আপাত দৃষ্টিতে ম্যাচটা লীগ টেবিলের এক বনাম দশের। ভারতবর্ষের বাণিজ্যিক রাজধানী বনাম সাংস্কৃতিক রাজধানীর। বড়াপাও বনাম ইলিশের।
কিন্তু ভাস্কোর তিলক ময়দানে মুম্বাই সিটি এফসি বনাম এসসি ইস্টবেঙ্গলের খেলায় লাল-হলুদের প্রতিপক্ষ কি শুধুই সিটি ফুটবল গ্রুপের মালিকানাধীন অষ্টম ক্লাবটি? ভুল। এই ম্যাচে এসসি ইস্টবেঙ্গলের অদৃশ্য প্রতিপক্ষ তো আরও ৬টা দল। লীগ টেবিলের যা অবস্থা, এই সাত দলের যে কেউ যেতে পারে শেষ চারে। ভাগ্য সহায় থাকলে এবং নিরপেক্ষ রেফারিং হলে এসসি ইস্টবেঙ্গলের দশম স্থানের অনেক উপরে থাকার কথা। কিন্তু বিধি বাম! কখনও ৯৪ মিনিটে এসে গোল হজম, কখনও রেফারীদের একের পর এক ভুল সিদ্ধান্তের শিকার হয়ে, লীগ টেবিলে ভেসে থাকার চেষ্টায় রবি ফাউলারের ছেলেরা।
অতএব, খাতায় কলমে ম্যাচটা ডেভিড-গোলিয়াথের অসম লড়াই হলেও টক্কর কিন্তু হবে সেয়ানে সেয়ানে।
মুম্বাই সিটি এফসি:
মুম্বাই সিটি এফসি-কে নিয়ে যতই আলোচনা হোক, তা বোধহয় কমই। গতবছর পঞ্চম স্থানে শেষ করা দলটি এইবছর যেন অশ্বমেধের ঘোড়া। সৌজন্যে সার্জিও লোবেরা রডরিগেজ। ৪৪ বছর বয়সী এই স্প্যানিশ কোচ এফসি গোয়াকে যে গত মরশুমে শুধু আইএসএলের লীগ শীর্ষে রেখেছিলেন তাই নয়, সুপার কাপেও চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল তাঁর দল। লোবেরা নিজে এফসি গোয়া ছেড়ে মুম্বাই সিটি এফসি-তে আসার পাশাপাশি আহমেদ জাহোউ, হুগো বুমৌস, মৌর্তাদা ফল সমেত একঝাঁক ভারতীয় তরুণ প্রতিভাকেও নিয়ে এসেছেন মুম্বাই সিটি এফসিতে।
নতুন ফ্র্যাঞ্চাইজিতে এসেই লোবেরা ম্যাজিক চালু। সার্জিও লোবেরার দল আইএসএল অভিযান শুরু করেছিলো নর্থইস্ট ইউনাইটেডের কাছে হেরে। এই তিলক ময়দানেই, যেখানে আজ মুখোমুখি দুই দল। সেই শেষ। তারপর থেকে টানা দশ ম্যাচ অপরাজিত, যার মধ্যে জয় আটটাতে।
মুম্বাই সিটি এফসির টিমটার দিকে তাকালেই তাদের ভালো খেলার কারণটা স্পষ্ট হয়ে যাবে। গোলে মুম্বাই সিটি এফসির হয়ে সবচেয়ে বেশী ম্যাচ খেলা অমরিন্দর সিং। বিদেশীদের মধ্যে চারটে হলুদ কার্ড দেখে এসসি ইস্টবেঙ্গল ম্যাচে নেই হার্নান সান্তানা। ফলে আশা করা যায় স্টপারে মৌর্তাদা ফলের সঙ্গে জুটি বাঁধতে পারেন গত মরশুমে ইস্টবেঙ্গলে খেলা তরুণ মেহতাব সিং। দুই সাইডব্যাকে খেলার সম্ভাবনা মন্দার রাও দেশাই এবং অময় রানাওয়াডে-র।
গত ম্যাচে বিশ্রামের পর তরতাজা হয়ে এসসি ইস্টবেঙ্গল ম্যাচে ফিরে আসছেন এটাকিং মিডফিল্ডার হুগো বুমৌস। ডানদিকের উইংয়ে খেলেন জাপানিজ মিডফিল্ডার গোদার্দ। পরিবর্তে আসতে পারেন রেনিয়ার ফার্নান্ডেজ। ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার হিসেবে থাকছেন এই মুহূর্তে নিজের সেরা ফর্মে থাকা রাওলিন বোর্জেস। এছাড়াও মুম্বাই সিটি এফসির মাঝমাঠে তো থাকবেনই মরোক্কান ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার আহমেদ জাহোউ।
আপফ্রন্টে অ্যাডাম লে ফন্দ্রে না ওগবেচে – কে প্রথম এগারোয় শুরু করেন, সেটাই দেখার।
সব মিলিয়ে, একথা অনস্বীকার্য, ধারেভারে প্রতিপক্ষের চেয়ে অনেকটা এগিয়েই শুরু করবে মুম্বাই সিটি এফসি।
এসসি ইস্টবেঙ্গল:
মুম্বাই সিটি এফসি যদি টানা দশ ম্যাচ অপরাজিত থাকে, তাহলে পিছিয়ে নেই রবি ফাউলারের ছেলেরাও। এসসি ইস্টবেঙ্গলও গত সাতটা ম্যাচ অপরাজিত। প্রতি ম্যাচে গোল খাওয়ার বদভ্যাসটা একটু হলেও কাটানো গেছে। যদিও এই ম্যাচেও ডিফেন্স সংগঠন এবং পাঁচ বিদেশী চয়ন নিয়ে চিন্তায় থাকবেন লিভারপুল কিংবদন্তি।
রাজুর কাফ মাসলের চোট ভোগাচ্ছে। রবি ফাউলার হয়তো বিপক্ষের শক্তিশালী আক্রমণভাগের কথা মাথায় রেখে ঘর সামলে আক্রমণে যাওয়ার কথা ভাবতে পারেন। সেক্ষেত্রে পাঁচ ডিফেন্সে নামলে ফক্স ও নেভিলের মাঝে রানা ঘরামী শুরু করতে পারেন। দুই সাইডব্যাক নারায়ণ এবং অঙ্কিত। গত ম্যাচেই দেখা গিয়েছিলো ম্যাত্তি স্টেইনম্যান না থাকলে এসসি ইস্টবেঙ্গলের মাঝমাঠে খেলা তৈরী করার লোক থাকে না। তাই খুব বড়সড় চমক না থাকলে দলে ফিরছেন ওয়েলিংটন ফিনিক্স থেকে এসসি ইস্টবেঙ্গলে আসা জার্মান এই মিডফিল্ডার। পিলকিংটন এবং ব্রাইটের মধ্যে একজনের বসার সম্ভাবনা। ব্লকার হিসেবে অজয় ছেত্রীর না থাকাটা ইস্টবেঙ্গলের জন্য বড় ক্ষতি। শেহনাজের উপরে রবি ফাউলার ভরসা করতে পারেন কিনা, সেটা তর্কসাপেক্ষ। তবে আপাতভাবে সমর্থকদের চক্ষুশূল হলেও টিম কম্বিনেশনের স্বার্থেই এই ম্যাচেও শুরু করার কথা মিলন সিংয়ের।
আসলে এই মরশুমে এসসি ইস্টবেঙ্গলের প্রথম একাদশ নিয়ে কোনওরকম ভবিষ্যৎবাণী করা সবার জন্যই কঠিন, কারণ রবি ফাউলার কখনোই পুরো স্কোয়াড হাতে পাচ্ছেন না। হয় চোট আঘাত, নয়তো কার্ড সমস্যা মাথাচাড়া দিচ্ছে। সঙ্গে রয়েছে দেশীয় ব্রিগেডে অপশনের অভাব। যেরকম সমর্থকরা মহঃ রফিককে দেখতে চাইলেও তাঁকে আপাতত প্রথম একাদশে খেলানোর জায়গা নেই, যদি না অনভ্যস্ত পজিশনে খেলাতে হয়। এদিকে টিমে দেশীয় স্টপার এবং ডিফেন্সিভ ব্লকারের অভাব। তাই প্রতিদিনই কিছু না কিছু পরিবর্তন থাকছে ফাউলারের প্রথম একাদশে।
এই নেই-এর সংসারে ম্যাচ বের করতে গেলে লাগে সংকল্প ও চারিত্রিক দৃঢ়তা। ফুটবলে যে সবসময় টেকনিক্যালি এবং ধারেভারে শক্তিশালী টিমই জেতে, তা নয়। সীমিত রসদ নিয়েও অনেকসময় অঘটন ঘটানো যায়, যদি কোচ মগজাস্ত্রের লড়াইয়ে প্রতিপক্ষ কোচকে টেক্কা দিতে পারেন। যদি মাঠে নামা এগারোটা খেলোয়াড় নিজেদের একশো শতাংশের বেশী দেওয়ার জন্য অঙ্গীকারবদ্ধ থাকতে পারে।
আজ ইস্টবেঙ্গলের লড়াই শুধুই মুম্বাই সিটি এফসির সঙ্গে নয়, আজ অদৃশ্য প্রতিপক্ষ আরও অনেকগুলো। আজ আন্ডারডগের তকমা ঝেড়ে ফেলার লড়াই, নিজেদের হীনমন্যতা কাটিয়ে উঠে চোখে চোখ রেখে এক ইঞ্চি জমি না ছাড়ার লড়াই, সমালোচকদের মুখ বন্ধ করার লড়াই, নিজের সেরা খেলা বের করে এনে টিমের প্রতিটা বিভাগে নেতৃত্ব দিয়ে পুরো টিমকে চাগিয়ে দেওয়ার লড়াই। সর্বোপরি, এই ম্যাচ থেকে তিন পয়েন্ট ছিনিয়ে এনে বাতিলের খাতা থেকে বেরিয়ে এসে শেষ চারের প্রবল দাবিদার হিসেবে ঢুকে পড়ার লড়াই।
অতীতে এইরকম সময়েই নিজেদের সেরা খেলাটা বের করে আনতেন লাল হলুদ জার্সি চাপানো এগারোজন। নিজেদের সীমাবদ্ধতা ছাপিয়ে হয়ে উঠতেন অসাধারণ।
ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে, ইস্টবেঙ্গলিয়ানদের জীবনে কোনও কিছুই সহজে আসে না। খেটে অর্জন করতে হয়।
রবি ফাউলারের ছেলেদের কি কেউ বুঝিয়েছে, জীবনের অভিধানে লড়াই আর ইস্টবেঙ্গল দুটো সমার্থক শব্দ?