ঐতিহ্যশালী ওয়েম্বলিতে (Wembley Stadium) ইউরো ২০২০-র (UEFA EURO 2020) সেমিফাইনালে মুখোমুখি হয়েছিল ইউরোপের দুই বড় শক্তি স্পেন এবং ইতালি। ৪ বার বিশ্ব কাপ বিজেতা ইতালি এর আগে কিন্তু একবার মাত্র ইউরো জিতেছে। সেই দিক থেকে স্পেন ৩টে ইউরো জয়ী এবং ইউরোতে ইতালির থেকে বেশি সফল দল। ২০০৮ আর ২০১২-তে পর পর দুবার জেতার পর গত ইউরোতে এই আজুরিদের (Azzurri ) কাছেই ২-০ হেরে পর পর ৩ বার ইউরো জয়ের আশা শেষ হয়েছিলো স্পেনের । এই প্রতিযোগিতায় খেলার বিচারে ইতালি খানিকটা নিঃসন্দেহে এগিয়ে থেকেই আজ খেলতে নেমেছিল। যদিও সারা খেলায় এগিয়ে ছিলো স্পেন। অবশেষে স্পেনের একাধিক সুযোগ নষ্টের ফলস্বরূপ টাইব্রেকারে ৪-২ গোলে জিতে ফাইনালে গেল ইতালি।
৩২ ম্যাচে অপরাজিত ইতালি বাধ্য হয়ে একটাই পরিবর্তন করেছিল। চোট পাওয়া স্পিনাজ্জোলার (Leonardo Spinazzola) জায়গায় শুরু করেন এমারসন (Emerson Palmieri)। অপরদিকে স্পেন দলে শুরু করেন গত দুই খেলায় পরিবর্ত নেমে ভালো খেলা ওলমো (Dani Olmo) আর ওয়ারজাবাল (Mikel Oyarzabal)। চমক দিয়ে দলে ছিলেন না মোরাতা (Álvaro Morata)।
খানিকটা অবাক করে শুরু থেকেই দাপিয়ে খেললো স্পেন। মাঝমাঠে পেড্রি (Pedri) ,বুসকেটেরা (Sergio Busquets) সেভাবে খেলতেই দিলেননা জর্গিনহো (Jorginho), ভেরাট্টিদের (Marco Verratti)। বিশেষ করে বার্সেলোনার ১৮ বছরের তরুণ খেলোয়াড় পেড্রির ছোটো ছোটো বুদ্ধিদীপ্ত টাচ আর পাস মাঝমাঠে বারবার চোখে পড়ছিলো।
১২ মিনিটেই পেড্রির ডিফেন্স চেরা পাসটি ফাঁকায় পেয়েও বলটাই ধরতে পারেননি ওয়ারজাবল। নাহলে সামনে একা থাকা গোলকিপারকে কঠিন পরীক্ষায় পড়তে হতো। অবশ্য ২৪ মিনিটেই পরীক্ষায় পড়েন ইতালির গোলকীপার জিয়ানলুইগি ডোনারুমা (Gianluigi Donnarumma)। ওয়ারজাবলের ডান দিক থেকে বাড়ানো বল থেকে অলমোর শট খুব কাছ থেকে বাঁচিয়ে স্পেনকে এগিয়ে যেতে দেননি তিনি। বাঁদিক থেকে বার বার নজর কাড়ছিলেন তোরেস (Ferran Torres) আর রক্ষণ থেকে ওপরে উঠে আসা আলবা (Jordi Alba)।
খালি একজন প্রকৃত স্ট্রাইকারের অভাবে গোল করে এগিয়ে যেতে পারেনি স্পেন। মোরাতার পরিবর্তে প্রথম একাদশে শুরু করা ওয়ারজাবল (Mikel Oyarzabal) বা ডান প্রান্তে শুরু করা ওলমোকে (Dani Olmo) গোলের সামনে একেবারেই স্বচ্ছন্দ লাগেনি। ওয়ারজাবল স্ট্রাইকারে শুরু করলেও খেলার মাঝে দেখা গেলো তিনি ডান প্রান্তে চলে গেলেন আর ওলমো চলে আসেন মাঝখানে। এক্ষেত্রে বলতেই হয় ওলমো কিন্তু মূলত ডান প্রান্তিক খেলোয়াড়। তাই বল পায়ে বার বার বিপজ্জনক লাগলেও গোল করার ক্ষেত্রে নৈপুণ্য না থাকাটা স্বাভাবিক।
এই প্রথমবার প্রতিযোগিতায় ইতালি দলকে এতটা সাধারণ লাগলো। পুরো প্রথমার্ধে সেভাবে দেখাই যায়নি আজুরিদের। খালি প্রথমার্ধের দুবার বিপদজনক আক্রমণ তৈরি হয়েছিলো স্পেন রক্ষণে। ২০ মিনিটে এমারসন একবার বিপদজনক ভাবে ওভারল্যাপে উঠে এসে বল বাড়িয়েছিলেন বক্সে। গোলকিপার না থাকলেও সেখান থেকে গোলমুখী শট নিতে পারেনি ইতালি। এছাড়া প্রথমার্ধের একদম শেষে বাঁদিক থেকে বক্সে ঢুকে ইনসিনিয়া সুন্দর বল বাড়িয়ে ছিলেন এমেরসনকে। খুব কাছ থেকে নেওয়া শট একটুর জন্য গোলে ছিল না। সবথেকে বড় সমস্যা ছিল আগের দিনের মতো আজও একেবারেই নিষ্প্রভ ছিলেন ইম্মোবিলে (Ciro Immobile) তার উদ্দেশ্যে বাড়ানো বলগুলো থেকে কোনো আক্রমণই দানা বাঁধছিলো না। স্পেন ডিফেন্ডাররা ইম্মোবিলেকে বল হোল্ড করে অন্যদের জন্য বাড়ানোর সুযোগই দিচ্ছিলো না। তিনিও গতিতে তাদের পরাস্ত করে বেরিয়ে যেতে পারছিলেন না। ফলে দ্বিতীয়ার্ধে তাকে বসিয়ে দিতে বাধ্য হন ইতালির কোচ মানচিনি।
দ্বিতীয়ার্ধে ৬০ মিনিটে খেলার গতির বিরুদ্ধে খেলার প্রথম গোলটি করেন কিয়েসা (Federico Chiesa)। প্রতি আক্রমণে গোলকিপারের থেকে বল পেয়ে মাঝেমাঠ থেকে ইনসিনিয়া অনবদ্য ডিফেন্স চেরা পাস বাড়ান ইম্মোবিলেকে। প্রাথমিক আক্রমন স্পেন ডিফেন্স আটকে দিলেও ফিরতি বল পেয়ে বক্সের মধ্যে দেন পায়ের দুরন্ত শটে গোল করে যান কিয়েসা (Federico Chiesa)।
এনরিকে (Luis Enrique) এরপর বাধ্য হন ওয়ারজাবলকে বসিয়ে মোরাতাকে (Álvaro Morata) নামাতে। তবে তার আগে ওয়ারজাবল আরেকটি সহজ সুযোগ নষ্ট করে যান। ৬৫ মিনিটে কোকে বক্সের মধ্যে ডিফেন্সকে বোকা বানিয়ে সুন্দর’একটা চিপ পাস রেখেছিলেন। ওয়ারজাবল খালি মাথা ঠেকাতে পারলেই অবধারিত গোল ছিল।
৬৮ মিনিটে আরেকবার এগিয়ে যেতে পারতো ইতালি। আরেকটা প্রতিআক্রমণে ডান প্রান্তে বল পেয়ে কিয়েসার পরিবর্তে নামা বেরার্দির (Domenico Berardi) উদ্দেশ্যে সুন্দর বল বাড়ান। বেরার্দির নিচু শট আটকে দেন স্পেন গোলকিপার সাইমন (Unai Simón)। অবশেষে ম্যাচের ৮০ মিনিটে মোরাতার গোলে সমতায় ফেরে স্পেন। ওলমোর সাথে সুন্দর পাস খেলে বক্সের মধ্যে ঢুকে বা পায়ে ঠান্ডা মাথায় গোল করে যান তিনি (১-১)। বাকি খেলায় স্পেন আরো কিছু আংশিক সুযোগ পেলেও গোল করতে পারেনি। তবে ওলমোর দৌড় বারবারই বিপদে ফেলছিলো ইতালি রক্ষণকে।
নির্ধারিত সময়ের খেলা ১-১ শেষ হওয়ায় খেলা গড়ায় অতিরিক্ত সময়ে। খানিকটা মন্থর হয়ে যায় খেলার গতি। সেভাবে সুযোগ তৈরি হয় নি। তবে খেলার দখল মূলত স্পেনের কাছেই ছিল। অতিরিক্ত সময়ের সেরা সুযোগ স্পেনের কাছেই এসেছিলো তাদের সেরা খেলোয়াড় ওলমোর থেকে । ৯৭ মিনিটে ওলমোর নিচু বিপদজনক ফ্রি কিক স্পেন গোলকিপার সাইমন (Unai Simón) আটকালে ফিরতি বলে সুযোগ আসে মোরাতার কাছে। খুব কাছ থেকে নেওয়া তার শট আটকে দেন কিয়েলিনি (Giorgio Chiellini)।
অতিরিক্ত সময় কোনো পক্ষই কোনো গোল না করতে পারায় শেষ অবধি খেলা গড়ায় টাইব্রেকারে। টাই ব্রেকারে ৪-২ তে জিতে নেয় ইতালি। ইতালির হয়ে গোল করেন বেলোত্তি (Andrea Belotti), বোনুচ্চি (Leonardo Bonucci ), ফেডেরিকো (Federico Bernardeschi) আর জর্গিনহো (Jorginho)। একমাত্র মিস করেন লোকাটেলি (Manuel Locatelli)। স্পেনের দুটো গোল করেন মোরেনো (Gerard Moreno) আর থিয়াগো (Thiago Alcântara)। মোরাতার শেষ পেনাল্টি সহজেই বাঁচিয়ে ইতালিকে ফাইনালে তুললেন ডোনারুমা। অপর মিসটা করেছিলেন ওলমো।
ফাইনালে উঠলেও ইতালির এই খেলা অনেক প্রশ্ন রেখে গেলো। স্পিনাজ্জোলার (Leonardo Spinazzola) অভাবটা বড় বেশি নজরে পড়লো। স্পিনাজ্জোলা না থাকায় বাম প্রান্তে ইনসিনিয়াকেও (Lorenzo Insigne) কখনোই বিপদজনক মনে হয় নি। ফাইনালের আগে আরেকবার আক্রমণভাগের কৌশল নিয়ে ভাবতে হবে মানচিনিকে (Roberto Mancini) । অপরদিকে প্রায় প্রতিদিনই বার্থ হচ্ছেন ইম্মোবিলে। প্রতি ম্যাচে তাকে শুরু থেকে খেলানোর যুক্তি আছে কিনা ভাবতে হবে সেটাও।
আর প্রতিযোগিতার শুরু থেকেই গোল মিস করার অভ্যাসকে সংশোধন না করতে পেরে বিদায় নিলো স্পেন। ইতালির মতো কঠিন প্রতিপক্ষের বিপক্ষে এত গোল নষ্ট করলে তার খেসারত দিতেই হবে। পরের বছর বিশ্বকাপের আগে স্ট্রাইকার সমস্যার সমাধান করতে পারলে এই স্পেন দল কিন্তু অনেকদুর যাবে।