গতকালের এটিকে মোহনবাগান বনাম মুম্বাই সিটি এফসি ম্যাচ দিয়ে শেষ হলো এবারের আইএসএলের প্রথম লেগের খেলা। লীগ টেবিলের ২ বনাম ১ এর খেলা, স্বভাবতই ম্যাচে জোরদার লড়াই হবে, উত্তেজনাও থাকবে, এ তো জানা কথাই। অনেক আশা নিয়েই টিভির সামনে বসেছিলেন ফুটবল অনুরাগীরা। খেলার গুনগত মান যেমনই হোক না কেন, ম্যাচে এটিকে মোহনবাগানের খেলোয়াড়দের অখেলোয়াড়োচিত আচরণ এবং অভব্যতায় ক্ষোভে ফেটে পড়েন দেশের বিভিন্ন প্রান্তের দর্শকরা।
গতকাল প্রথম থেকেই ম্যাচের রাশ ছিল মুম্বাই সিটি এফসির হাতে। পুরো ম্যাচে এটিকে মোহনবাগান তিনকাঠির মধ্যে শট নিতে পেরেছে মাত্র একটি। বল পজেশন মুম্বাই এফসির অনুকূলে ৬৮-৩২। ম্যাচের একমাত্র গোলটি আসে ৬৯ মিনিটে, মুম্বাই এফসি স্ট্রাইকার ওগবেচের পা থেকে।
স্বাভাবিকভাবেই হতাশা গ্রাস করছিলো অরিন্দম, তিরি, শুভাশিস, সন্দেশ ঝিঙ্গানদের। তারই বহিঃপ্রকাশ ঘটে ইনজুরি টাইমে। ম্যাচের বয়স তখন প্রায় ৯৩ মিনিট। অতিরিক্ত সময়ের তখন আর মাত্র দুমিনিট খেলা বাকি। মুম্বাই এফসির ডানপ্রান্ত ধরে আক্রমণে উঠতে থাকেন ২৩ বছর বয়সী জাপানিজ মিডফিল্ডার সাই। এটিকে মোহনবাগানের কর্নার ফ্ল্যাগের কাছে প্রথমে তাঁকে পিছন থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেন এটিকে মোহনবাগানের শুভাশিস বোস। কিন্তু তাতেই ক্ষান্ত থাকেননি শুভাশিস। সোজা দাঁড়িয়ে পড়েন সাইয়ের পায়ের উপর। হ্যান্ডশেকের দূরত্বে তখন দাঁড়িয়ে সহকারী রেফারি। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে পতাকা তুললেন না তিনি।
ততক্ষণে হারের হতাশায় এটিকে মোহনবাগানের খেলোয়াড়দের মেজাজ চরমে। নিজেদের ব্যর্থতার ক্ষোভ তাঁরা উগরে দেন ১৮ বছর বয়সী প্রতিশ্রুতিবান মিডফিল্ডার, ভারতের হয়ে অনূর্ধ্ব-১৬ এএফসি চ্যাম্পিয়নশিপ খেলা বিক্রমপ্রতাপ সিংয়ের উপর। ফুটবলের মাঠ তখন যেন কুস্তির আখড়া। প্রথমে শুভাশিস ছুটে এসে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেন বিক্রমকে। এরপর একে একে চড়াও হন তিরি, অরিন্দম, সন্দেশরা। মাটিতে পড়ে কাতরাতে থাকা বিক্রমকে জার্সি ধরে টেনে তুলে আছাড় মারেন এটিকে মোহনবাগানের স্প্যানিশ ডিফেন্ডার তিরি। এরপর অরিন্দমের পালা। হারের লজ্জা ভুলে ততক্ষণে তিনি গোল ছেড়ে দৌড়ে এসেছেন বিক্রমকে শাসাতে। তবে অভব্যতামির এখানেই শেষ নয়। বিক্রমপ্রতাপ যখন যন্ত্রণায় ছটফট করছেন, সেই সময় সন্দেশ ঝিঙ্গান এসে বিক্রমকে লাথি মারেন। এই সব কিছুই স্পষ্টভাবে লাইভ খেলা চলাকালীনই ক্যামেরায় ধরা পড়ে।
এরপরেই ক্ষোভে ফেটে পড়ে সোশ্যাল মিডিয়া। এই বছর এমনিতেই দর্শকশূন্য স্টেডিয়ামে ম্যাচ হওয়ায় সমর্থকদের আবেগের বিচ্ছুরণ ঘটছে ফেসবুক, টুইটার, ইনস্টাগ্রাম, হোয়াটসআপ জুড়ে। রেফারিদের মেরুদন্ডহীনতা এবং অকর্মণ্যতার প্রতিবাদে মুহুর্মুহু টুইট করতে থাকেন দেশের সমস্ত প্রান্তের ফুটবলপ্রেমীরা।
এটিকে মোহনবাগান বনাম মুম্বাই এফসি ম্যাচ কিন্তু অনেকগুলো প্রশ্ন তুলে দিয়ে গেল:
কিভাবে এটিকে মোহনবাগানের খেলা দশটি ম্যাচের মধ্যে চারটিতেই (এসসি ইস্টবেঙ্গল, জামশেদপুর এফসি, বেঙ্গালুরু এফসি এবং মুম্বাই সিটি এফসি) রেফারি হিসাবে বাঁশিমুখে নেমে পড়লেন সিআর শ্রীকৃষ্ণা? নেহাৎই কাকতালীয় নাকি এর পিছনে অন্য কোনও সমীকরণ কাজ করছে?
কিভাবে শুভাশিস বোস বুটের স্টাড দিয়ে সাইয়ের উপর দাঁড়িয়ে পড়লেও সহকারী রেফারী ফাউলটুকু অব্দি দিলেন না? পরে দ্বিতীয়বার বল ছাড়া বিক্রমকে ধাক্কা মেরেও কেবলমাত্র হলুদ কার্ড দেখেই কি করে পার পেয়ে গেলেন তিনি?
কিভাবে বিক্রমপ্রতাপকে জার্সি ধরে আছাড় মেরেও প্রথমে তিরি এবং তারপর লাথি মেরেও সন্দেশ ঝিঙ্গান কোনওরকম শাস্তি ছাড়াই পার পেয়ে গেলেন?
এআইএফএফের শৃঙ্খলারক্ষা কমিটি যদি এসসি ইস্টবেঙ্গল – গোয়া ম্যাচের রেফারি অরুমুগান রোওয়ানের ভুল লালকার্ড দেখানোর সিদ্ধান্তকে যুক্তিসঙ্গতভাবেই পর্যালোচনা করে, ভিডিও ফুটেজ দেখে সঠিক বিচার দিতে পারেন, তাহলে গতকালের ম্যাচে এটিকে মোহনবাগানের খেলোয়াড়দের অভব্য আচরণকে কেন প্রশ্রয় দেওয়া হচ্ছে? কেন ব্রডকাস্টার ষ্টার স্পোর্টসের ভিডিও ফুটেজ দেখে কঠোরতম শাস্তি দেওয়া হচ্ছে না? নাকি তদানীন্তন এটিকে এফসি এবং মোহনবাগানের মার্জারের ফলে পুরোনো অস্তিত্ব মুছে নতুন পরিচয়ে যাত্রা শুরু করা এটিকে মোহনবাগানের একশ্রেণীর সমর্থকের “রিমুভ এটিকে” প্রচারের মুখ বন্ধ রাখতেই এআইএফএফ এবং এফএসডিএলের দেখেও না দেখার ভান করা?
ম্যাচে পয়েন্ট নষ্ট করার পরিস্থিতি আসলেই দেখা যাচ্ছে এটিকে মোহনবাগানের খেলোয়াড়দের দাঁতনখ বেরিয়ে পড়ছে। এর আগেও হায়দ্রাবাদ এফসির বিরুদ্ধে ম্যাচে দেখা গেছে একই দৃশ্য। ১-১ গোলে ড্র হওয়া ঐ ম্যাচেও প্রবীর দাস সজোরে লাথি মারেন হায়দ্রাবাদের ১৯ বছর বয়সী আকাশ মিশ্রের মুখে। তাও আবার রিজার্ভ বেঞ্চের ঠিক সামনে যেখানে চতুর্থ রেফারি বসেন। তবুও রেফারি হলুদকার্ড দেখিয়েই ছেড়ে দেন প্রবীরকে।
এটিকে মোহনবাগানের খেলোয়াড়দের এই মারকুটে মনোভাব, অখেলোয়াড়োচিত আচরণে সারাদেশের ফুটবল মহলেই ছিছিকার পড়ে গেছে। তাঁরা এতদিন বিভিন্ন নিউজ মিডিয়াতে দেখেছেন একশ্রেণীর মোহনবাগান সমর্থকদের অভব্য আচরণ এবং তাদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে তৎকালীন মোহনবাগান কর্তাদের গৃহযুদ্ধ। কখনও আধলা ইঁট ছুঁড়ে রহিম নবীর মাথা ফাটানো, কখনো মোহনবাগান গ্যালারীতে বসে ম্যাচের মধ্যেই মদ্যপান, কখনও মেট্রোতে নারীনিগ্রহ, কখনও গ্যালারীতে বিপক্ষ দলের মহিলা সমর্থকদের সঙ্গে অসভ্য আচরণ, তো আবার কখনও ইস্টবেঙ্গলের শতবর্ষ উপলক্ষে বানানো তোরণ ভাঙা। সর্বশেষ নোংরামো শিলিগুড়িতে ইস্টবেঙ্গল সমর্থকদের দেওয়ালে বানানো গ্র্যাফিটিতে কদর্য গালাগালি লিখে আসা। এর সাথে পাল্লা দিয়ে আছে কর্মকর্তাদের গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব। এটিকে সঙ্গে মার্জারের আগে যে ঐতিহ্যপূর্ণ মোহনবাগান ক্লাব ছিল, ২০১৮ সালের এজিএমে দুপক্ষের হাতাহাতিতে তার গায়ে লাগে কালির দাগ। প্রবীণ নিষ্ঠাবান মোহনবাগান সভ্য সমর্থকরাও এই হুলিগানিজম মেনে নিতে পারেন না।
কিন্তু দেশের ফুটবলপ্রেমীদের অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন, তাহলে কি মার্জারের পর পুরোনো মোহনবাগানের অসভ্যতামির ভূত এবারে চেপে বসলো তিনবারের আইএসএল চ্যাম্পিয়ন এটিকের ঘাড়ে? গতবছরও যে এটিকে আইএসএলের ফেয়ার প্লে টেবিলের এক নম্বরে ছিল, সেই টিমের প্লেয়াররাই তো এবারেও খেলছেন। তাহলে তাঁদের আচরণে হঠাৎ এই পরিবর্তন কেন? যে সন্দেশ জিঙ্গানকে এই মুহূর্তে সুনীল ছেত্রীর পরে ভারতীয় ফুটবলের দ্বিতীয় ব্র্যান্ড আম্বাসাডর বলে গণ্য করা হয়, তিনি এত সিনিয়র হয়ে কেন হাঁটুর বয়সী এক খেলোয়াড়ের সঙ্গে এরকম ঘৃণ্য আচরণ করলেন? তাহলে কি মোহনবাগানের অপসংস্কৃতিই গ্রাস করলো তিলে তিলে গড়ে তোলা সঞ্জীব গোয়েঙ্কার সাধের এটিকে-কে? উত্তর ভবিষ্যৎ দেবে।
তবে এআইএফএফ এবং এফএসডিএল তথা নীতা আম্বানীর সামনে এখন সবচেয়ে বড়ো চ্যালেঞ্জ বিশ্বের দরবারে দেশের সবচেয়ে বড় লীগের গ্রহণযোগ্যতা বজায় রাখা। এমনিতেই লিভারপুল লেজেন্ড রবি ফাউলার এসসি ইস্টবেঙ্গলের কোচ হয়ে আসার পর আইএসএলের জনপ্রিয়তা, আন্তর্জাতিক মিডিয়া কভারেজ একধাপে বেড়ে গেছে অনেকটাই। স্কাই স্পোর্টস, রয়টার্সের মতো মিডিয়া হাউজ এসসি ইস্টবেঙ্গলের জন্য আইএসএলের খবর করছেন।
এরমাঝে কিছু কিছু রেফারির অপদার্থতা এবং কয়েকজন ফুটবলারের অখেলোয়াড়োচিত আচরণ যে আইএসএলের ইমেজকে অনেকটাই ধাক্কা দিচ্ছে, তা বলাই বাহুল্য।
ভারতীয় ফুটবল মহল এখন তাকিয়ে এআইএফএফের শৃঙ্খলারক্ষা কমিটির দিকে। তাঁরা কি ফুটবলের স্বার্থে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে অপরাধী ফুটবলাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেবেন নাকি এবারেও ঠুঁটো জগন্নাথ হয়ে বসে থেকে আইএসএলকে হাস্যস্পদ করে তুলবেন, সেটাই এখন দেখার।
ক্ষোভে ফুঁসছে টুইটারঃ