ফিফা ক্রমপর্যায়ে বিশ্বের এক নম্বর দেশের এই সোনালী প্রজন্ম নিয়ে বেলজিয়ানদের আশা অপরিসীম। ২০১৮ বিশ্বকাপের সেমিফাইনালিস্টরা সেন্ট পিটার্সবার্গে (Saint Petersburg) এসেছিলো তাদের গুরুত্বপূর্ণ দুই সদস্য কেভিন দে ব্রুইনে (Kevin De Bruyne) আর অ্যাক্সেল উইটসেল-কে (Axel Witsel) ছাড়াই। দে ব্রুইনে উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লীগ ফাইনালে পাওয়া তার নাকের চোট সম্পূর্ণ সারিয়ে উঠতে পারেনি, আর উইটসেল জানুয়ারি মাসে আচিলেস টেন্ডন ছিড়ে যাবার পর থেকে মাঠের বাইরে। ইডেন হ্যাজার্ডও (Eden Hazard) মাঠে নামেন সত্তর মিনিটে, যদিও তার দ্বিতীয় কনিষ্ঠ ভাই থরগান হ্যাজার্ড খেলেন শুরু থেকেই। যদিও ক্রেস্টভস্কি স্টেডিয়ামে (Krestovsky Stadium) বেলজিয়ামের জয় নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে এই ত্রিমূর্তির অনুপস্থিতি উপলব্ধি করা যায়নি।
দুই দেশের কোচ-ই ২০১৮ বিশ্বকাপ থেকে দলের সাথে রয়েছেন। পুঙ্খানুপুঙ্খ চেনেন দলের খেলোয়াড়দের। রুশ কোচ স্তানিস্লাভ চেরচেসোভ (Stanislav Cherchesov) ম্যাচের চৌষট্টি মিনিটের মধ্যেই পাঁচটা পরিবর্তন নিয়ে নেন, যার মধ্যে দুটি প্রথমার্ধেই। যদিও ম্যাচে তার প্রভাব বিশেষ ছিল না। অপরদিকে রবের্তো মার্টিনেজের (Roberto Martínez) দল নির্বাচনে শুরু থেকেই আত্মপ্রত্যয়ের বহিঃপ্রকাশ।
বেলজিয়ামের শুরুটা নড়বড়ে হলেও ম্যাচের দশ মিনিটেই পড়ে পাওয়া চোদ্দ আনাকে ষোলো আনায় পরিণত করলেন বেলজিয়ামের হয়ে শেষ পনেরো আন্তর্জাতিক ম্যাচে উনিশ গোল করা রমেলু লুকাকু (Romelu Lukaku)। মাঝমাঠ থেকে টিমোথি কাস্তানিয়া-র ভাসানো বল যখন রাশিয়ার বক্সে এসে পড়ছে, তখন লুকাকু পরিষ্কার অফসাইডে। কিন্তু, ভার পরীক্ষার (VAR check) সময় স্পষ্ট দেখা যায়, বল লুকাকুর পায়ে পড়ার আগে রাশিয়ার এক ডিফেন্ডারের গায়ে লাগে, ফলে অফসাইডের প্রশ্ন ওঠে না। চমৎকার হাফটার্নে রাশিয়ার জালে বল জড়াতে ভুল করেননি লুকাকু (১-০)।
২৬ মিনিটে হেড করতে উঠে রাশিয়ার দালের কুজায়েভের সঙ্গে সংঘর্ষে চোখে চোট পান টিমোথি কাস্তানিয়া (Timothy Castagne)। বেলজিয়ামের পক্ষে খারাপ খবর, এই চোটের ফলে পুরো ইউরো থেকেই ছিটকে গেলেন লেস্টার সিটির এই ফুল ব্যাক।
ম্যাচের ৩৪ মিনিটে দ্বিতীয় গোলটি করেন কাস্তানিয়া-র পরিবর্তে নামা টমাস মুনিয়ে (Thomas Meunier), বিপক্ষ গোলকিপার অ্যান্টন শুনিনের (Anton Shunin) বদান্যতায়। রাশিয়ান বক্সের বাঁপ্রান্তের ঠিক বাইরে থেকে থর্গান হ্যাজার্ডের (Thorgan Hazard) ভেসে আসা ক্রস ঠিক করে ক্লিয়ার করতে পারেননি রাশিয়ান গোলরক্ষক শুনিন। ঠান্ডা মাথায় ফিরতি বলে গোল করে যান সাত মিনিট আগে মাঠে নামা মুনিয়ে (২-০)। ইউরোর ইতিহাসে মুনিয়ে প্রথম ফুটবলার, যিনি পরিবর্ত হিসেবে নেমে প্রথমার্ধেই গোল করলেন।
ইয়ানিক কারাস্কো (Yannick Carrasco) একক দক্ষতায় বারংবার রুশ রক্ষণের ভিত কাঁপিয়ে দিচ্ছিলেন। তবে ম্যাচের তিন নম্বর গোলটি আসে আবারও টমাস মুনিয়ে-র দক্ষতায়। ইন্টার মিলানের গোলমেশিন লুকাকু ম্যাচের শেষ লগ্নে তিন নম্বর গোলটিও করে ফেলেন, মাঝমাঠ থেকে সেই মুনিয়েরের দুরন্ত থ্রু-পাস ধরে (৩-০)। লুকাকুর টার্নিং তুলনায় দুর্বল হলেও শরীর ব্যবহার করে ডিফেন্ডারদের আড়াল করার পারদর্শিতা তাকে বক্সের ভিতর ভয়ংকর করে তোলে।
ম্যাচের দুই-তৃতীয়াংশের উপর কর্তৃত্ব ছিল বেলজিয়ামের। নিজেদের মাঠে রাশিয়ানরা শুরু থেকেই গুটিয়ে ছিল। সেট-পিসগুলি ছাড়া বিশ্বের আটত্রিশ নম্বর দেশের আক্রমণভাগকে বড়ো অসহায় আর পরিকল্পনাহীন লেগেছে। আর্টেম জিউবা এবং আলেক্সান্দ্র গোলভিন চেষ্টা চালিয়ে গেলেও তা যথেষ্ট ছিল না।
বেলজিয়ান মাঝমাঠের দাপটে স্পুটনিক ভি ভ্যাকসিনের দেশের মিডফিল্ডারদের ‘ইমিউনিটি’-র অভাব দেখা গেছে। এর আগের দুটি সাক্ষাতেই বেলজিয়ানরা পূর্ব ইউরোপের বিপক্ষকে তিন গোলের ব্যবধানে হারিয়েছিল। পুরো ম্যাচে থিবো কুর্তোয়াকে (Thibaut Courtois) সেভাবে কঠিন পরীক্ষার মুখে পড়তেই হয়নি। বেলজিয়াম-ও সর্ব সাকুল্যে চারটি শট গোলে রাখলেও, তাদের খেলায় ছিল প্রশ্নাতীত আধিপত্য।
তবে ম্যাচের সেরা মুহূর্ত তৈরী হয়, যখন ম্যাচের সেরা লুকাকু তার প্রথম গোলটি উৎসর্গ করেন ইন্টার মিলানে তাঁর সহ-খেলোয়াড় ক্রিস্টিয়ান এরিকসনের সুস্থতা কামনা করে, যিনি ঘন্টাখানেক আগেই ডেনমার্ক বনাম ফিনল্যান্ড ম্যাচে মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছেন। গোল করেই ক্যামেরার সামনে এসে লুকাকুর উচ্ছ্বাস – “Chris, Chris! Stay Strong. I love you” – বোধহয় এবারের ইউরোর স্মরণীয় মুহূর্তগুলোর মধ্যে একটা হয়ে থাকবে।