের নাম ডেনমার্ক (Denmark national football team), সেই ডেনমার্ক যাদের প্রথম ম্যাচ চলাকালীন কার্ডিয়াক অ্যারেস্টে আক্রান্ত হয়ে মাঠে লুটিয়ে পড়েন তাদের মাঝমাঠের হার্টথ্রব ক্রিশ্চিয়ান এরিকসেন (Christian Eriksen)। পরবর্তী কালে তিনি গোটা টুর্নামেন্ট থেকেই ছিটকে যান, তবে এই দুঃস্বপ্নের রাত কাটিয়ে যে ডেনমার্ক পরবর্তী রাউন্ডে উত্তীর্ণ হলো সেটা কোনো রূপকথার থেকে কম কিছু না।
গ্রুপ বি-র শেষ ম্যাচ ডে তে বেলজিয়ামের (Belgium national football team) বিপক্ষে ফিনল্যান্ডের (Finland national football team) দরকার ছিলো মাত্র এক পয়েন্ট, যাতে তাদের জন্যে নকআউটের দরজা খুলে যায়। অপর দিকে ডেনমার্ককে অন্তত ২ গোলের ব্যবধানে রাশিয়াকে (Russia national football team) হারাতে হতো, সেই রাশিয়া যারা বিশ্বকাপে স্পেনকে (Spain national football team) ছিটকে দিয়ে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলো, সঙ্গে ফিনল্যান্ডকেও হারতে হতো। কিন্তু এটাই তো ফুটবলের সৌন্দর্য, ঠিক এই কারণেই ফুটবল বিশ্বের শ্রেষ্ঠ খেলা। ৯০ মিনিট পরে ফিনল্যান্ডের ভাগ্য ঝুলেই রইলো, আর কোপেনহেগেনে (Copenhagen) রূপকথার রাত তৈরি করলো ড্যানিশরা।
প্রথম মিনিট থেকেই গোল তোলার লক্ষ্য নিয়ে আক্রমণাত্মক মেজাজে খেলতে থাকে ডেনমার্ক কিন্তু রাশিয়ার ডিফেন্স ছিলো নাছোড়বান্দা। আক্রমণ করার সময় শুধু সাইমন কাহের (Simon Kjær) এবং ভেস্টেগার্ড (Jannik Vestergaard) নিজেদের অর্ধে থাকছিলেন, বাকি গোটা দল খেলছিল রাশিয়ার বক্সের আশেপাশে। তবে ডেনমার্কের এই “আল্ট্রা অ্যাটাকিং” মনোভাবের খেসারত দিতে হতে পারতো তাদের, যখন ১৮ মিনিটের মাথায় গোলোভিনের (Aleksandr Golovin) শট অনবদ্য রিফ্লেক্সে বাঁচান ক্যাসপার স্মাইকেল (Kasper Schmeichel)। এরপর আর সেরম ঝাঁঝ দেখা যায়নি রাশিয়ার আক্রমণে, তবে ডেনমার্কের খেলা এবং তাদের প্রতিটি খেলোয়াড়ের ওয়ার্করেট দেখে মুগ্ধ হয়ে যায় সমর্থকেরা। ৩৮ মিনিটে ডেনমার্ককে এগিয়ে দেন দামসগার্ড (Mikkel Damsgaard)। পুলসেনের পাস ধরে বক্সের বাইরে থেকে চোখধাঁধানো বাঁকানো শটে গোল করেন তিনি (১-০)।
দ্বিতীয়ার্ধে ডেনমার্কের মূল লক্ষ্য ছিল গোলের ব্যবধান বাড়ানোর, তাই তারা একই মেজাজে খেলা শুরু করে। স্টেডিয়ামের মেজাজও ছিলো অতুলনীয়, তাই রাশিয়ার ওপর বেশ খানিকটাই চাপ সৃষ্টি হয়। এই চাপের ফলেই ভুল করে বসেন তাদের ডিফেন্ডার কুজাইভ (Daler Kuzyayev)। গোলকিপারকে ব্যাকপাস দিতে গিয়ে তিনি পাসটা দিয়ে ফেলেন পুলসেনকে (Yussuf Poulsen), এবং গোলকিপারকে একা পেয়ে গোল করতে ব্যর্থ হননি তিনি (২-০)।
তবে ডেনমার্কের এই একার শাসন রোধ করার জন্যে মাঠে নামেন মাক্সিন মুখিন (Maksim Mukhin), এবং তার ৩ মিনিট পরেই পেনাল্টি পায় রাশিয়া, যার পিছনে যথেষ্ট কৃতিত্ব আছে এই নতুন মাঠে নামা মুখিনের। পেনাল্টি থেকে ব্যবধান কমান রাশিয়ার ক্যাপ্টেন জুবা (২-১)। সেই ৭০ মিনিটের মাথায় খেলায় প্রথম বারের জন্যে নিস্তব্ধ হয়ে যায় কোপেনহেগেনের পার্কিন স্টেডিয়াম (Parken Stadium)।
কিন্ত এই ম্যাচে তো ডেনমার্কের খেলোয়াড়রা শুধু নিজেদের জন্যে খেলছিলেন না, তাঁরা খেলছিলেন তাঁদের প্রিয় এরিকসেনের জন্যেও। তাই বোধয় গোল খাওয়ার পরেও মনোবল ভাঙেনি তাদের, উল্টে দামসগার্ডের বদলে নোরগার্ড (Christian Nørgaard) নামার পর মাঝমাঠের কার্যত পুরো দখল নিয়ে নেয় তারা, এবং তার সুফলও মেলে খুব তাড়াতাড়ি। ৭৭ মিনিটে ৩০-৩৫ গজ দূর থেকে নেওয়া শটে জাল কাঁপিয়ে যান আন্দ্রেস ক্রিসচেনসেন (৩-১)। গোল করে ক্যামেরার সামনে গিয়ে সেটা তিনি উৎসর্গ করেন সেই এরিকসেনকে।
৮২ মিনিটে আবার একবার জ্বলে ওঠেন পার্কিন স্টেডিয়ামে খেলা দেখতে আসা সমর্থকেরা। এর পর যখন ব্যবধান কমানোর জন্যে আক্রমণ বাড়াতে থাকে রাশিয়া, ঠিক সেই ফাঁকেই কাউন্টার অ্যাটাকে ডেনমার্ক চতুর্থ গোল করে (৪-১), এবার স্কোরশীটে নাম তোলেন মাহলে (Joakim Mæhle)।
এই জয়ের সুবাদে গ্রুপে দ্বিতীয় পজিশনে উঠে আসলো ডেনমার্ক, এবং ২০০৪ এর পর প্রথম বার ইউরোর নকআউট পর্যায়ে উঠলো তারা। শেষ ষোলোয় তাদের প্রতিপক্ষ ওয়েলস (Wales national football team), তাই বলাই যায় শেষ আটে ওঠার রাস্তাটা অতটাও কঠিন নয় তাদের জন্যে। অপর দিকে রাশিয়া ছিটকে গেলো ইউরো থেকে।