সাফল্য পেতে গেলে যে গোল্ডেন রুলগুলো অনুসরন করতে হয় তারমধ্যে অন্যতম হলো প্রথমেই নিজের দুর্বলতা ও শক্তি সম্পর্কে সম্যক ধারনা তৈরী করা। সাফল্যের দিকে এগোতে গেলে যে কাঁটা বিছানো পথ ধরে একপা একপা করে এগোতে হয় তার প্রতিটা পদক্ষেপে নিজের দুর্বলতা ও শক্তি সম্পর্কে সম্যক ধারনাই অন্যদের চেয়ে সফলদের আলাদা করে দেয়। ঠিক এই জায়গাটাতেই ফাওলার ডাঁহা ফেল। ওনার দলে কোন সচতুর ও সুযোগসন্ধানী স্ট্রাইকারের অনুপস্থিতিটাই যে ওনার দলের মূল দুর্বলতা সেটাই সম্ভবতঃ উনি আঁচ করে উঠতে পারেননি। ফুটবল মাঠে একটা ম্যাচ জিততে হলে যা যা করতে হয় ফাওলারের প্রশিক্ষনাধীন ইষ্টবেঙ্গল তার সবকিছুই করেছে শুধুমাত্র গোল করা ছাড়া। সমস্যা হলো এসব করার জন্য ম্যাচে কোন পয়েন্ট পাওয়া যায়না। পয়েন্ট আসে গোল করা আর গোল আটকানোর ওপর ভিত্তি করে। ফাওলারের ভান্ডারে গোল আটকানোর ধারাবাহিক কেউ নেই আর গোল করার ই কেউ নেই। তাই যা হবার তাই হয়েছে। ফুটবল বিজ্ঞান মানলে এই দলটার এই জায়গাতেই থাকার কথা ছিলো।
প্রথম লেগের ম্যাচে সুনীলদের হারানোর পর এই ম্যাচে ইষ্টবেঙ্গল এগিয়েই শুরু করেছিলো। টানা আট ম্যাচে জয়ের মুখ না দেখা, প্রথম একাদশের নিয়মিত খেলোয়াড় না থাকা-বিএফসির জন্য এই ম্যাচে বেশ কঠিন ই ছিলো। বল মাঠে গড়াতেই ফাওলারের নিজের দুর্বলতা-শক্তি সম্পর্কে যে সঠিক ধারনা নেই সেটা নগ্নভাবে প্রকাশ পেয়ে যায়। ম্যাচের বাঁশি বাজতেই প্রচন্ড দ্রুত গতিতে নিজেদের মধ্যে পাস খেলে বিএফসির হাফে আক্রমনে ঢুকতে শুরু করেন স্টেইনম্যান, ব্রাইট, আমাদি, হরমনপ্রীতরা। এই তুমুল আক্রমনের মুখে খেই হারিয়ে ফেলেন সুনীলরা। সত্যি বলতে স্টেইনম্যানদের গতির সামনে কিছুটা অসহায় ই দেখাচ্ছিলো নৌশাদ মুসার বিএফসিকে। এই সময়ে গোলের মুখ খুলে গেলেও হরমনপ্রীত ধারাবাহিকতা বজায় রেখে বল জালে জড়াতে পারেননি। আফশোস হয় শুভ ঘোষ, কোমল থাটাল দের মতো জুনিয়র দেশীয় গোল গেটাররা বিদেশী স্ট্রাইকারদের মাঝে ঠিকঠাক ম্যাচটাইম পান না আর হরমনপ্রীত ম্যাচের পর ম্যাচ সুযোগ পেয়েও কাজে লাগাতে পারেন না।
দলে টানা নব্বই মিনিট একই তালে খেলা চালিয়ে যাওয়ার মতো পাঁচ ছয়জন খেলোয়াড় না থাকলে শুরুতেই টপগিয়ারে চলে গেলে কিছুক্ষণের মধ্যেই দল মুখ থুবড়ে পড়ার সম্ভাবনা তৈরী হয়। ফাওলারের টিমের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। দশ মিনিট খেলা হতেই গুরপ্রীতের নিজের বক্সের কয়েক গজ বাইরে থেকে নেওয়া লম্বা ফ্রিকিক সুনীল ছেত্রী হেড করে নামিয়ে দিলে ইষ্টবেঙ্গল বক্সে অরক্ষিত ক্লেইটন বল পেয়ে যান। ড্যানি ফক্স ক্লেইটন কে ঐ জায়গায় ছেড়ে রেখেছিলেন কেন সাধারণ বুদ্ধিতে বোঝা গেল না। শেষ মূহুর্তে ফক্স এগিয়ে এসে ব্লক করলেও ততক্ষণে ক্লেইটন গুছিয়ে নেবার যথেষ্ঠ সময় পেয়ে গেছেন বলটাকে দেবজিতের নাগালের বাইরে জালে জড়িয়ে দেবার জন্য।দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখা ছাড়া দেবজিতের কিছুই করার ছিলো না। খেলার গতির সম্পূর্ন বিপরীতে গিয়ে ডিফেন্সের গাফিলতিতে গোল খাওয়ার পর ব্রাইটের নেতৃত্বে মাঝমাঠে কিছুটা তাগিদ দেখা গেলেও স্কোরিং জোনে বেঙ্গালুরুর ডিফেন্সকে বিব্রত করার জন্য ইষ্টবেঙ্গলের একজন খেলোয়াড়ও ছিলেন না।
পাসের ফুলঝুড়ি ছোটালেও গুরপ্রীতের সামনে পৌছানোর আগেই ফাওলারের আক্রমনভাগের সব জারিজুরি শেষ হয়ে যাচ্ছিলো। বরং নৌশাদ মুসার স্ট্র্যাটেজি এই সময় বেশ কার্যকর হয়ে ওঠে। মাঝমাঠ দখলের চেষ্টাই করলেন না। গুরপ্রীতের তোলা লম্বা গোলকিক গুলো আছড়ে পড়তে লাগলো ইষ্টবেঙ্গল বক্সের আশেপাশে। এইসব গোলকিক গুলো ধরেই হাইলাইন ডিফেন্স রেখে ক্রমাগতঃ চাপ তৈরী করে গেল ব্যাঙ্গালুরু। পরিষ্কার বোঝা গেল ফাওলার তার রিসোর্স সম্পর্কে যতটা অজ্ঞ নৌশাদ ঠিক ততটাই ওয়াকিবহাল। সবচে হতাশাজনক, ফাওলারের তরফ থেকে পাল্টা কোন চাল এই সময় পাওয়া গেলো না। ব্যাঙ্গালুরুর এই গুরপ্রীতের কাছ থেকে উড়ে আসা বল ধরে ইষ্টবেঙ্গলের বক্সে ঢুকে পড়ে গোল লক্ষ্য করে জোরালো শট নেবার স্ট্র্যাটেজি থেকেই ম্যাচের চুয়াল্লিশ মিনিটের মাথায় রাহুল ভেকের তুলে দেওয়া বল অরক্ষিত অবস্থায় পেয়ে যান পরাগ। ক্লেইটনের মতোই পরাগের আশে পাশেও নেভিল বা অঙ্কিত কেউ ই কভার করার জন্য ছিলেন না। যথেষ্ঠ সময় পাওয়া স্বত্ত্বেও বিনা বাঁধায় পরাগের জোরালো শট পোস্টের নীচের অংশে লেগে ফেরত আসার মুখে দেবজিতের গায়ে লেগে গোলে ঢুকে যায়।
আগের ম্যাচ গুলোতে একা কুম্ভ হয়ে দুর্গ সামলানো দেবজিত মজুমদার ও নৌশাদ মুসার স্ট্র্যাটেজিতে খানিকটা দিশেহারা দেখালেন। বারপোস্ট সহায় না হলে সুনীলদের গোলসংখ্যা তিন বা চার হতেই পারতো। দ্বিতীয়ার্ধে স্টেইনম্যানের পরিবর্ত হিসাবে মাঘোমার নড়াচড়া কিছুটা চোখে পড়লেও বাকিদের নজরে পড়েনি। বরং স্টেইনম্যান থাকাকালীন ইষ্টবেঙ্গলের মাঝমাঠে কিছু ভালো মুভ তৈরী হচ্ছিলো।ব্রাইট নিজের মতো করে চেষ্টা করলেও সামনে গোলে বল ঠেলার মতো কেউ না থাকায় সব প্রচেষ্টাই বিফলতায় পর্যবসিত হয়েছে। দ্বিতীয়ার্ধে ফাওলারের পরিবর্তন গুলোও কোন কাজে আসেনি। স্টেইনম্যান কে তুলে নিলেন কেন, কেন ই বা আমাদি থেকে গেলেন অতোটা সময়? পিলকিংটন খোলস ছেড়ে বেরোতেই যখন পারছেন না তখন কেন পিলকিংটন? এর আগের ম্যাচে হাতে স্টেইনম্যান থাকা স্বত্ত্বেও মাঘোমার মতো এ্যাটাকার কে কেন ডিফেন্সিভ মিডিও বানিয়ে দিলেন? অজয় ছেত্রী, মিলন সিং এক ই মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ – পাল্লা দিয়ে মিসপাস করে গেলেন গোটা টুর্নামেন্ট জুড়ে। হাওবাম তোম্বা সিং যথেষ্ঠ প্রভাব ফেললেও হঠাৎ তাকে খেলানো বন্ধ করে দিলেন? বিকাশ জাইরু ভালো পারফর্ম করেও কেন আর জার্সী পাচ্ছেন না? প্রচুর প্রশ্ন উঠে গেল ফাওলারের কোচিং দক্ষতা নিয়ে।
ক্রিকেট মাঠে মহেন্দ্র সিং ধোনিও ম্যাচের মাঝে হঠাৎ হঠাৎ এমন সব সিদ্ধান্ত নিতেন যা চিরাচরিত ক্রিকেট বুদ্ধিতে ব্যাখ্যা করা যেত না। সব সিদ্ধান্ত সাফল্য না পেলেও শতকরা নিরানব্বই শতাংশ ক্ষেত্রে ম্যাচের মোড় ঘুরে যেত এইসব সিদ্ধান্তে। ফাওলারের ক্ষেত্রেও ওনার যে সিদ্ধান্ত গুলি সমর্থক বা অন্যান্য ফুটবল বিশেষজ্ঞদের বোধগম্য হচ্ছেনা সেগুলোই মাস্টারস্ট্রোক হিসাবে গন্য হতো যদি ড্র ম্যাচ থেকে তিন পয়েন্ট এবং হারা ম্যাচ থেকে এক পয়েন্ট আসতো কিন্তু তা হয়নি। তাই ফাওলারের প্রতিটা সিদ্ধান্ত নিয়ে বিস্তর কাঁটাছেড়া হবে এটাই স্বাভাবিক। আত্মপক্ষ সমর্থনে দেরীতে টিমগঠন ও রেফারীদের বদান্যতার কথা বলেও বিশেষ লাভ নেই। জানুয়ারীর আগেই দলের ফাঁকফোকর চোখের সামনে চলে আসায় জানুয়ারীর ট্রান্সফার উইন্ডোটাকে আরো বুদ্ধিমত্তার সাথে ব্যবহার করাই যেত। ব্রাইটকে দলে নেওয়া অসাধারণ সিদ্ধান্ত কিন্তু ব্রাইট বা মাঘোমার দেওয়া অসাধারণ পাস গুলোকে সার্থক রূপ দিতে একজন লে ফন্দ্রে বা ভালসকিস কিম্বা রাহুল কেপি গোছের কাউকে দলে নেওয়া প্রয়োজন ছিলো। সারা মাঠে অসাধারণ ফুটবল খেলে রূপকথা লেখার সম্ভাবনা তৈরী করেও ফুটবল বিজ্ঞানের কাছে মাথা নোয়াতে হলো ফাওলারকে।
ইনভেস্টর হিসাবে যদিও শ্রীসিমেন্টের পারফরম্যান্স মোহনীয়। শেষ বেলাতেও সৌরভ দাস ও সার্থক গলুইয়ের মতো প্রতিভার পেছনে খরচ করে বাঙুররা সমর্থকদের যথেষ্ঠ ইতিবাচক ইঙ্গিত দিয়েছেন। টুর্নামেন্টের বাকি ম্যাচ গুলোকে আগামী মরশুমের প্রস্তুতি হিসাবে ধরে নিয়ে ফাওলারের কাছে জবাবদিহিতা চাওয়া হোক। সন্তুষ্ট হবার মতো জবাবদিহিতা দিতে পারলে ফাওলারের অধীনেই ব্রাইট, স্টেইনম্যান, দেবজিত, অঙ্কিত, জাইরু, তোম্বা, সৌরভ, সার্থকদের ধরে রেখে পরের মরশুমের দল সাজানো শুরু হোক।পরের মরশুম কিন্তু আলাদা হতে চলেছে। কোলকাতার ভরা গ্যালারীর সামনে কোচ, ইনভেস্টর, খেলোয়াড়দের আর যাই হোক মোটিভেশনের অভাব হবেনা।