দানুব (Danube River) নদীর ভৌগোলিক স্রোতধারা মিউনিখের (Munich) কিছু দূর দিয়ে বুদাপেস্টের (Budapest) উদ্দেশ্যে বইতে থাকলেও, হাঙ্গেরিয়ানদের লড়াই-এর ঢেউ বুদাপেস্ট থেকে পৌঁছে গেছিলো মিউনিখে।
অত্যন্ত দুর্বল গতিতে আক্রমণ তুলে পাঁচ ডিফেন্ডারের পায়ের জঙ্গলে বারবার আটকে যাচ্ছিলো জার্মানরা। অপর দিকে দ্রুত গতির ফিরতি আক্রমণে জার্মান রক্ষণ যে ভঙ্গুর সেই ব্যাপারে বেশ পড়াশুনো করে এসেছিলো পুস্কাসের (Ferenc Puskás) উত্তরসূরীরা। ৫-৩-২ ছকে চূড়ান্ত রক্ষণাত্মক দল সাজিয়েছিলেন হাঙ্গেরির কোচ মার্কো রোসি (Marco Rossi)। একে নিজে খেলোয়াড় জীবনে ডিফেন্ডার ছিলেন, তার উপর ইতালীয় নাগরিক। আগের দুটি ম্যাচে পর্তুগাল এবং ফ্রেঞ্চদের মতো জার্মানদের-ও দমবন্ধ করে নিজের আত্মসিদ্ধির পরিকল্পনায় প্রায় সফল হয়ে গেছিলেন তিনি। আরেকটু হলে জোয়াকিম লো-র (Joachim Löw) ‘ডাই ম্যানশাফটের (Die Mannschaft)’ সাথে পনেরো বছরের সম্পর্কের ইতি ইউরো কাপের (UEFA EURO 2020) গ্ৰুপ স্টেজেই ঘটে যাচ্ছিল।
ম্যাচের শুরু থেকেই হাঙ্গারিয়ানরা শারীরিক ভাবে শক্তিশালী এবং সুশৃঙ্খল রক্ষণের পরিচয় দিছিলো। তাদের বক্সের মাথায় সমান্তরাল দুটো মানব প্রাচীর সাংগঠনিক ভাবে মজবুত থাকায় জার্মানরা গোটা ম্যাচের সিংহ ভাগ বিপক্ষ শিবিরে আড়াআড়ি পাস খেলে গেছে নিজেদের মধ্যে, ফলে বক্সের ভিতর ত্রাস সঞ্চারে ব্যর্থ হয়।
চার মিনিটের মাথায় জশুয়া কিমিচের (Joshua Kimmich) একটি সুক্ষ কোণা থেকে গোল করার প্রচেষ্টা হাঙ্গেরির গোলকিপার পিটার গুলাচি (Péter Gulácsi) সঠিক সময়ে নিচু হয়ে বাঁচিয়ে দেন। এরপরেই হাঙ্গেরির রোল্যান্ড সালাই (Roland Sallai) একটি দুর্দান্ত সুযোগ পেলেও, তার শট নেবার আগেই ম্যাট হামেলসের (Mats Hummels) একটি আলতো টোকা বল নিয়ে যায় তার নাগালের বাইরে।
এগারো মিনিটে গোল পেয়ে যায় হাঙ্গেরি (Hungary national football team)। সালাই-এর একটি দুরন্ত ক্রস হামেলস আর ম্যাথিয়াস গিন্টারের (Matthias Ginter) ঠিক মাঝে পেয়ে যায় তার অধিনায়ককে। হামেলসের হাঁটুর চোট থাকা সত্বেও তার উপর ভরসা করেছিলেন লো। কিন্তু বক্সের ভিতর হটাৎ দাঁড়িয়ে পড়েন তিনি। শরীর ছুঁড়ে অ্যাডাম স্জালাই-এর (Adam Szalai) অসাধারণ হেডার ম্যানুয়েল ন্যয়ারের (Manuel Neuer) আঙ্গুল ছুঁয়ে জালে জড়িয়ে যায় (১-০)। শুরু হয় হাঙ্গেরিয়ানদের অসাধ্য সাধনের লড়াই জেতার দ্বিতীয় ধাপ।
একুশ মিনিটে কিমিচের কর্নার থেকে হামেলসের ক্রস প্রতিহত হয় পোস্টে। এরপর থেকে জার্মানদের একঘেয়ে পাস পাস খেলা, আর হাঙ্গেরিয়ানদের কাউন্টার অ্যাটাকের অপেক্ষা। বল পেলেই একসাথে চার-পাঁচজন উঠে আসলেও। রক্ষণভাগ ঠায় দাঁড়িয়ে ছিল অতন্দ্র প্রহরীর মতন। ওদিকে ফ্রান্স-পর্তুগাল ম্যাচের সাথে পেণ্ডুলামের মতন দুলতে থাকে গ্রুপ এফ-এর সব কটি দলের ভাগ্য। কোনও অজানা কারণে প্রথম হাফে আগের ম্যাচের সেরা খেলোয়াড় রবিন গোজেন্সকে (Robin Gosens) মাঠের বাঁপ্রান্ত থেকে খুব একটা সচল হতে দেখা যায়নি। অধিকাংশ আক্রমণ ডানদিক দিয়েই হচ্ছিলো কিমিচ বা কখনো গিন্টারের মাধ্যমে।
বিরতির পর এক-আধখানা জার্মান আক্রমণের মাঝেই সালাই-এর আরেকটি জোরালো শট গোলপোস্টের বাইরের দিকে ধাক্কা খায়। এরই মাঝে কিছুটা সময় গ্রুপ এফ-এর অন্য ম্যাচে করিম বেনজেমার (Karim Benzema) জোড়া গোলের সৌজন্যে পর্তুগাল (Portugal national football team) পিছিয়ে থাকায় জার্মানদের আশার সঞ্চার হলেও, ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডোর (Cristiano Ronaldo) দ্বিতীয় পেনাল্টিতে সেটিও উবে যায়।
লেরয় সানে (Leroy Sané) ম্যাচের সিংহভাগটাই ছন্দহীন ফুটবল খেললেন। তাঁকে গোটা ম্যাচে মাঠে রাখার কারণ বোঝা যায়নি। গোটা ম্যাচে তাঁর অবদান বলতে বক্সের মাথায় ছোটাছুটি যার বেশিরভাগটাই অর্থহীন, জঘন্য সেটপিস এবং বক্সের মাথায় শিশুসুলভ হ্যান্ডবল করে দলকে বিপদে ফেলা। কোচ হয়তো তাঁর গতিকে কাজে লাগাতে চেয়েছেন। কিন্তু তাঁর গতি তার সতীর্থদের সাথে বেমানান ছিল। দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতে খেলোয়াড় পরিবর্তন না হলেও, কিমিচ অনেকটা মাঝখান থেকে খেলতে আরম্ভ করেন, ডান দিকে সরে যান সানে, সচল হয় বাম দিক। যদিও গোজেন্স তার আগের ম্যাচের ফর্ম খুঁজে পাননি। আটান্ন মিনিটে হয় প্রথম পরিবর্তন এবং বেশ আক্রমণাত্মক। ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার ইলকে গুন্দোয়ানের (İlkay Gündoğan) জায়গায় আসেন লেওন গোরেৎজকা (Leon Goretzka)।
৬৬ মিনিটে গোল পায় জার্মানি। গুলাচির (Péter Gulácsi) খারাপ আউটিংয়ের ফলে কিমিচের ক্রস হামেলসের মাথা ছুঁয়ে চলে যায় গোলের একদম সামনে ফাঁকায় দাঁড়ানো কাই হ্যাভর্ৎজের (Kai Havertz) কাছে। হেডে গোল করেন চেলসির (Chelsea F.C.) ফরওয়ার্ড (১-১)। গোলের আনন্দ করেই হ্যাভর্ৎজ জায়গা করে দেন টমাস মুলারের (Thomas Müller) জন্য।
জার্মানি পরের রাউন্ডে যাবার রাস্তা খোলার পরেই, সেন্টারলাইন থেকে যে খেলা শুরু হয়, তার থেকেই আন্ড্রিয়াস শ্যাফার (András Schäfer) ফের এগিয়ে দেন হাঙ্গেরিকে। জার্মান রক্ষণ গোটা ম্যাচে কখনোই জমাট মনে হয়নি। আবারো স্জালাই-এর পাস থেকে রক্ষণ কাঁধে নিয়ে জাতীয় দলের হয়ে নিজের দ্বিতীয় গোল করেন শ্যাফার (২-১)। যদিও সবচেয়ে দৃষ্টিকটু ছিল সুইপার-কীপার ন্যয়ারের (Manuel Neuer) আউটিং।
এরপর জার্মানি (Germany national football team) গতি বাড়াতে আরম্ভ করে। দায়িত্ব নেন টনি ক্রুজ (Toni Kroos)। ইংল্যান্ড ছেড়ে জার্মানির হয়ে খেলতে চাওয়া আঠেরো বছরের জামাল মুসিয়ালা (Jamal Musiala) মাঠে এসে তারুণ্যের সঞ্চার ঘটিয়েছিলেন। বায়ার্ন মিউনিখের (FC Bayern Munich) যুব প্রতিভা মাঠে আসার সাথে সাথেই তাঁর ছোঁয়ার সূত্র ধরেই গোল পায় জার্মানি। গোরেৎজকার দুরন্ত ভলিতে (২-২)। বাকি সময়টা জার্মানরা বল নিজেদের দখলেই রেখেছিলো।
রক্ষণ জমাট হলেই নিজেদের মধ্যে গতকাল ৭০০-র উপর পাস খেলা জার্মানরা আটকে যাচ্ছে, আর ফিরতি আক্রমণে তাদের রক্ষণের থরহরি কম্প। তিনটি ম্যাচ অধিকাংশ খেলোয়াড়ের অতি-পরিচিত এলিয়াঞ্জ এরেনাতে (Allianz Arena), নিজেদের সমর্থকদের সামনে খেলা জার্মানরা এবার পরীক্ষিত হবে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ওয়েম্বলি স্টেডিয়ামে (Wembley Stadium)। যৌন সংখ্যালঘুদের সমর্থনে মিউনিখের মেয়র স্টেডিয়ামকে এই ম্যাচের জন্য রামধনু রঙে সাজাতে চেয়েও উয়েফার অনুমতি পাননি। আর সমর্থন পেয়েও জার্মান দল মাঠে রং ছড়াতে পারলো না। বরঞ্চ তিন বারের ইউরো চ্যাম্পিয়নদের বিরুদ্ধে মন জিতে নিলো বিশ্ব ক্রমপর্যায়ে সাঁইত্রিশ নম্বরে থাকা মেগিয়ারকরা (Magyarok)।