‘It ain’t over till it’s over’
১৯৭৩ সালে চ্যাম্পিয়নশিপের লড়াইয়ে পিছিয়ে থাকা নিউইয়র্ক ইয়াঙ্কিসের (New York Yankees) সহ-খেলোয়াড়দের তাতাতে উপরের কথাটি বলেছিলেন আমেরিকান বেসবলের কিংবদন্তী যোগী বেরা (Yogi Berra)। পরে পৃথিবী জুড়ে পপ গানের সংস্কৃতিতে অসম্ভব জনপ্রিয় হয় এই উক্তিটি। তরুণ প্রজন্মের আধুনিকমনস্ক ছেলেমেয়েরা নিজেদের উদ্বুদ্ধ করতে প্রায়শই ব্যবহার করে থাকেন এই লাইনটি।
গতরাতের ফ্রান্স (France national football team) বনাম সুইজারল্যান্ডের (Switzerland national football team) ম্যাচেও কি সুইস ড্রেসিংরুমে ছিলেন কোনও যোগী বেরা? না হলে কি বলা যায় এই ম্যাচকে? কিছু অনামী খেলোয়াড় নিয়ে গড়া একটা টিমের দুরন্ত টিমগেমে সাধারণ থেকে অসাধারণে উত্তরণ? নাকি রোমানিয়ার বুকারেস্টের (Bucharest, Romania) ন্যাশনাল এরিনা স্টেডিয়ামে (National Arena) স্থানীয় সময় রাত প্রায় ১২:৪৫-এ রচিত এক রূপকথা? অথবা গোলিয়াথ (Goliath) ফ্রান্সকে হারিয়ে সুইজারল্যান্ডের ডেভিড (David) হয়ে ওঠা? এককথায় এই ম্যাচের ব্যাখ্যা করতে গেলে বোধহয় বলতে হয় – অবিশ্বাস্য!
আড়াই ঘন্টার রোলার কোস্টার রাইডে প্রতি মিনিটে রং পাল্টালো এই ম্যাচ। বারংবার লিখতে, কাটতে, আবার লিখতে হলো প্রতিবেদনের শিরোনাম। স্কোরলাইন বলছে বিজয়ী সুইসরা, পরাজিত ফরাসী আত্মগরিমা। কিন্তু টাইব্রেকারের ৫-৪ স্কোরলাইন বলবে না কোনও এক পল পোগবা (Paul Pogba) থেকে গেলেন অসহায় ট্র্যাজিক হিরো হয়ে, স্কোরলাইন বলবে না পেলের পর সর্বকনিষ্ঠ ফুটবলার হিসেবে ১৯ বছর বয়সে বিশ্বকাপের ফাইনালে গোল করা এমব্যাপে-কে (Kylian Mbappé) অন্তত একরাতের জন্য হলেও হিরো থেকে জিরো বানিয়ে দিলেন তাঁর থেকে দশ বছরের বড় সুইস গোলকিপার ইয়ান সোমার (Yann Sommer)।
অথচ ফ্রান্সের তো হারার কথা ছিল না। ফ্রান্সের প্রথম একাদশটা দেখলে কাগজে কলমে টুর্নামেন্ট শুরুর আগেই তাদের চ্যাম্পিয়ন ঘোষণা করে দেওয়া উচিত। পোগবা, কান্তে, গ্রিজম্যান, রাবিও-দের নিয়ে সাজানো সোনায় মোড়া মাঝমাঠ, এমব্যাপে আর বেনজিমার যুগলবন্দিতে ধারালো আক্রমণভাগ, লেঙলেট-ভারানেদের ডিফেন্স, গোলে লোরিস – দিদিয়ের দেশেঁর হাতে যা অস্ত্রভাণ্ডার, সারা পৃথিবীর রাষ্ট্রনেতারা যদি কাল তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের মাধ্যম হিসেবে ফুটবলকে ব্যবহার করেন, তাহলে বিশ্বজুড়ে ফরাসী রেনেসাঁ আসা স্রেফ সময়ের অপেক্ষা।
কিন্তু ফুটবলের সৌন্দর্যই তো এখানে। ফুটবলটা যে কাগজে কলমে খেলা যায় না। ১১টা নাছোড়বান্দা খেলোয়াড়ের চোয়ালচাপা লড়াই যে অনেক রথী মহারথীদের বিদায়ঘণ্টা বাজাতে পারে, গতরাতে দেখিয়ে গেলো সুইসরা। টিমে তারকা বলতে লিভারপুলে (Liverpool F.C.) খেলা শাকিরি (Xherdan Shaqiri), নিউক্যাসেল ইউনাইটেডে (Newcastle United F.C.) খেলা ফাবিয়ান স্কার-রা (Fabian Schär)। তাঁদের নিয়েই স্বপ্নের ম্যাচ উপহার দিলেন আর্সেনাল তারকা গ্র্যানিট জাকার (Granit Xhaka) নেতৃত্বে ভ্লাদিমির পেতকোভিচের (Vladimir Petković) ছেলেরা।
ম্যাচটা বেশ ভালোভাবেই শুরু করেছিল ফ্রান্স। প্রথম পনেরো মিনিটে আক্রমণের চাপও বজায় রেখেছিলো। কিন্তু ম্যাচে প্রথম গোলের রাস্তা খুঁজে পায় সুইজারল্যান্ডই। ১৫ মিনিটের মাথায় বক্সের বাঁদিক জুবেরের ক্রসে লেঙলেটের (Clément Lenglet) ঘাড়ের উপর দিয়ে হেডে গোল করে যান হ্যারিস সেফেরোভিচ (Haris Seferović) (১-০)। প্রথমার্ধে আর বলার মতো ঘটনা বলতে ২৬ মিনিটের মাথায় এমব্যাপের নেওয়া ফ্রিকিক প্রথমে সুইসদের মানবপ্রাচীরে লেগে ফিরে আসলে ফিরতি বলে নেওয়া ভলি গোলে রাখতে পারেননি তিনি।
দ্বিতীয়ার্ধের ৫৩ থেকে ৫৯ – এই ছয় মিনিটের মধ্যে মুহুর্মুহু যেভাবে ম্যাচ রং বদলালো, তা অনেক বরফশীতল মনের মানুষকেও সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়াতে বাধ্য করবে। প্রথমে ৫৩ মিনিটে জুবেরকে ফাউল করেন প্যাভার্ড (Benjamin Pavard)। ভার প্রযুক্তির সাহায্যে দেখা যায়, ফাউলের সময়ে জুবের (Steven Zuber) বক্সে ঢুকে পড়েছিলেন। ফলে পেনাল্টি পায় সুইসরা। দুগোলের ব্যবধান নিশ্চিত করে ম্যাচটা ওখানেই বোতলবন্দি করতে পারতেন তাঁরা, কিন্তু রিকার্ডো রডরিগেজের (Ricardo Rodríguez) নেওয়া নিচু পেনাল্টি কিক ডানদিকে ঝাঁপিয়ে বাঁচিয়ে দেন লোরিস (Hugo Lloris)। পরের মিনিটেই পোগবার থেকে চমৎকার বল পান ফাঁকায় দাঁড়ানো এমব্যাপে। বক্সের ভিতর বাঁদিক থেকে তাঁর প্লেসমেন্ট অল্পের জন্য লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়।
এক মিনিট পরেই, অর্থাৎ ম্যাচের ৫৬ মিনিটে সমতায় ফেরে ফ্রান্স। এমব্যাপের বাড়ানো বল অসম্ভব দক্ষতায় রিসিভ করে আগুয়ান গোলকিপারের পাশ দিয়ে আলতো টাচে গোল করে যান বেনজিমা (১-১)। গোলের সময় বেনজিমার (Karim Benzema) বল কন্ট্রোল ছিল দেখার মতো।
দুমিনিটের মাথায় আবার গোল ফ্রান্সের। অসাধারণ টিমগেমের ফসল এই গোলটি। সুইস বক্সের বাঁদিকে প্রথমে পোগবা থেকে পরিবর্ত হিসেবে নামা কোম্যান (Kingsley Coman), কোম্যানের মাইনাস গ্রিজম্যানকে (Antoine Griezmann), সেখান থেকে একটা ওয়ান টাচ এমব্যাপের সাথে, তারপর ছোট্ট ফ্লিকে বল সুইস গোলকিপারের হাত ছুঁয়ে গোললাইনে দাঁড়ানো বেনজিমার কাছে – বল জালে ঠেলতে ভুল করেননি তিনি (১-২)।
৭৫ মিনিটে ফ্রান্সের তিন নম্বর গোলটি পোগবার পা থেকে। অসাধারণ বললেও কম বলা হয়। সুইস ডিফেন্স থেকে ছিটকে আসা বল ডি-বক্সের বাইরে থেকে সোয়ারভিং শটে জালে জড়িয়ে দেন পোগবা। শূন্যে শরীর ছুঁড়েও নাগাল পাননি সুইজারল্যান্ডের গোলকিপার ইয়ান সোমার (১-৩)।
পনেরো মিনিট বাকি থাকতে সবাই যখন ধরেই নিয়েছে গেম-সেট-ম্যাচ ফ্রান্সের, ফুটবল দেবতা বোধহয় তখন অন্য কিছু ভেবে রেখেছিলেন। ম্যাচের নির্ধারিত সময়ের ৮১ মিনিটে স্বপ্নের কামব্যাক শুরু সুইজারল্যান্ডের। ডানদিক থেকে ভেসে আসা এমবাবু-র ক্রসে মাথা ছুঁইয়ে ব্যবধান কমান সেই সেফেরোভিচ (২-৩)।
ম্যাচের নব্বই মিনিট শেষ হওয়ার ১০ সেকেন্ড আগে রুদ্ধশ্বাস থ্রিলারের নতুন ট্যুইস্ট, যা দেখলে হয়তো স্বয়ং প্রবাদপ্রতিম চিত্র পরিচালক আলফ্রেড হিচককও শিহরিত হতেন। সমতায় ফেরে সুইজারল্যান্ড। সলিলসমাধি হতে চলা সুইসদের ইউরো অভিযানকে লাইফ জ্যাকেটের মতো বাঁচিয়ে তোলেন পরিবর্ত হিসেবে নামা গাভরানোভিচ। জাকার থেকে বল পেয়ে নির্ভুল নিশানায় বল জালে জড়িয়ে দেন তিনি (৩-৩)।
এরপরেও ম্যাচ বের করে নিতে পারতো ফ্রান্স। ইনজুরি টাইমের ৩ মিনিটে কোম্যানের শট বারে লেগে প্রতিহত হয়। তখনই স্পষ্ট হয়ে যায় ফ্রান্সের ললাটলিখন। ভাগ্যদেবী সুপ্রসন্ন ছিলেন না ফ্রান্সের প্রতি।
ম্যাচের অতিরিক্ত সময়ের খেলা বেশ একঘেঁয়ে। কোমরে হাত পড়ে গিয়েছিলো দুদলেরই, বিশেষত ফ্রান্সের। ফলস্বরূপ, বেনজিমাকে তুলে জিরৌ, কোম্যানকে তুলে থুরামকে নামাতে বাধ্য হন দিদিয়ের দেশঁ। ১১০ মিনিটে সহজ সুযোগ নষ্ট করেন সেই এমব্যাপে। না হলে ম্যাচ টাইব্রেকারে যায় না। উল্টে হ্যামস্ট্রিংয়ে চোট পেয়ে বসেন তিনি।
৩-১ এগিয়ে থেকেও ৯০ মিনিটে ৩-৩ গোলে ম্যাচে সমতা ফেরার জন্যই বোধহয়, ফ্রান্সের পক্ষে টাইব্রেকারের মানসিক চাপ নেওয়া সম্ভব হয়নি। বিশেষত এবারের ইউরো একেবারেই ভালো গেল না কিলিয়ান এমব্যাপের জন্য। পুরো টুর্নামেন্টে ৩৯০ মিনিট মাঠে থেকে ১৪টা শট নেওয়ার পরেও গোল পেলেননা প্যারিস সাঁ জাঁ-র ২২ বছর বয়সী এই স্ট্রাইকার। সেই প্রভাব পড়লো টাইব্রেকারেও। দুই দলের বাকি নয়জন গোলে বল পাঠালেও স্নায়ুর চাপে ভুগে সোমারকে পরাস্ত করতে পারলেন না এমব্যাপে। আর শেষ শট বাঁচিয়ে ওস্তাদের মার শেষ রাতে দিলেন ৩২ বছর বয়সী সুইস গোলকিপার ইয়ান সোমার। টাইব্রেকারে ৫-৪ গোলে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ফ্রান্সকে হারিয়ে সুইস ফুটবলের ইতিহাসে রচিত হলো এক নতুন অধ্যায়।
পরলোক থেকে প্রয়াত লরেন্স পিটার “যোগী” বেরা-ও হয়তো অস্ফূটে বলে উঠলেন – ‘It ain’t over till it’s over’!