প্রেক্ষাপট:
‘ein kampf zwischen brüdern’ – বাংলায় যার তর্জমা করলে দাঁড়ায় ভাইদের মধ্যে যুদ্ধ৷ এভাবেই বর্ণিত হয় বিশ্বকাপ ১৯৭৪ এর গ্রুপ লিগের পশ্চিম বনাম পূর্ব জার্মানির ম্যাচটি, যা বিভক্ত জার্মানির ইতিহাসে দুদেশের মধ্যে অনুষ্ঠিত একমাত্র ফুটবল ম্যাচ৷
এর আগে, ১৯৪৯ সালে পূর্ব জার্মানির প্রতিষ্ঠার পরবর্তী এক দশক, দুদেশের ক্লাব দলগুলি বিভিন্ন সময়ে নিজেদের মধ্যে উয়েফা পরিচালিত প্রতিযোগিতা বা ফ্রেন্ডলিতে মুখোমুখি হলেও, ষাটের দশকের শুরুতে কোল্ড ওয়ারজনিত রাজনৈতিক অস্থিরতা চরমে পৌঁছলে তা কমতে কমতে একেবারেই বন্ধ হয়ে যায়৷ ফলে ʼ৭৪ এর ৫ই জানুয়ারি ফ্র্যাঙ্কফুর্টে অনুষ্ঠিত ড্রয়ে, বার্লিনের একটি কয়্যার থেকে নির্বাচিত এক বালকের নিষ্পাপ হাতে গ্রুপ ১, অর্থাৎ আয়োজক পশ্চিম জার্মানির গ্রুপের বাকি দলগুলি নির্বাচনের সময় যখন উঠে এলো পূর্ব জার্মানির নামাঙ্কিত টোকেন, তা ড্রয়ে উপস্থিত ফুটবল মহলের বিশিষ্টদের মধ্যে যে বিস্ময় ও আবেগের বিষ্ফোরণ ঘটালো, তা ছড়িয়ে পড়তে সময় লাগলো না বার্লিন প্রাচীরের দুই পাশের ফুটবল ও রাজনৈতিক মহল সহ সমাজের প্রতিটি স্তরে৷ এ তো শুধুই একটি ম্যাচ নয়, এ তো ভাগ্যের ফেরে বিচ্ছিন্ন হওয়া দুই ভাইয়ের সাময়িক মিলন, ফুটবল যার মাধ্যমমাত্র৷
গ্রুপবিন্যাস ও সূচনাপর্ব:
আয়োজক দেশ হওয়ার সুবাদে পশ্চিম জার্মানি সরাসরি বিশ্বকাপে খেলার যোগ্যতা অর্জন করলেও, পূর্ব জার্মানিকে রোমানিয়া, ফিনল্যান্ড ও আলবেনিয়া সমৃদ্ধ গ্রুপ থেকে লড়াই করে অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হয়৷ ড্রয়ে গ্রুপের বাকি দুই দল হিসেবে উঠে আসে চিলি ও অস্ট্রেলিয়ার নাম৷ সূচী নির্ধারিত হওয়ার পর দেখা যায়, গ্রুপের শেষ রাউন্ডে হতে চলেছে এই মহাদ্বৈরথ, যার দিকে ততদিনে অধীর আগ্রহে তাকিয়ে সমগ্র ক্রীড়াজগৎ৷ উত্তেজনা আরো চরমে ওঠে বিশ্বকাপ শুরুর ঠিক আগে, ইউরোপিয়ান ফুটবল মরসুমের শেষ পর্যায়ে পূর্ব জার্মানির এফসি ম্যাগডেবার্গ এবং পশ্চিম জার্মানির ফুটবল দৈত্য বায়ার্ন মিউনিখ যথাক্রমে ইউরোপিয়ান কাপ উইনার্স কাপ ও ইউরোপিয়ান কাপ বিজয়ী হওয়ায়৷
শুরুটা দুই দলের পক্ষে বেশ নিরুপদ্রবেই হলো৷ পশ্চিম জার্মানি পল ব্রাইটনারের গোলে চিলিকে ও পূর্ব প্রান্ত ২-০ গোলে অস্ট্রেলিয়াকে পরাস্ত করলো৷ দ্বিতীয় ম্যাচে আয়োজক দেশটি ৩-০ ব্যবধানে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে জয়লাভ করলেও পূর্ব জার্মানিকে অপেক্ষাকৃত দুর্বল প্রতিপক্ষ চিলি ১-১ ফলাফলে রুখে দিল৷ ʼ৮২ সালের ‘Disgrace of Gijon‘ পূর্ববর্তী ফুটবল দুনিয়ায়, শেষ রাউন্ডের সব খেলা একসাথে পড়ার বাধ্যবাধকতা না থাকায় গ্রুপের তৃতীয় ও শেষ ম্যাচে চিলি ও অস্ট্রেলিয়া মুখোমুখি হওয়ার সাড়ে তিন ঘণ্টা পর দুই জার্মানির মহাম্যাচটি স্থিরীকৃত হয়৷ প্রথম খেলাটি গোলশূন্যভাবে শেষ হওয়ার সাথে সাথে দুই পড়শি দেশের পরবর্তী রাউন্ডে যাওয়া নিশ্চিত হয় ও ফুটবলীয় নিরিখে ম্যাচটি গুরুত্বহীন হয়ে পড়ে৷ কিন্তু ফুটবল কবেই বা শুধুমাত্র মাঠের ৯০ মিনিটে সীমাবদ্ধ ছিল! ফলে আপাতদৃষ্টিতে যা ছিল নিয়মরক্ষার একটি ম্যাচ মাত্র, উত্তেজনার পারদ ক্রমশ চড়তে চড়তে তাই হয়ে উঠলো সামাজিক ও রাজনৈতিক লড়াই, ক্যাপিটালিস্ট পশ্চিমের সাথে কমিউনিস্ট পূর্বের মর্যাদার যুদ্ধ৷
ডি-ডে:
অবশেষে দেখতে দেখতে চলে এলো ২২শে জুনের সেই বহু প্রতীক্ষিত মুহূর্ত৷ ৬০০০০ দর্শকে ঠাসা হামবুর্গের ফোকস্পার্কস্টাডিয়ন, যার মধ্যে ১৫০০ পূর্ব জার্মানি থেকে আগত নির্বাচিত অতিথিবৃন্দ৷ বলাই বাহুল্য, এঁরা প্রায় কেউই সাধারণ সমর্থক নন, সকলেই হয় সেদেশের সরকারী কর্তাব্যক্তি বা স্বৈরতান্ত্রিক সরকার ঘনিষ্ঠ সমাজের গণ্যমান্য প্রভাবশালী মানুষজন৷ দুবছর আগের মিউনিখ ম্যাসাকারের পর এটিই পশ্চিম জার্মানির মাটিতে হওয়া প্রথম বড়সড় খেলার আসর হওয়ায় নিরাপত্তায় কোন ফাঁক রাখলো না সেদেশের সরকার৷ ম্যাচের দিন সকাল থেকে স্টেডিয়ামের আশেপাশে পাহারায় বসে গেল সশস্ত্র পুলিশ বাহিনী, স্টেডিয়ামের মাথার ওপর চক্কর কাটতে শুরু করলো নজরদার হেলিকপ্টার৷
ফ্রান্জ বেকেনবাওয়ারের নেতৃত্বাধীন পশ্চিম জার্মানির কোচের দায়িত্বে হেলমুট শোন, যিনি ১৯১৫ সালে দেশের পূর্বপ্রান্তে অবস্থিত ড্রেসডেন শহরে জন্মগ্রহণ করলেও দেশভাগের পরে সোভিয়েত শাসনের রক্তচক্ষুর হাত থেকে পরিত্রাণের আশায় সপরিবার পশ্চিমে পালিয়ে আসেন৷ কিকঅফের ঠিক পূর্ব মুহুর্তে পুরো স্টেডিয়াম জুড়ে আচমকা শোনা গেল ‘ডয়েচল্যান্ড, ডয়েচল্যান্ড’ চিৎকার৷ রাজনৈতিক মতাদর্শগত ফারাক সত্ত্বেও দুদেশের মানুষের পরস্পরের প্রতি নিহিত যে চোরা ভাতৃত্ববোধ, এ ছিল তারই বহিঃপ্রকাশ৷
প্রথমার্ধ
উরুগুয়ের রেফারি রামন ব্যারেটো খেলা শুরুর বাঁশি বাজানোর মিনিটখানেকের মধ্যেই পরিষ্কার হয়ে গেল দুদলের মধ্যেই বইছে টেনশনের চোরাস্রোত৷ ম্যাচটিকে ঘিরে থাকা অপরিসীম সামাজিক তাৎপর্যের কারণেই হয়তো, উভয় পক্ষই অসম্ভব সাবধানে খেলা শুরু করলো৷ খেলা যত এগোতে থাকলো, আয়োজক দেশটি ধীরে ধীরে নিজেদের দাপট বাড়ালেও, গোলশূন্যভাবেই শেষ হলো প্রথমার্ধ৷
পুরো হাফের দুটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা, বেকেনবাওয়ারের পা ঘুরে আসা বল নিয়ে মার্কারকে ডজ করে গার্ড মুলারের সতীর্থ ফরওয়ার্ড ইউর্গেন গ্রাবস্কিকে দেওয়া মাপা স্কোয়্যার পাস, যা অল্পের জন্য পূর্ব জার্মান গোলরক্ষক ইউর্গেন ক্রয় ও গ্রাবস্কি দুজনকেই পরাস্ত করে গোলকিক হয়ে যায়৷ অপরদিকে পূর্ব জার্মানি পায় অর্ধের সেরা সুযোগটি৷ বাঁদিক থেকে হওয়া একটি নিরীহ থ্রো ইন থেকে বল পেলে, মিডফিল্ডার রাইনহার্ড লাউক ডি বক্সে চকিতে মাইনাস করেন৷ গোলরক্ষক জেপ মায়ার ও ডিফেন্ডার বার্নড্ কুলম্যানের মধ্যে একটি ছোট ভুল বোঝাবুঝির ফলে একদম অরক্ষিত গোলের সামনে পাসটি পেয়ে যান আক্রমণভাগের খেলোয়াড় হান্স ইউর্গেন ক্রাইশ৷ আশ্চর্যজনকভাবে, পুরো স্টেডিয়ামকে স্তম্ভিত করে দিয়ে ফাঁকা গোলে বলটি প্লেস করতে ব্যর্থ হন ডায়নামো ড্রেসডেনের হয়ে দেড়শোর ওপর গোল করা এই তারকা
দ্বিতীয়ার্ধ
বিরতিতে কোন পরিবর্তন আনলো না কোন দলই৷ দ্বিতীয়ার্ধেও শুরু থেকেই বিপক্ষের ওপর চাপ বজায় রাখলো পশ্চিম জার্মানি৷ তবে পূর্ব জার্মানি রক্ষণের সামনে একঝাঁক নীল জার্সির দেওয়াল তুলে রাখায় গ্রাবস্কির একটি দূরপাল্লার শট ও ব্রাইটনারের একটা দুর্বল ভলি ছাড়া কোন ওপেনিং পাওয়া সম্ভব হলো না বেকেনবাওয়ার, মুলার, উলি হোয়েনেসদের পক্ষে৷
ড্র যখন অবশ্যম্ভাবী মনে হচ্ছে, তখনি ৬৫ মিনিট নাগাদ ম্যাচের প্রথম পরিবর্তনটি আনলেন পূর্ব জার্মান কোচ গেয়র্গ বুশনার৷ মাঝমাঠের খেলোয়াড় হারাল্ড আর্মশারের পরিবর্তে মাঠে এলেন এরিখ্ হামান৷ পাল্টা চাল হিসেবে রিয়াল মাদ্রিদের মিডফিল্ডার গুন্টার নেটজারকে নামালেন শোন৷ ঠিক ১৩ মিনিট পর স্কোরলাইন বদলালো৷ডানদিক থেকে আসা একটি থ্রো থেকে বল পেলে, টার্ন নেওয়ার সুযোগ না থাকায় ব্যাকভলিতে ডি বক্সে ক্রস করার চেষ্টা করলেন উলি হোয়েনেস৷ কিন্তু পাসটি ব্লাইন্ড অ্যাঙ্গল থেকে করায় নিজের দলের কোন খেলোয়াড়ের মাথায় পড়ার বদলে তা সরাসরি চলে গেল পূর্ব জার্মান গোলরক্ষক ক্রয়ের হাতে৷ ডিরেক্ট থ্রোতে ক্রয় বল পাঠালেন একটু আগেই মাঠে নামা তরতাজা হামানের পায়ে৷ ডানপ্রান্ত বরাবর ফাঁকা জমি পেয়ে কিছুটা এগনোর পর পেনাল্টি বক্সের ঠিক মাথায় মাপা থ্রুটি যখন রাখলেন হামান, তখনো বিশেষ বিপদের গন্ধ পায়নি কেউ৷
নিজেদের বক্স থেকে দৌড় শুরু করে, মাঝমাঠের খেলোয়াড় ইউর্গেন স্পারওয়াসার যখন হামানের ফরওয়ার্ড পাসটি মিট করলেন, তখন বিপক্ষের তিনজনের বিরুদ্ধে তিনি একা৷ ধরার ঠিক পূর্বমুহুর্তে একটি অপ্রত্যাশিত বাউন্সের সম্মুখীন হওয়ায় বলটিকে ফার্স্ট টাচে রিসিভ করার চেষ্টা না করে হেড দিয়ে নিয়ন্ত্রণে আনলেন স্পারওয়াসার৷ কোনাকুনি দৌড়ে ছোট বক্সের কাছাকাছি পৌঁছনোর সাথে সাথে খেয়াল করলেন সামান্য স্লিপ করেছেন তাঁর ও বিপক্ষ গোলরক্ষক মায়ারের মাঝে থাকা একমাত্র ডিফেন্ডার বার্তি ফোকস্৷ কাউকে বিন্দুমাত্র রিয়্যাক্ট করার সুযোগ না দিয়ে মায়ারের মাথার ওপর দিয়ে বলটিকে জালে জড়াতে ভুল করলেন না তিনি৷
হতভম্ব গোটা স্টেডিয়াম, অবিশ্বাস মেশানো বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়লো দেড় হাজার সমর্থকসমৄদ্ধ পূর্ব জার্মান অ্যাওয়ে গ্যালারি৷ ম্যাচের গতির সম্পূর্ণ বিপরীতে গিয়ে এরকম একটা ঘটনা যে ঘটতে পারে, কয়েক মুহূর্ত আগেও আঁচ করতে পারেননি অভিজ্ঞ কোন ফুটবল বোদ্ধাও৷ অবশ্যম্ভাবী পরিণতি হিসেবে চাপ বাড়ালো আয়োজকেরা, আদায় হলো একের পর এক ফ্রিকিক আর কর্ণার৷ যদিও ক্রয়কে পরীক্ষা করার মতো মুহূর্ত তৈরী হলো না একবারও৷ আর বদলালো না স্কোর৷
মিনিট পনেরো বাদে যখন খেলাশেষের বাঁশি বাজালেন রেফারি, ততক্ষণে স্তম্ভিত গোটা ফুটবলবিশ্ব৷ ইউরোপের শ্রেষ্ঠ টিম পরাজয় বরণ করলো এমন এক স্বল্পখ্যাত দলের কাছে, যাদের ম্যাচের আগে ধর্তব্যের মধ্যেই আনেনি কেউ৷ আলিঙ্গনাবদ্ধ হলেন পূর্ব জার্মানির খেলোয়াড়েরা, ঐতিহাসিক এই মুহূর্তকে একেবারে সামনে থেকে ফ্রেমবন্দী করে রাখতে মাঠের মধ্যেই ঢুকে পড়লেন একগুচ্ছ ফটোগ্রাফার৷
দ্বিতীয় রাউন্ড ও বাকি বিশ্বকাপ:
এই অপ্রত্যাশিত জয়ের ফলে শীর্ষস্থান দখল করে গ্রুপের খেলা শেষ করলো পূর্ব জার্মানি৷ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এর ফলে পরবর্তী রাউন্ডে তুলনামূলকভাবে সহজ প্রতিপক্ষ পাওয়া গেলেও, মন্দ ভাগ্য তাদের ফেললো ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা ও ক্রুয়েফের হল্যান্ডের গ্রুপে৷ প্রথম দুটি ম্যাচ ব্রাজিল ও হল্যান্ডের কাছে হারার পর, নিয়মরক্ষার শেষ ম্যাচে আর্জেন্টিনার বিরুদ্ধে ড্র করে বিশ্বকাপ থেকে বিদায় নিল তারা৷ অপরদিকে পশ্চিম জার্মানি সুইডেন, পোল্যান্ড ও ইউগোস্লাভিয়াকে সহজেই হারিয়ে ফাইনালে ওঠার পর হল্যান্ডকে পরাজিত করে উরুগুয়ে, ইটালি ও ইংল্যান্ডের পর চতুর্থ দেশ হিসেবে আয়োজক হয়ে বিশ্বকাপ ঘরে তোলার দুর্লভ কৃতিত্ব অর্জন করলো৷ বহুল প্রচলিত সেই উদ্ধৃতিটি ধার করে বলা যায়, ‘East won the battle, but West won the war’৷
তাৎক্ষণিক রাজনৈতিক প্রভাব ও পরবর্তী অধ্যায়:
বিশ্বকাপ শেষ হয়ে গেলেও, প্রত্যাশিতভাবেই, প্রতিদ্বন্দ্বী ও রাজনৈতিক শত্রু পড়শি দেশের বিরুদ্ধে এই জয় যে শুধুই মাঠের জয় নয়, তা যে ধনতান্ত্রিক অপশক্তির বিরুদ্ধে সমাজতন্ত্রেরও জয়, এই সরকারী প্রোপাগ্যান্ডা বেশ কিছুদিন ভেসে বেড়ালো সোভিয়েত প্রভাবাধীন পূর্ব জার্মানির বাতাসে৷ অংশগ্রহণকারী খেলোয়াড়দের প্রত্যেককে সরকারের তরফ থেকে গাড়ি,বাড়ি ও অর্থের মাধ্যমে পুরস্কৃত করার খবর শোনা গেলেও পরবর্তীকালে তাঁরা এর অসত্যতা নিশ্চিত করেন৷ তবে সবচেয়ে নাটকীয় ও দুর্ভাগ্যজনক ঘটনাটি ঘটে স্ট্রাইকার হান্স ইউর্গেন ক্রাইশের জীবনে৷
দ্বিতীয় রাউন্ডে ব্রাজিলের মুখোমুখি হওয়ার জন্য হ্যানোভার যাওয়ার পথে বিমানে তাঁর সাথে আলাপ হয় পশ্চিম জার্মানির তৎকালীন অর্থমন্ত্রী হান্স অ্যাপেলের৷ কথা প্রসঙ্গে দুজনের মধ্যে ইয়ার্কিচ্ছলে বাজি হয় যে পশ্চিম জার্মানি যদি চ্যাম্পিয়ন হয়, তাহলে অ্যাপেল ক্রাইশকে পাঁচ বোতল হুইস্কি উপহার দেবেন৷ টুর্নামেন্ট শেষ হওয়ার পর পূর্ব প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী অ্যাপেল পশ্চিম জার্মানিতে অবস্থিত পূর্ব জার্মানির অ্যাম্ব্যাসেডর মারফত ক্রাইশের কাছে সেই উপহার পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করেন৷ বোতলগুলি পাওয়ার পর ক্রাইশ সাত পাঁচ না ভেবে বন্ধুবান্ধবদের ডেকে সকলে মিলে সেই হুইস্কি পান করেন৷
সপ্তাহখানেক পর অ্যাপেলের অফিসে একটি অদ্ভুত চিঠি আসে৷ এই চিঠি থেকেই অ্যাপেল অবহিত হন যে তাঁর উপহার ক্রাইশকে বিপদে ফেলেছে৷ বহুদিন পরে, কথা প্রসঙ্গে ক্রাইশ তাঁকে জানান চিঠিটি লিখেছিল পূর্ব জার্মানির কুখ্যাত সিক্রেট সার্ভিস এজেন্সি স্টাসি, এবং তারা ক্রাইশের ওপর চাপ সৃষ্টি করে তাঁকে সেই চিঠিতে সই করতে বাধ্য করে৷ উপহারের সাথে অ্যাপেল ক্রাইশকে একটি চিঠি পাঠান, যাতে একটি লাইন ছিল “আশা করি শীঘ্রই আমাদের আবার দেখা হবে”৷ এই লাইনটিই ক্রাইশের ক্যারিয়ারে চরমতম সর্বনাশ ডেকে আনে৷ দুবছর পর ‘৭৬ এর মন্ট্রিয়ল অলিম্পিকে পূর্ব জার্মানি ফুটবলে সোনা জেতে৷ দেশের লিগে সেই মরসুমের সর্বোচ্চ গোলদাতা হওয়া সত্ত্বেও, আশ্চর্যজনকভাবে সেই দল থেকে বাদ পড়েন ক্রাইশ৷ ২০০৪ সালে নিজের স্টাসি ফাইলটি পড়ার সময় তিনি জানতে পারেন তাঁর ডাক না পাওয়ার পেছনে ছিল ঐ উপহার, বিশেষত সেই একটি লাইন৷ এই লাইনটি থেকে স্টাসি এই সিদ্ধান্তে আসে যে, ক্রাইশ পশ্চিম জার্মানির চর৷ তাঁর ওপর গোপন নজরদারি শুরু হয় ও তিনি চিরকালের জন্য জাতীয় দল থেকে নির্বাসিত হন৷
১৯৮৮ সালে ব্ল্যাক ফরেস্ট সংলগ্ন অঞ্চলে একটি ভেটারেন্স টুর্নামেন্ট খেলতে গিয়ে স্ত্রী কন্যা সহ সপরিবারে পশ্চিমে পালিয়ে যান ‘৭৪ এর সেই ম্যাচটির একমাত্র গোলদাতা, জাতীয় নায়ক ইউর্গেন স্পারওয়াসার৷
১৯৯২ ইউরোর যোগ্যতাঅর্জন পর্বে আবার দুই জার্মানি এক গ্রুপে পড়ে৷ ইতিমধ্যে দুই দেশ তথা ইউরোপের রাজনীতিতে একের পর এক উত্থানপতন হয়৷ ১৯৮৯ এর নভেম্বরে বার্লিন প্রাচীর পতনের ঠিক দশ মাস পর, ১৯৯০ এর সেপ্টেম্বরে পূর্ব জার্মানি বেলজিয়ামের বিপক্ষে তাদের শেষ আন্তর্জাতিক ম্যাচটি খেলে৷ এর সপ্তাহতিনেক পর, ৩রা অক্টোবর দীর্ঘ ৪১ বছরের বৈরীতা মুছে দুই জার্মানি পুনরায় একত্রিত হয়৷ ভাইদের মধ্যে যুদ্ধের অবসান ঘটে৷
তথ্যসূত্র ও ছবি: দিজফুটবলটাইমস,বিবিসি ও অন্যান্য অনলাইন আর্টিকল