আইএসএল ২০২০-২১ এর প্রথম লেগ শেষ। দ্বিতীয় লেগেও প্রতিটা দল কমপক্ষে একটা করে ম্যাচ খেলে ফেলেছে। লীগ পর্যায়ের ম্যাচ শেষ হতে হতে ফেব্রুয়ারীর শেষদিন হলেও ধীরে ধীরে সব টিমই শেষ চারের ছক কষতে শুরু করে দিয়েছে।
সবার শেষে আইএসএলের টিকিট কাটা এসসি ইস্টবেঙ্গল শুরুটা ভালো না করলেও একটু হলেও গিয়ার বদলাতে শুরু করেছে। তারই প্রমাণ প্রথম পাঁচ ম্যাচের মধ্যে চারটেতেই হারা, দশ গোল হজম করা টিমটাই শেষ ছটা ম্যাচে অপরাজিতই শুধু নয়, বিপক্ষের জালে বলও জড়িয়েছে নয়বার।
কিন্তু লীগ এবার সেই পর্যায়ে ঢুকতে শুরু করেছে, যেখানে লাল-হলুদ সমর্থকদের চোখ শুধু নিজেদের পয়েন্টের দিকেই থাকে না, বরং মনে মনে অংক কষাও শুরু হয়ে যায়। সেই অংকের রেশ ধরেই একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে সপ্তাহের শুরুতে বাম্বোলিমের জিএমসি স্টেডিয়ামে নামতে চলেছে রবি ফাউলারের ছেলেরা।
এসসি ইস্টবেঙ্গল:
ইস্টবেঙ্গলের জন্য ম্যাচটা গুরুত্বপূর্ণ অনেকগুলো কারণে। এই মুহূর্তে ১১ ম্যাচ খেলে ফাউলার বাহিনীর সংগ্রহ ১১ পয়েন্ট। সমসংখ্যক ম্যাচ খেলে বেঙ্গালুরু এফসি ১৩ পয়েন্টে এবং এই ম্যাচের প্রতিপক্ষ চেন্নাইয়ান এফসি ১৪ পয়েন্টে। একটা করে ম্যাচ বেশী খেলে নর্থইস্ট ইউনাইটেড ১৫ পয়েন্টে, জামশেদপুর এফসি ১৩ পয়েন্টে। অর্থাৎ আক্ষরিক অর্থেই লীগের অবস্থা এখন সাপ-লুডোর মতো। একটু অসতর্ক হয়ে পা হড়কালেই পিছিয়ে পড়ার সম্ভাবনা। এই ম্যাচে জিতলেই ১৪ পয়েন্ট নিয়ে এসসি ইস্টবেঙ্গল ছুঁয়ে ফেলবে চেন্নাইয়ান এফসিকে। নিঃশ্বাস ফেলবে এই মুহূর্তে ১৬ পয়েন্ট নিয়ে চতুর্থ স্থানে থাকা হায়দ্রাবাদ এফসির ঘাড়ে। আর কে না জানে, আপামর ইস্টবেঙ্গল জনতার পাখীর চোখ কিন্তু আপাতত লীগ টেবিলের ওই চার নম্বর জায়গাটাই।
এসব তো গেল সংখ্যাতত্ত্বের কচকচানি। এবারে আসা যাক ম্যাচের প্রসঙ্গে। এমনিতে তিন সপ্তাহ আগের যে এসসি ইস্টবেঙ্গল বক্সিং ডে’তে মুখোমুখি হয়েছিল দক্ষিণের দলটির, তার সাথে আজকের ইস্টবেঙ্গলের পার্থক্য অনেকটাই। সেই ম্যাচের আগে লাল-হলুদ সমর্থকদের মধ্যে আলোচনার বিষয়বস্তু ছিল রবি ফাউলার আর তাঁর কোচিং টিমের নয়জন দেশী ফুটবলারকে ছাড়ার সিদ্ধান্ত। কিন্তু জানুয়ারী ট্রান্সফার উইন্ডোতে আসা ব্রাইট এনোবাখারে, রাজু গায়কোয়াড়, অঙ্কিত মুখার্জি এমনকি নবাগত অজয় ছেত্রীদের অন্তর্ভুক্তি টিমকে যে খোলনলচে বদলে দিয়েছে, শেষ ছয়ম্যাচের ফলাফলই তার প্রমাণ। স্বাভাবিকভাবেই সেইসব বিতর্ককে সরিয়ে সামনের দিকেই তাকাতে চান সবাই।
চেন্নাইয়ান এফসির সঙ্গে গত সাক্ষাৎে ২-২ ড্র হয় ম্যাচ। এক গোলে পিছিয়ে পড়া অবস্থাতেও জোড়া গোল করে পরিত্রাতা হয়ে দেখা দেন জার্মান মিডফিল্ডার ম্যাত্তি স্টেইনম্যান। একটা ব্যাপার এখন জলের মতো পরিষ্কার যে এসসি ইস্টবেঙ্গলের মাঝমাঠের প্রাণভোমরা তিনিই। স্টেইনম্যান চললে ইস্টবেঙ্গল চলবে – একথা মেনে নিচ্ছেন সবাই। গত কেরালা ব্লাস্টার্স ম্যাচেই দেখা গেছে স্টেইনম্যান ম্লান হতেই ম্যাচের রাশ নিজেদের দখলে নিয়ে নেয় কিবু ভিকুনার দল। সুতরাং চেন্নাইয়ান ম্যাচে জার্মান মিডফিল্ডারের পায়েই থাকবে ইস্টবেঙ্গলের ভালো খেলার চাবিকাঠি।
নজর থাকবে রবি ফাউলারের স্ট্র্যাটেজির দিকেও। মিলন সিং ব্লকার হিসেবে খুব একটা ভরসা জোগাতে পারছেন না। বরং গত ম্যাচে মিলনের পরিবর্তে নেমেই নড়বড়ে মাঝমাঠকে জমাট করেছিলেন নবাগত অজয় ছেত্রী। মাথা বেশ ঠান্ডা, অযথা ফাউল করেন না। বল ডিস্ট্রিবিউশনও ভালোই। অন্তত প্রথম ম্যাচের নিরিখে পাশমার্কই পাবেন বেঙ্গালুরু এফসি থেকে লোনে আসা এই মিডফিল্ডার। ফাউলার তাঁকে প্রথম একাদশে রাখেন কিনা, সেটাই এখন দেখার।
প্রথম একাদশ মাঠে নামানোর আগে খুব একটা স্বস্তিতে থাকার কথা নয় লিভারপুল লেজেন্ডের। গতম্যাচে মাঠে নামার মিনিট পনেরো আগে ওয়ার্মআপ করতে গিয়ে ছিটকে যান ডিফেন্সে আপাতত ভালোই খেলা রাজু গায়কোয়াড়। তাঁর বদলে নামা রানা ঘরামীর পাশ দিয়েই গত ম্যাচে গোল করে যান কেরালা ব্লাস্টার্সের জর্ডন মারে। এই ম্যাচেও রাজুর মাঠে নামার সম্ভাবনা ক্ষীণ। এই পরিস্থিতিতে রবি ফাউলার কিভাবে তাঁর ডিফেন্স সাজান, সেটা বেশ কৌতূহলের বিষয়। তবে হয়তো গত ম্যাচের মতোই তিন ব্যাকের ডিফেন্স নিয়েই নামবেন বলে আশা করা যায়।
গত ম্যাচে নারায়ণ দাসের পারফরম্যান্সও আশানুরূপ ছিল না। তবে এই ম্যাচেও সম্ভবত তিনিই শুরু করবেন। বিকাশ জাইরুর জায়গা হতে পারে বেঞ্চেই।
আরও একটা বিষয় নিশ্চয়ই মাথায় আছে এসসি ইস্টবেঙ্গলের থিঙ্কট্যাঙ্কের। ইতিমধ্যেই তিনটে হলুদ কার্ড দেখে ফেলেছেন জ্যাক মাঘোমা। এই ম্যাচে হলুদ কার্ড দেখা মানে শুক্রবার লীগ শীর্ষে থাকা মুম্বাই সিটি এফসির বিরুদ্ধে ম্যাচে মাঠের বাইরেই থাকতে হবে বার্মিংহ্যাম সিটি থেকে এসসি ইস্টবেঙ্গলে আসা কঙ্গোলিজ এই মিডফিল্ডারকে। সেক্ষেত্রে চেন্নাইয়ান এফসির বিরুদ্ধে অ্যান্টনি পিলকিংটন প্রথম একাদশে শুরু করেন কিনা সেটাই দেখার।
চেন্নাইয়ান এফসি:
এবারে আসা যাক চেন্নাইয়ান এফসির প্রসঙ্গে। হাঙ্গেরিয়ান কোচ লাজলোর তত্ত্বাবধানে চেন্নাইয়ানের পারফরম্যান্স গ্রাফ ক্রমাগত ওঠানামা করছে। গত ছয় ম্যাচে তামিলনাড়ুর দলটি নয় পয়েন্ট নষ্ট করেছে। তবে গত দুই ম্যাচে লীগ টেবিলের একেবারে নিচে থাকা ওড়িশা এফসির বিরুদ্ধে হোম-অ্যাওয়ে মিলিয়ে চার পয়েন্ট সংগ্রহ করে মইয়ে চড়তে চাইছে দুবারের আইএসএল চ্যাম্পিয়নরাও।
তবে এটিকে মোহনবাগানের বিরুদ্ধে ম্যাচে গোড়ালিতে পাওয়া চোট আইএসএল থেকেই ছিটকে দিয়েছে রাফায়েল ক্রিভেলারোকে। তাঁর বদলি হিসেবে আইএসএলের পরিচিত মুখ ম্যানুয়েল ল্যানজারোতে সই করলেও তিনি এখনও বাধ্যতামূলক কোয়ারেন্টাইনে। ফলে আপফ্রন্টে নজর থাকবে পর্তুগিজ ফরোয়ার্ড ইসমাইল গঞ্জালভেজের দিকে। কোচ লাজলোর তুরুপের তাস হতে পারেন ইছাপুরের ছেলে রহিম আলি। প্রতি ম্যাচেই বিপক্ষ ডিফেন্সকে ত্রস্ত রাখছেন ইন্ডিয়ান অ্যারোজ থেকে উঠে আসা এই বঙ্গতনয়।
এছাড়াও চেন্নাইয়ানের মাঝমাঠ কেমন খেলে তা অনেকটাই নির্ভর করছে ব্রাজিলিয়ান মৌরা, তাজিকিস্তানের ফাতকুলোয়েভ এবং দেশীয় অনিরুদ্ধ থাপা, লাললিয়ানজুয়ালা ছাংতেদের উপর। এখনও অবদি মোট ৩৪টা ক্রস করেছেন এই ছাংতে। উইং থেকে ভেসে আসা এই ক্রসগুলো সামলাতে না পারলে যথেষ্ট বিপদের সম্ভাবনা। ফলত চূড়ান্ত গতিময় রহিম, অনিরুদ্ধ, ছাংতেদের তরুণ ব্রিগেডকে আটকানোই বড় চ্যালেঞ্জ এসসি ইস্টবেঙ্গলের সাইডব্যাকদের কাছে।
গোলে বিশাল কেইথও যথেষ্ট দুর্ভেদ্য। এখনও অবদি এই মরশুমে চারটে ক্লিনশিট নিয়ে ড্রেসিংরুমে ফিরেছেন বিশাল। ফলে চেন্নাই এক্সপ্রেসকে লাইনচ্যুত করতে যথেষ্ট বেগ পেতে হতে পারে ব্রাইট, পিলকিংটন, মাঘোমা, হরমনপ্রীতদের।
প্রি-ম্যাচ প্রেস কনফারেন্সে রবি ফাউলারের মুখেও ঘুরছে লীগ টেবিলের ওঠানামার অঙ্ক। সরাসরি বলেও ফেললেন, লীগের এখনও অনেক খেলা বাকি, এবং চার নম্বরের থেকে এই মুহূর্তে মাত্র পাঁচ পয়েন্টে পিছিয়ে তাঁর দল।
বলাই বাহুল্য, মুখে আপাতত একটা করে ম্যাচ নিয়ে ভাবার কথা বললেও লিভারপুল এফসি-ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড ম্যাচে বিশেষজ্ঞের আসনে বসা লাল-হলুদ বসের মাথাতেও কিন্তু ঘুরছে সাপ-লুডো খেলায় মইয়ে চড়ার ব্লু-প্রিন্ট।