মূহুর্তের ভুলে থামানোর বদলে থমকে গেল টিম ফাওলারের রথ
নেভিল কার্ডাস বহুদিন আগেই বলেছিলেন স্কোরবোর্ড নাকি আদতে একটা গাধা। আইএসেলের এক নম্বর বনাম দশ নম্বরের ম্যাচ কার্ডাস সাহেবের দর্শনকে মান্যতা দিয়ে গেলো। দুই কোচের ট্যাকটিক্সের লড়াইতে আক্রমনাত্মক ফুটবল কখনোই ম্যাচকে একপেশে হতে দেয়নি। ম্যাচের শুরুতে মুম্বাই সিটি এফসির মূহুর্মূহু আক্রমনে ইষ্টবেঙ্গল রক্ষনে ত্রাহি ত্রাহি রব উঠলেও নিজেদের অর্ধে পাস খেলে বলের দখল বাড়িয়ে ম্যাচের গতি নিয়ন্ত্রনে আনতে সক্ষম হয় ফাওলারের ইষ্টবেঙ্গল। এই সময়টায় স্কট নেভিলের খেলা বেশ নজরে পড়ে। মাঝমাঠের মিলন সিং ও বারবার নজর কাড়তে থাকেন একদম সঠিক জায়গায় বিপক্ষ খেলোয়াড়দের মাপা মিসপাস দিয়ে। বেশ কয়েকবার ই মিলন সিং এর মাপা মিসপাস ধরে গোলের সম্ভাবনা তৈরী করে ফেলে সের্জিও লোবেরোর ছেলেরা। নেভিল-ফক্স জুটি ও দেবজিত সজাগ থাকায় যদিও বড়সর কোন অঘটন ঘটেনি। পুরো ম্যাচে শততম ম্যাচ খেলতে নামা নারায়ন দাস ও যথেষ্ঠ পরিনত এবং বুদ্ধিদীপ্ত ফুটবল খেলেছেন। একবার দেবজিতের হাত ফস্কে বল বেরিয়ে এলেও বৌমোস বল গোলে রাখতে ব্যর্থ হন।
ম্যাচের ঠিক সাতাশ মিনিটের মাথায় মুম্বাইয়ের কর্নার ইষ্টবেঙ্গল ডিফেন্সে প্রতিহত হয়ে বেরিয়ে আসা বল বৌমোস বক্সে তুলে দিলে দীর্ঘদেহী মুম্বাই ডিফেন্ডার মুর্তাদা ফল একদম অরক্ষিত অবস্থায় মাথা ছুঁইয়ে অপ্রস্তুত দেবজিতের পাশ দিয়ে বল জালে জড়িয়ে দেন। কর্নার আটকে দিয়ে হঠাৎ দেবজিত সহ গোটা ডিফেন্সের এই মূহুর্তের জন্য দাঁড়িয়ে পড়ার মাশুল হিসাবে ই সাত ম্যাচ অপরাজিত ফাওলারের রথ কে থামতে হলো। অথচ গোটা নব্বই মিনিট সাথে প্রথমার্ধে দুমিনিট ও দ্বিতীয়ার্ধের পাঁচ মিনিট মোট সাতানব্বই মিনিটের খেলায় একবারো মনে হয়নি মুম্বাই সিটি এফসি কোন অপ্রতিরোধ্য দল।
মুম্বাইয়ের আক্রমনের মুখ লে ফন্দ্রে অনেকটা জায়গা জুড়ে খেললেও পাওয়া সুযোগ কাজে লাগিয়ে গোল করতে পুরোপুরি ব্যর্থ। বারবার ভেতরে ঢুকে জায়গা তৈরী করলেও গোদার্দ, বৌমোসরা সে জায়গা কাজে লাগিয়ে দেবজিতকে পরাস্ত করতে পারেননি। অন্যান্য ম্যাচের মতো খুব কঠিন কোন বল ও ধরতে হয়নি দেবজিতকে। আহমেদ জাহু ও রাওলিন বর্জেস রা বাধ্য হয়ে ইষ্টবেঙ্গল ডিফেন্সে চাপ তৈরী করতে মাঝমাঠ থেকেই লম্বা লম্বা শট নিতে থাকেন। যদিও কাজের কাজ তাতে কিছুই হয়নি। লে ফন্দ্রে কে তুলে ওগবেচে, বিপিন কে তুলে বীরপ্রতাপ সিং কে নামিয়েও সের্জিও লোবেরো দ্বিতীয় গোল তুলতে পারেননি। প্রথমার্ধেই অবশ্য আহমেদ জাহুর লাল কার্ড দেখে বেরিয়ে গিয়ে মুম্বাইয়ের দশজনের টিম হয়ে যাওয়ার কথা ছিলো কিন্তু প্রতিবারের মতো এবারেও রেফারী সঠিক সিদ্ধান্ত নেবার মানসিক দৃঢ়তা দেখাতে অক্ষম হয়েছেন।
দ্বিতীয়ার্ধে অঙ্কিতের জায়গায় রফিক, মাত্তির জায়গায় ব্রাইট ও ফক্সের জায়গায় আমাদি নামার পর ইষ্টবেঙ্গল মুর্তাদা-মেহতাব দের ডিফেন্সকে রীতিমতো টুঁটি চেপে ধরে। বারবার ভেঙে যেতে থাকে মুম্বাইয়ের অপ্রতিরোধ্য ডিফেন্স। আমাদি অল্প সময়ের জন্য নেমে বেশ কয়েকটি আক্রমন তৈরী করলেও সময় মতো বলে মাথা ছুঁইয়ে দলকে মূল্যবান এক পয়েন্ট এনে দিতে ব্যর্থ হয়েছেন। অন্যদিকে ব্যর্থতার তালিকা দীর্ঘ করেই চলেছেন তরুন ভারতীয় স্ট্রাইকার হরমনপ্রীত সিং। তরুন খেলোয়াড় তুলে আনতে হলে তাদের প্রতিযোগীতামূলক ম্যাচ খেলানোর কোন বিকল্প নেই। দলের দুই সিনিয়র ভারতীয় স্ট্রাইকার বলবন্ত ও জেজে সুযোগ পেয়ে প্রমান করে দিয়েছেন তারা তাদের সেরা সময় পেছনে ফেলে এসেছেন। এমত অবস্থায় প্রতি ম্যাচেই খেলছেন হরমনপ্রীত। কিন্তু গোল করে ভবিষ্যতের তারকা হিসাবে নিজেকে মেলে ধরতে পারছেন না। গোটা ম্যাচে খান পাঁচেক সুযোগের দুটোতেও যদি পা অথবা মাথা ছোঁয়াতে পারতেন তবেই ম্যাচের নায়ক হিসাবে আলোড়ন তৈরী করতে পারতেন। অন্ততঃ দিনের সহজতম সুযোগ কর্নার থেকে ভেসে আসা যে বলটা ফক্স নামিয়ে দিলেন সেটাতে মাথা ছোঁয়াতে পারলেই সচল থাকতো ফাওলারের অপরাজিত থাকার রথ। কিন্তু বিধি বাম। এই ফিনিশিং এর অভাবে কড়া মার্কিং সামলে আক্রমন তৈরী করেও খানিকটা নিষ্প্রভ ই হয়ে রইলেন ব্রাইট এনোবাখারে। প্রতি ম্যাচে পাঁচজনকে ধরাশায়ী করে গোল সমর্থকদের রূপকথায় সম্ভব হলেও বাস্তবে তা অসম্ভব।
দুর্দান্ত প্রত্যাবর্তন ঘটালেও প্রথম চারে ঢুকতে হলে ফাওলারের টিমে কয়েকটি পরিবর্তন জরুরী। যেমন নিজেদের কিম্বা প্রতিপক্ষের গোলের সামনে মূহুর্তের জন্য হলেও মনোঃসংযোগ হারিয়ে থমকে যাওয়া বন্ধ করতে হবে। মিলন সিং, আঙ্গৌসেনা, সুরচন্দ্রমদের শুধুই টিমলিস্টে কিছু নাম আর খেলোয়াড় পরিবর্তন কিম্বা মিসপাস করে নজরে আসা বন্ধ করতে হবে। ব্রাইটকে আটকাতে সব দলের ই দু তিনজন খেলোয়াড় ব্যস্ত হয়ে পড়লে প্রতিপক্ষ অর্ধে তৈরী হওয়া খালি জায়গা হরমনপ্রীত, পিলকিংটন, মাঘোমা দের কাজে লাগাতে হবে। পিলকিংটন, মাঘোমা, মাত্তিদের অতিরিক্ত বল হোল্ড করে বলের দখল হারানো বন্ধ করতে হবে। এখন দেখার বিষয় এর মধ্যে কতগুলি ভুল সংশোধন করে নিজেদের প্রথম চারের দাবিদার হিসাবে তুলে আনতে পারে ফাওলারের ছেলেরা। কাজটা কঠিন হলেও অসম্ভব নয়, বিশেষ করে ওপরের দিকের দলগুলির মধ্যে যখন মুম্বাই ছাড়া আর কেউ ই পয়েন্ট তোলার ব্যাপারে ধারাবাহিক নয়। তবে এবছর প্রথম চারে না গেলেও এই টিমের নিউক্লিয়াস ধরে রেখে কিছু দেশীয় স্ট্রাইকার, রক্ষণাত্বক মাঝমাঠ ও রক্ষণভাগের ভারতীয় খেলোয়াড় যোগ করে পরের আইএসেল এ অংশগ্রহন করা গেলে ভালো ফলাফল আশা করাই যায়।