আবার একটা কলকাতা ডার্বি। কলকাতা দুভাগ হয়ে যাবে, সেই সত্তরের দশক থেকে বাঙাল-ঘটি দুই অভিন্নহৃদয় বন্ধু বার্ধক্যে পৌঁছেও গত চল্লিশ-পঞ্চাশ বছরের মতো আজকেও পাড়ার চায়ের দোকানটায় বসে মজিদ সেরা না ব্যারেটো, সেই নিয়ে এই বয়সেও উত্তেজিত তর্ক করবেন, পাশ থেকে দুই ফচকে ছোঁড়া বলে উঠবে নতুন আসা রয় কৃষ্ণা বা বাচ্চা ছেলে ব্রাইট এনোবাখারের নাম, তখন আবার দুজনেই রে রে করে তেড়ে এসে বলবেন, তাঁদের সময়ের খেলোয়াড়দের সাথে এখনকার ফুটবলারদের তুলনাই হয় না। ইএম বাইপাসে কাতারে কাতারে ম্যাটাডোর ভর্তি মানুষ আসবে, কোনওটা লাল হলুদ পতাকায় মোড়া তো কোনওটা সবুজ মেরুনে। একটা থেকে যদি স্লোগান ওঠে “চা, চিনি, দুধে”, তাহলে পরক্ষনেই পাল্টা আসবে “আদা বাটা, পোস্ত বাটা”। কোনও ম্যাচের শেষে গ্যালারিতে কাগজের মশাল জ্বলবে, তো অন্য আরেকদিন হয়তো উৎসব হবে কার্ডবোর্ড দিয়ে বানানো পালতোলা নৌকা নিয়ে। নব্বই মিনিট টানটান উত্তেজনা, গোল হলে পাশের অপরিচিত মানুষটাকে আনন্দে জড়িয়ে ধরা, হাফটাইমে লেবু চা – বড়ম্যাচ মানে তো এই টুকরো টুকরো দৃশ্যের কোলাজগুলোই।
কিন্তু গত এক বছরে পৃথিবী যে বদলে গেছে অনেকটাই। মানবসভ্যতায় লেগেছে করোনার অভিশাপ, ফলে এসসি ইস্টবেঙ্গলের প্রথম আইএসএল অভিযান হলো দর্শকশূন্য স্টেডিয়ামে, সুদূর গোয়াতে। সেটা না হয় তবু মানা গিয়েছিলো কারণ সারা বিশ্বেই এইভাবে দর্শক ছাড়াই খেলতে হয়েছে সবাইকে। কিন্তু ইস্টবেঙ্গল সমর্থকদের দুঃখ দ্বিগুণ বেড়ে গেছে অতিমারির অনেক আগে থেকেই, যখন প্রথমবার মাত্র ৬ বছর পুরোনো ক্লাব এটিকের সঙ্গে নিজেদের মিশিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় ১৩১ বছরের ঐতিহ্য বহন করে চলা তৎকালীন মোহনবাগান ক্লাব।
বাঙালি উৎসবপ্রিয় জাতি। আর গত একশো বছর ধরে বড়ম্যাচ তো কোনো উৎসবের চেয়ে কম ছিল না। এটিকে এবং মোহনবাগানের মার্জারের ফলে কোটি কোটি ফুটবলপ্রেমী বাঙালির কাছ থেকে এক নিমেষে সেই উৎসবটাকেই কেড়ে নেওয়া হলো। ১৩১ বছরের মোহনবাগানের অবলুপ্তির সাথে সাথেই শেষ হয়ে গেল একশো বছরের চিরশত্রুতার দীর্ঘ বর্ণময় ইতিহাস। ১লা জুন, ২০২০-তে ভূমিষ্ঠ হওয়া নবকলেবরের এটিকে মোহনবাগানের সঙ্গে শতাব্দীপ্রাচীন ক্লাব ইস্টবেঙ্গলের প্রতিদ্বন্দ্বিতা ভবিষ্যতে বড়ম্যাচের রূপ নেবে কিনা সেটা তো সময় বলবে, কিন্তু এইমুহূর্তে এটি একই শহরের দুটি শক্তিশালী টিমের মধ্যে হতে চলা হাইভোল্টেজ ম্যাচ ছাড়া আর কিছুই নয়, যে প্রতিদ্বন্দ্বিতার কোনো পূর্বইতিহাস নেই।
এ কথা অনস্বীকার্য, এটিকে এবং মোহনবাগানের মার্জারের পরে সংখ্যাগরিষ্ঠ মোহনবাগান সমর্থকই অস্তিত্বহীনতায় ভুগছেন। সোশ্যাল মিডিয়ার পেজে পেজে গিয়ে নিরন্তর কাকুতিমিনুতিই তার প্রমাণ। কারণ গত বছর অব্দি তো তাঁদেরকে নিজেদের পরিচয় আলাদা ভাবে ব্যক্ত করতে হয়নি। সারাবিশ্ব তাঁদের অতীত গরিমার জন্যই চিনতো। আসলে মোহনবাগান সমর্থকরাও জানেন, বাঘের ছাল পরালেই শেয়াল বাঘ হয়ে যায় না। সেরকমই, যে কোনো ক্লাবের ফুটবলারদের লাল-হলুদ, সবুজ-মেরুন বা সাদা-কালো জার্সি পরিয়ে দিলেই তাঁরা ইস্টবেঙ্গল, মোহনবাগান বা মহামেডান হতে পারবেন না। এই তিনটে ক্লাবের জার্সির সঙ্গে জড়িয়ে আছে একশো বছরের সুদীর্ঘ ইতিহাস।
এটিকে মোহনবাগান নিজেদের আরও হাস্যস্পদ করে তুলেছেন “রিমুভ এটিকে” বিক্ষোভের মাধ্যমে। মনে করিয়ে দিচ্ছেন কয়েকবছর আগে দিল্লিতে পরিবেশ দূষণ নিয়ন্ত্রণের জন্য চালু হওয়া Odd-Even Scheme-কে। এটিকে মোহনবাগানের ফুটবলাররা যেদিন তাঁদের চিরাচরিত কালো জার্সি পরে মাঠে নামেন, বা খেলায় পয়েন্ট নষ্ট করেন, সেইদিন “রিমুভ এটিকে” বিক্ষোভ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। আবার যেদিন তাঁরা নতুন পাওয়া সবুজ মেরুন জার্সি পরেন এবং ম্যাচ জেতেন, সেদিন সবকিছুই ধামাচাপা পড়ে যায়।
এই বিষয়ে এসসি ইস্টবেঙ্গল সমর্থকরা পুরোপুরি নিশ্চিন্ত। তাঁদের নতুন ইনভেস্টর শ্রী সিমেন্টের কাজকর্মে আপাতত অভিযোগ করার মতো কিছু দেখা যায়নি। বরঞ্চ ক্লাবের ইতিহাসকে গুরুত্ব দেওয়ায় সব সমর্থকমহলেই এখনও অব্দি প্রশংসিত হয়েছেন। তাই এক চুক্তিপত্র সই হওয়া ছাড়া আলাদা করে মাঠের বাইরের ঘটনা নিয়ে এসসি ইস্টবেঙ্গলে কোনওরকম সমস্যা নেই।
ম্যাচ প্রিভিউতে সাধারণত দুই যুযুধান টিমের খেলার টেকনিক্যাল বিষয়গুলো নিয়েই আলোচনা সীমাবদ্ধ থাকে। কিন্তু যেহেতু সম্প্রচার সংস্থা ষ্টার স্পোর্টস, আইএসএল কর্তৃপক্ষ সমেত দুই ক্লাবের মিডিয়া টিম থেকেই এই ম্যাচের জন্য হাইপ তোলার যথাসাধ্য চেষ্টা করা হচ্ছে (অবশ্যই খেলার বাইরের বাণিজ্যিক ব্যাপারটাও যেহেতু জড়িত, তাই সময়ের দাবি মেনেই যে কোনো হাইভোল্টেজ ম্যাচের বিপণন অত্যন্ত জরুরী), সেই প্রসঙ্গেই ধান ভানতে এত বড় শিবের গীতের অবতারণা।
এবারে আসা যাক মাঠের ভিতরের আসল ম্যাচে। মাঠের বাইরের লড়াইয়ে নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষা করে এসসি ইস্টবেঙ্গল সমর্থকরা এটিকে মোহনবাগানের সমর্থকদের পাঁচ গোল মেরে বসে থাকলেও মাঠের লড়াইয়ের নিরিখে বেশ খানিকটা পিছিয়ে থেকেই শুরু করবে। তার প্রধান কারণ অবশ্যই গত কয়েকবছর ধরে তিন বারের আইএসএল চ্যাম্পিয়ন এটিকে মোহনবাগানের একই সেট টিম রাখা। সঙ্গে বারবার কোচবদল না করে কোচ আন্তোনিও লোপেজ হাবাসের উপর পূর্ণ আস্থা রাখা। ফলে নিজের টিমকে হাতের তালুর মতোই চেনেন তিনি।
সন্দেশ ঝিঙ্গান, তিরি, শুভাশিস বোস, প্রীতম কোটাল সমৃদ্ধ এটিকে মোহনবাগান ডিফেন্স ১৭ ম্যাচে গোল খেয়েছে মাত্র ১০টা। উল্টো দিকে সমসংখ্যক ম্যাচে লাল-হলুদ ব্রিগেডকে হজম করতে হয়েছে ২২টি গোল। তিনকাঠির নিচে দেবজিৎ মজুমদার ত্রাতার ভূমিকায় অবতীর্ণ না হলে সংখ্যাটা আরও বাড়তেই পারতো। ব্রাইট-মাঘোমা-পিলকিংটনরা যে খুব বেশী সুযোগ পাবেন না, তা বলাই বাহুল্য। ফলে যে কয়েকটা সীমিত সুযোগ তাঁরা পাবেন, সেগুলো কতটা কাজে লাগাতে পারবেন, তার উপর অনেকটাই নির্ভর করবে ম্যাচের ভাগ্য।
উল্টোদিকে এটিকে মোহনবাগানের আক্রমণভাগ যেকোনও টিমের কাছেই স্বপ্নের। মনভীর সিং প্রতিদিন নিজের জাত চেনাচ্ছেন। সুনীল ছেত্রীর পরে যে দুই ভারতীয় ফরোয়ার্ড প্রায় প্রতিদিনই ফুল ফোটাচ্ছেন, তাঁরা হলেন এফসি গোয়ার ঈশান পন্ডিতা এবং এটিকে মোহনবাগানের মনভীর সিং। তবে মনভীর শুধু গোল করেন না, করানও। ফলস্বরূপ তাঁর ঝুলিতে চারটে গোলের সঙ্গে রয়েছে তিন-তিনটি এসিস্ট। জানুয়ারী ট্রান্সফার উইন্ডোতে ব্র্যাড ইনমানের বদলে মার্সেলিনহোর অন্তর্ভুক্তি এটিকে মোহনবাগানের আক্রমণবিভাগকে আরও শক্তিশালী করেছে। ফলে ড্যানি ফক্স, রাজু গায়কোয়াড়, সার্থক গলুই, নারায়ণ দাসদের কাছে আজ কঠিন চ্যালেঞ্জ।
মাঝমাঠের লড়াইতেও কাগজে কলমে এগিয়ে এটিকে মোহনবাগানই। কার্ল ম্যাকহিউ রয়েছেন, জানুয়ারী উইন্ডোতে দলে এসেছেন লেনি রডরিগেজও। পরিবর্ত হিসেবে জাভি হার্নান্ডেজ, প্রণয় হালদার, জয়েশ রানে-রা রয়েছেন। এসসি ইস্টবেঙ্গলের মাঝমাঠের চালিকাশক্তি অবশ্যই ম্যাটি স্টেইনম্যান। সৌরভ দাস আসায় মাঝমাঠ কিছুটা জমাট বেঁধেছে। মাঘোমাও প্রচুর ওয়ার্কলোড নিচ্ছেন। তবে লাল হলুদ জনতা তাকিয়ে রয়েছেন ব্রাইট এনোবাখারের ম্যাজিকের দিকে। ফাঁকা স্টেডিয়ামে খেলা হওয়ায় একদিকে সুবিধা, ব্রাইটকে হয়তো প্রথমবার ডার্বির দর্শকের চাপটা নিতে হবে না। তবে আজ যে তিনি বেশি জায়গা পাবেন না, সেটা তিনিও জানেন। ফলে সন্দেশ, তিরিদের ডিফেন্সের জাল কেটে তিনি লক্ষ লক্ষ লাল-হলুদ সমর্থকের মুখে হাসি ফোটাতে পারেন কিনা, সেটাই এখন দেখার।
এমনিতে এই ম্যাচে দুই দলের মোটিভেশন ভিন্ন। এটিকে মোহনবাগানের পাখির চোখ লীগ পর্যায়ে শীর্ষস্থান ধরে রেখে এএফসি চ্যাম্পিয়নস লীগ খেলার সুযোগ পাওয়া। তবে হাবাসের খেলানোর যা ধরণ, তাতে ডিফেন্স জমাট রেখে প্রতিআক্রমণ নির্ভর খেলারই সম্ভাবনা এটিকে মোহনবাগানের। অন্যদিকে শেষ চারের আশা শেষ হয়ে গিয়েছে এসসি ইস্টবেঙ্গলের, ফলে তাঁদের হারানোর কিছু নেই। ২৭শে নভেম্বর, ২০২০-তে এই দুই দল যখন প্রথমবার একে অপরের মুখোমুখি হয়েছিল, তখন প্রস্তুতির সময়ই পায়নি রবি ফাউলারের ছেলেরা। ফলে অসম লড়াইতে পরাজিত হতে হয়েছিল।ব্রাইট আসার পর এবং জানুয়ারিতে সার্থক, সৌরভ, সুব্রত, রাজুদের অন্তর্ভুক্তি নিঃসন্দেহে এসসি ইস্টবেঙ্গলের শক্তিবৃদ্ধি ঘটিয়েছে। ফলে লড়াই হওয়া উচিত সেয়ানে-সেয়ানে।
রবি ফাউলার, টনি গ্র্যান্টরা হয়তো লীগ শেষে এসে একটা প্রথম একাদশ খাড়া করতে পেরেছেন। তবে রয় কৃষ্ণাদের আটকাতে তাঁরা ফক্স-নেভিল এই দুই বিদেশী সমৃদ্ধ ডিফেন্স নামাতে চাইলে হয়তো পিলকিংটনকে বসাতে হতে পারে, এবং সেক্ষেত্রে প্রথম একাদশে ঢুকতে পারেন অভিজ্ঞ জেজে। তবে হয়তো সাহসী হয়ে প্রথম একাদশ অক্ষুন্ন রেখেই টিম নামাতে চলেছেন ফাউলার-গ্রান্ট জুটি। ভাগ্য কিন্তু সাহসীদেরই সঙ্গ দেয়।
একটা কথা বলতে বলতে ক্লিশে হয়ে গেলেও ধ্রুবসত্য – ডার্বি চিরকালই ৫০-৫০। ফলে কোথাও গিয়ে টিম কম্বিনেশন, স্ট্র্যাটেজি এইসব গৌণ হয়ে গিয়ে কোন টিমের প্লেয়াররা ওই ৯০ মিনিট তাঁদের নার্ভটা ধরে রাখতে পারবেন, সেটাই মুখ্য হয়ে দাঁড়ায়।
দুইদলের সমর্থকরাই প্রার্থনা করবেন, রেফারিং শুধু যেন ঠিকঠাক হয়। বাকিটা, ফুটবলারদের উপর।
আইএসএলের মহাশুক্রবারে, দুই দলেই স্লোগান – খেলা হবে!
One Comment
Darun lekha ta…puro moner kotha….