Recap
টুর্নামেন্টের শেষ চারে যাবার আশা ফুরিয়ে গেছিলো আগেই। দেরীতে টুর্নামেন্টে যোগদান, পর্যাপ্ত প্র্যাকটিসের সুযোগ না পাওয়া দিয়ে আইএসেলের প্রথম ডার্বী হারকে ব্যাখ্যা করা গেলেও মরশুমের শেষ ডার্বী ছিলো সম্মানের ডার্বী। বিশেষ করে জানুয়ারী উইন্ডোতে পর্যাপ্ত সুযোগ ও ইনভেস্টরের পূর্ণ সহযোগিতার পরেও কেন চাপের মুখে দলের এমন ছন্নছাড়া দশা তার জন্য রবার্ট ফাওলার-টনি গ্রান্টদের অবশ্য ই কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে। কেন দলে একজন নব্বই মিনিট ধরে প্রতিপক্ষকে বাঁধা দেওয়ার মতো বিদেশী ডিফেন্ডার কিম্বা মাঝমাঠ থেকে বক্সে আসা বল ধরে গোল করার মতো কোন স্ট্রাইকার দলে নেই? প্রশ্নগুলো কে কিন্তু ভবিষ্যতের টিম তৈরীর দোহাই দিয়ে আটকানো সম্ভব নয়।
আগের ম্যাচের অপরিবর্তিত একাদশ নিয়ে কোলকাতা ডার্বী খেলতে নামা দুই দল ই কিন্তু শুরুটা বেশ ভালো ভাবে করেছিলো। প্রচন্ড দ্রুতগতিতে আক্রমন শানিয়ে এটিকেমোহনবাগানের খেলোয়াড়েরা বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন কোচ হাবাসের ডার্বী গেমপ্ল্যানটা ঠিক কি? দ্রুত গোল তুলে নিয়ে মাঝমাঠে ব্রাইট ও স্টেইনম্যান কে মারধোর করে আটকে রাখো, দ্বিতীয় অর্ধের শুরুতে আবারো ঝটিতি একটা গোল করে তিন পয়েন্ট নিশ্চিত করে মাঝমাঠে প্রনয় হালদারকে এনে দেদার মারধোর করে ম্যাচ শেষ করে দাও। নতুন কিছুই না। এন্তোনিও লোপেজ হাবাস মরশুমের পর মরশুম ধরে এই এক ই স্ট্র্যাটেজিতে খেলে চলেছেন এবং সফল হয়ে চলেছেন। অদ্ভুতভাবে এর পাল্টা টোটকা বার না করে ফাওলারের নিজের ফর্মেশন ধরে রাখার গোয়ার্তুমি দেখানোর মানেটা ঠিক বোঝা গেলনা। দুটো টিম পয়েন্ট টেবিলে খুব কাছাকাছি থাকলে দুই কোচের এধরনের উন্নাসিকতা দেখানোটা মানায়। যেখানে হাবাসের সাথে ফাওলারের টিমের পয়েন্টের এতো লম্বা ফারাক সেখানে এধরনের গোয়ার্তুমি সাহসিকতা নয়, বরং বোকামী। পুরো ম্যাচ জুড়ে ঝিঙ্গান চড়ে থাকলেন পিলকিংটনের ঘাড়ের ওপর আর প্রীতম জাপ্টাজাপ্টি করে গেলেন ব্রাইটের সাথে। উপরি হিসাবে ম্যাকহিউ, তিরি, লেনি রা সুযোগ সুবিধা মতো দেদার লাথি, কনুইয়ের গুঁতো, ধাক্কা মেরে গেলেন ব্রাইটকে। রেফারীর চোখের সামনে চরম শারীরিক যন্ত্রনা পেতে পেতেও বারবার প্রীতমকে বোকা বানিয়ে বল নিয়ে ছিটকে বেরিয়ে এসে বুঝিয়ে দিয়ে গেলেন প্রীতম কোটালের ব্রাইটের মতো প্রতিভাকে খেলে আটকানোর ক্ষমতাই নেই।তবুও ব্রাইটের পরিশ্রম ফল দিলো না বক্সে দাঁড়িয়ে থেকে ব্রাইটের সাজানো বল ধরে ঠান্ডা মাথায় জালে জড়ানোর একটা লোকের অভাব। একটা গোটা টুর্নামেন্টে এরকম একটা স্ট্রাইকারবিহীন দল বারবার নামানোর পেছনে ফুটবলবিশ্বের কোন দর্শন কাজ করছে তা সত্যিই অজানা।
ম্যাচের বাঁশি বাজার কয়েক মিনিটের মধ্যেই অতি অল্পের জন্য মনভীর পা ঠেকাতে না পারায় বেঁচে যায় ইষ্টবেঙ্গল।এরপর স্টেইনম্যানরা নিজেদের মধ্যে পাস খেলে খেলার নিয়ন্ত্রন নিজেদের আয়ত্বে নেওয়ার পর ম্যাচের ঠিক পনেরো মিনিটের মাথায় আচমকা ছিটকে আসা একটা বল ধরে একক দক্ষতায় ইষ্টবেঙ্গল বক্সে ঢুকে পড়েন রয় কৃষ্ণ। সুব্রত পাল গোল ছেড়ে বেরিয়ে এসে ঝাঁপ দিলেও তা রয় কৃষ্ণ কে আটকানোর জন্য যথেষ্ঠ ছিলো না। হালকা টোকায় সুব্রতর নাগাল থেকে বল সরিয়ে নিয়ে ঠান্ডা মাথায় বলটাকে সঠিক গন্তব্যে পৌছে দিয়ে এটিকেমোহনবাগানকে মূল্যবান লীড এনে দেন। রয় কৃষ্ণর পেছন পেছন দৌড়ানো ছাড়া কোন রকম প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারেননি ফক্স-রাজু-সার্থকরা। তেড়েফুঁড়ে উঠলেও প্রীতম-তিরি-সন্দেশ দের দৌরাত্ম্য কখন ই ব্রাইট-পিলকিংটন কে গোল করার মতো জায়গায় যেতে দিচ্ছিলো না। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বল পজেশন সমান সমান হয়ে গেলেও ইষ্টবেঙ্গলের শট অন টার্গেট ছিলো শূণ্য। ম্যাচের একচল্লিশ মিনিটের মাথায় রাজু গায়কোয়াড়ের লম্বা থ্রো ক্লিয়ার করতে গিয়ে তিরি হেড করে নিজেদের গোলে ঢুকিয়ে দিয়ে ইষ্টবেঙ্গল কে ম্যাচে সমতায় ফেরান।
দ্বিতীয় অর্ধের শুরুতেও ব্রাইট ও পিলকিংটন এর জন্য যে টোটকা হাবাস ব্যবহার করছেন সেটা দেখেও রয় কৃষ্ণ, উইলিয়াম ও মার্সেলিনহোর জন্য কোনরকম ব্যবস্থাই নেননি টনি গ্রান্ট। তিনজনেই ফ্রি খেলে গেলেন গোটা ম্যাচ। আক্রমন পাল্টা আক্রমনে ডার্বীর টানটান উত্তেজনা যখন চরমে ঠিক সেই সময় ম্যাচের বাহাত্তর মিনিটের মাথায় রয় কৃষ্ণের সামনেই গয়ংগচ্ছভাবে নিজেদের মধ্যে পাস খেলতে গিয়ে বল রয় কৃষ্ণের পায়ে তুলে দেন ইষ্টবেঙ্গল ডিফেন্ডারেরা। রয় কৃষ্ণ বলটা ধরেই ফাঁকায় দাঁড়িয়ে থাকা উইলিয়াম কে বাড়িয়ে দেন। উইলিয়াম সময় নিয়ে ঠান্ডা মাথায় বলটাকে গন্তব্যে পৌছে দিতে কোনরকম ভুল করেননি। গোলটার ক্ষেত্রে মূল কারিগর ছিলেন ইষ্টবেঙ্গল অধিনায়ক ড্যানি ফক্স। রয় কৃষ্ণ ও উইলিয়াম যখন বক্সে ঘুরঘুর করছে তখন বল নিজেদের ডিফেন্স থেকে বল ক্লিয়ার না করে পাস পাস খেলার ভুল কোন নভিশ ডিফেন্ডার ও করবে না। ফক্স সেই অসম্ভব ব্যাপারটাই করে দেখালেন এবং দলকে পিছিয়ে দিলেন। স্ট্যাটিসটিক্স বলছে উইলিয়াম যে ম্যাচে গোল করেন সে ম্যাচে তার দল হারেনা। স্ট্যাটিসটিক্স বদলানোর সুযোগ ব্রাইট বেশ কয়েকবার তৈরী করলেও অরিন্দমকে টপকানো তো দূর অরিন্দমকে একটা কঠিন সেভ করতে বাধ্য করার মতোও কেউ ফাওলারের দলে ছিলেন না।
ম্যাচের প্রায় শেষ লগ্নে মার্সেলিনহোর পায়ের পেশীতে টান ধরায় হাবাস তাকে তুলে নিয়ে জাভিকে নামাতে বাধ্য হলেন। ম্যাচের উননব্ব ই মিনিটের মাথায় কৃষ্ণ-জাভির যুগলবন্দী তে এলো এটিকেমোহনবাগানের তৃতীয় গোল। কৃষ্ণের বাড়ানো বলে জাভির যে হেডটা জালে জড়ালো সুব্রত পালের মতো অভিজ্ঞ গোলকীপারের কাছ থেকে সেই গোল সেভের আশা করাই যায়। সারা ম্যাচে অরিন্দমকে যেমন একটাও কঠিন বল ধরতে হয়নি সুব্রত পাল ও তেমন কোন কঠিন সেভ করতে পারলেন না। উল্টে দ্বিতীয় গোলের পেছনে সুব্রতর কমন সেন্সের অভাব ও বেশ প্রকট হয়ে উঠেছিলো। দেবজিত মজুমদার কিন্তু অসংখ্য কঠিন সেভ করে দলকে আজকের জায়গায় রেখেছেন। রেফারী দের নিয়ে যত কম বলা যায় তত ভালো। অঙ্কিত দুটো হলুদ কার্ড দেখেও মাঠে থেকে গেলেন। এদিকে বারংবার জঘন্যভাবে পা চালিয়ে ও গায়ে উঠে গিয়েও প্রীতম ও ঝিঙ্গান কার্ড দেখলেন অনেক দেরীতে। উল্টে ম্যাকহিউ কে যে কার্ডটা দেওয়া হলো তার পেছনে যুক্তিসঙ্গত কারন বোঝা গেলো না।যেমন বোঝা গেলো না ব্রাইটকে কার্ড দেখানোর কারনটা ঠিক কি? এফেসডিএল সম্ভবতঃ ফুটবলেও বিনোদন হিসাবে কমিক রিলিফ যোগ করা যায় এটাই দেখাতে চাইছে গোটা ফুটবল বিশ্ব কে। সেদিক থেকে কমেডিয়ান হিসাবে ভারতীয় রেফারীরা জনি লিভার, রাজপাল যাদব থেকে হাল আমলের পেশাদার স্ট্যান্ড আপ কমেডিয়ানদের ও জোর টক্কর দেবেন।
তবে রেফারী, প্রসেস এসব দিয়ে ফাওলার-গ্রান্ট দের আত্মপক্ষ সমর্থনের জায়গা নেই। রেফারীর বিরুদ্ধেও খেলতে হবে এটা মাথায় রেখে টিম সাজানোর যথেষ্ঠ সময় পেয়েছেন ফাওলার ও তার কোচিং স্টাফেরা।তারপরেও কেন দলে একজন দক্ষ স্কোরার নেই? কেন গোল আটকানোর জন্য একজন ধারাবাহিক ডিফেন্ডার নেই দলে? কেন ব্রাইটকে আটকে দিলে ফাঁকা জায়গাটা ধরার মতো কোন মিডিও নেই দলে? প্রশ্নগুলো কিন্তু উঠবে। প্রসেসের দোহাই দিয়ে প্রশ্নগুলোর গুরুত্ব কমানো যাবেনা। প্রসেসে আমাদির ভূমিকা কি? গোটা টুর্নামেন্টে প্রতিপক্ষের বক্সে বল ধরে শরীর দিয়ে বল শীল্ড করা ছাড়া আর কিছুই পাওয়া যায়নি। প্রসেসে ফিটনেসের অভাবে ভোগা ফক্স, মাঘোমা, পিলকিংটন এর ভূমিকা কি? কাল ফক্সের খেলায় ফিটনেসের অভাব স্পষ্ট। পিলকিংটন সারাক্ষন রেফারীর কাছে অভিযোগ করেই কাটালেন। মাঘোমার সেটপিস এটাকারদের কাছে অব্দি পৌছাচ্ছে না। অথচ এই বিদেশীরাই টুর্নামেন্টের এক পর্যায়ে প্রথম চারে যাওয়ার মতো আশ্বাস জাগিয়েছিলো। টুর্নামেন্টের শেষ ল্যাপে এসে এরাই বলের কাছে পৌছাতে পারছেনা। তাহলে এদের নিয়ে কি প্রসেস চালাতে চাইছেন ফাওলার? ইনভেস্টর হিসাবে শ্রীসিমেন্ট জলের মতো টাকা ঢালার পরেও কেন যোগ্য বিদেশী এলো না প্রশ্নটা সঙ্গত। ময়দানের মান্ধাতার আমলের মানসিকতার কর্তারা আইএসেলের স্ট্যান্ডার্ডের দেশী খেলোয়াড় নির্বাচন করতে পারেননি এই অজুহাতটাও অচল। শ্রীসিমেন্টের কোচিং টিমের কাছে জবাবদিহিতা চাওয়া উচিত। প্রসেসে আনফিট দের বাতিল করে সামনের বছরের জন্য দল সাজানো শুরু করুক ম্যানেজমেন্ট। প্রসেসটাকে প্রসেসের মতো অনুসরন করা হোক।