Recap
আইএসেলে প্রথম চারের স্বপ্ন ফুরিয়ে গেছে বহু আগেই। সম্মানের ডার্বীতে জুটেছে হার। এবার একদা ক্লাব কর্তাদের দ্বারা বিতাড়িত কোচের দলের কাছ থেকে জুটলো লাঞ্ছনা। খালিদ জামিলকে যতটুকু দেখা গেছে, তাতে উনি অহংকারী কোন মন্তব্য করবেন বলে মনে হয় না। তবে ফুটবল বোদ্ধা কর্তাদের উত্তরটা উনি নিজের কাজের মাধ্যমে দেখিয়ে দিয়ে গেলেন। দলে আটটি পরিবর্তন করেও খালিদ জামিল কে রোখা গেল না। মুম্বাই এফসির কোচ থাকাকালীন বড় দলগুলিকে আটকে দেওয়ার জন্য বিখ্যাত ছিলেন এই খালিদ জামিল। এরপর পাহাড়ের আইজলকে আইলীগ চ্যাম্পিয়ন করে ভারতীয় কোচেদের মধ্যে জাতে উঠলেন। ইষ্টবেঙ্গলে এসে বাতিল কোচেদের তালিকায় চলে গেলেন। বাতিল করার আগে দাগিয়ে দেওয়া হলো ভীতু কোচ, তুকতাক কোচের তকমা। আইলীগ জয়ের সাফল্য কে নাকচ করা হয়েছিলো আইজল শহরের হোমগ্রাউন্ডের উচ্চতার দোহাই দিয়ে। অদ্ভুতভাবে খালিদ জামিলের পর অনেকেই কোচ হলেন অথচ ঐ একই হোমগ্রাউন্ডে খেলে আইজল এফসি কে চ্যাম্পিয়ন করতে পারলেন না। এদিকে খালিদও স্পটলাইট থেকে সরে গেলেন। মোহনবাগানে আধা মরশুম থেকে সাফল্য দিতে পারলেন না। ব্যর্থ কোচের তকমা নিয়েই ফুটবলের মক্কা ছেড়ে আইএসেলে নর্থ ইষ্ট ইউনাইটেডের সহকারী কোচ হলেন। কেউ তেমন খবর রাখেনি। মাঝ মরশুমে বিদেশী কোচ ছাঁটাই হতেই আবার ভেসে উঠলো খালিদের নাম। লীগটেবিলে ক্রমশঃ নীচে নামতে থাকা একটা টিমকে শেষ চারে নিয়ে গেলেন তাও আবার শেষ চার নিশ্চিত করলেন নিজের পুরনো ক্লাব ইষ্টবেঙ্গলকে হারিয়ে। একজন ভীতু কোচ ভারতীয় ফুটবলের শতবর্ষপ্রাচীন একটা ক্লাবকে হারিয়ে দিলেন।
ইষ্টবেঙ্গলের খেলা নিয়ে বিশেষ লেখার মতো কিছুই নেই। মোট আটটি পজিশনে খেলোয়াড় পাল্টে খেলতে নেমেছিলো এসসি ইষ্টবেঙ্গল। রফিক,জাইরু, তোম্বা, জেজে এদের খেলালে ম্যাচের রেজাল্ট অন্য রকম হতো কিম্বা ফক্সের জায়গায় নেভিল অথবা মাঘোমার জায়গায় মাত্তি থাকলে অন্য খেলা দেখা যেত – এসব আসলে সমর্থকদের কল্পনা।দিনের পর দিন হারতে হারতে নিজের মনকে দেওয়া সান্ত্বনার প্রলেপ। বাস্তবে গোটা টিমটাই এক ই ধরনের কিছু খেলোয়াড় নিয়ে তৈরী। দেশীয় খেলোয়াড়গুলি আইএসেল স্ট্যান্ডার্ডে অন্যান্য দলগুলির বাতিল আর বিদেশী গুলি (মাত্তি ও ব্রাইট এই দলে পড়বেন না) ক্যারিয়ারের সায়াহ্নে এসে পেনশন স্কিমের আওতায় কিছু টাকা কামাতে এসেছে। তাও এরা সাধ্যমতো লড়েছে। তাই মাঝমাঠে কিছু খেলা হয়েছে। কিন্তু একটা স্ট্রাইকার বিহীন দল খুব বেশী হলে বলের দখল বেশী রাখতে পারে কিন্তু পরিকল্পনা অনুযায়ী খেলে তিন পয়েন্ট আনতে পারে না। জেজের শরীর দেখে বোঝা যাচ্ছে এখন যথেষ্ঠ ই ফিট। ভারতীয় জাতীয় দলের এক সময়ের নিয়মিত স্ট্রাইকার একটাও বল গোলে রাখতে তো পারেনই না উল্টে বলের দখল প্রতিপক্ষের পায়ে দিয়ে প্রতিআক্রমনের সুযোগ তৈরী করে দেন।
কর্তাদের দ্বারা বাতিল এক ফুটবলারই ইষ্টবেঙ্গল কফিনের শেষ পেরেকটা পুঁতে দিয়ে গেলেন। আচমকা ম্যাচের গতির বিরুদ্ধে গোল করার জন্য ই বারবার শিরোনামে আসেন ভিপি সুহেইর। নবাব ভট্টাচার্যের ইউনাইটেড থেকে উত্থান। ইষ্টবেঙ্গলে এসে বাতিল হলেন “হোমসিক” তকমা নিয়ে। মোহনবাগানে গিয়ে আইলীগ জয়ে বেশ কার্যকরী ভূমিকা নিয়ে অবশেষে আইএসেলে নর্থ ইষ্ট ইউনাইটেড। দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতেই প্রথমবার গ্লাভস পাওয়া মিরশাদকে বোকা বানিয়ে করে গেলেন প্রথম গোল।এই গোলের পার্থক্যেই শূণ্য হাতে ফিরতে হলো ফাওলারের ছেলেদের। প্রথম গোলের কিছুক্ষণ পরেই নিজের বক্স থেকে বল ক্লিয়ার করতে গিয়ে বল জালে জড়িয়ে দিয়ে সার্থক গলুই এগিয়ে দেন খালিদ জামিলের দলকে। যদিও নিজের ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করতে ডিফেন্স থেকে উঠে গিয়ে ম্যাচের নির্ধারিত সময়ের চার মিনিট আগে হেডে গোল শোধ দিয়ে আসেন সার্থক গলুই।
খেলা একদম একপেশে খালিদ জামিলের নর্থ ইষ্ট ইউনাইটেড খেলে গেছে এমনটা নয়। নিজেদের মধ্যে পাস খেলা, বল হোল্ডিং, মাঝমাঠে বল কেড়ে নেওয়া, প্রতিপক্ষের আক্রমন আটকে দেওয়া মোটকথা প্রতিপক্ষের বক্সের আগে অব্দি সবকিছুই ঠিকঠাক হয়েছে কিন্তু পয়েন্ট নিয়ে আসে যে গোল সেই স্কোরিং জোনে ফাওলারের টিমের প্রভাব ছিলো শূণ্য। একবারের জন্যেও শুভাশিষ রায়চৌধুরীকে কঠিন কোন বল বাঁচাতে হয়নি। জেজে এবং হলোওয়ে দুজনেই সারাক্ষণ ডিফেন্ডারদের পেছনে লুকিয়ে থাকলেন বল ধরার ভয়ে তারপরেও বল পায়ে পড়ে গেলে জেজে ডিফেন্ডারদের পায়ে বল তুলে দিচ্ছিলেন আর হলোওয়ে বল নিয়ে পেছন ঘুরে দুতিনজন ডিফেন্ডারকে কাঁধে নিয়ে নিরুদ্দেশের উদ্দেশ্যে বল বাড়িয়ে দিচ্ছিলেন। রবি ফাওলার, টনি গ্রান্টের মতো ফুটবলের কুলীন দেশের কোচেরা কেন বাস্তবতা বুঝলেন না এটাই আশ্চর্যজনক!! আইএসেলের স্ট্যান্ডার্ড বুঝতে যদি না ও পেরে থাকেন জানুয়ারী উইন্ডো তে ফক্স, আমাদি, পিলকিংটন দের বিকল্প দেশীয় নতুন কাউকে আনা হলো না কেন? কিম্বা তাদের ঘষে মেজে কাজ চালানোর মতো করে তৈরী করা হলো না কেন?
ফুটবলে সাফল্য পেতে প্রসেস অবশ্যই জরুরী। কিন্তু প্রসেসে এই মানের বিদেশী দের ভূমিকা ঠিক কি? বছরের পর বছর চলে যায় ঠিকঠাক প্রসেস টুকুই শুরু হয়না। মরীচিকার মতো সমর্থকেরা হাতের সামনে যা পায় সেটাকেই আঁকড়ে ধরে প্রসেস ভেবে নিজেদের সান্ত্বনা দেয়। শেষ বার প্রসেস দেখা গিয়েছিলো আলেহেন্দ্র মেনেনহেস গার্সিয়ার প্রথম বছরে। জবি, সামাদের মতো কিছু খেলোয়াড়কে ঘষে মেজে তৈরী করার পর কর্তা-ইনভেস্টর দ্বন্দে দলটাই ভেঙে যায়। অথচ টিমটা ধরে রাখলে সেই টিমটাই এবছর আইএসেলে এলে ইষ্টবেঙ্গলের ঐতিহ্যে কালির দাগ হয়তো লাগতো না।
এবছরেও যা অবস্থা তাতেও প্রসেস শুরু হবার ধারেপাশে আমরা নেই। কর্তাদের টার্মশীট সাইন করা নিয়ে টালবাহানা আমাদেরকে আরো পিছিয়ে দিচ্ছে। টার্মশীট সাইন না হলে হয়তো নতুন ইনভেস্টর আসবে। তারা সব বুঝে শুনে হাল ধরতে ধরতে সামনের মরশুমটা কেটে যাবে। তাও প্রসেস বা সিস্টেম চালু হবে না অথবা টালবাহানা শেষে যখন টার্মশীট সাইন হবে তখন আর প্রসেসে আনার মতো ফুটবলার অবশিষ্ট থাকবে না। নির্যাস যা পাওয়া যাচ্ছে তাতে সমর্থকদের দুঃসময় আগামী মরশুমেও কাটার কোন লক্ষন নেই। এভাবেই চলতে থাকবে। অব্যবস্থা চলতে থাকলে কোন এক পক্ষের তো সুবিধা হচ্ছেই নয়তো এই অব্যবস্থা জিইয়ে রাখা কেন? সমর্থকেরা সাফল্যের অভাবে বিভিন্ন মতধারায় বিভক্ত হয়ে গেলেও এই অব্যবস্থার নিরসন প্রত্যেকেই চান। তাই এই ক্লাব সমর্থকেরা ছিনিয়ে নিয়ে সামনের দিকে এগোবেন নাকি এই এক জায়গায় পরে থেকে অব্যবস্থার আড়ালে কতিপয় ব্যাক্তির স্বার্থসিদ্ধির আখড়া হয়ে তিলে তিলে ফুরিয়ে যাবে? শতবর্ষে দাঁড়িয়ে এটাই সবচেয়ে বড় প্রশ্ন।