ইস্টবেঙ্গল সমর্থকদের দাবি-দাওয়া রবি ফাউলারের কানে পৌঁছেছিল কিনা জানার উপায় নেই। তবে কোচ আজ বেঙ্গালুরু এফ সির বিরুদ্ধে আইএসএল সেমিফাইনালের শেষ সুযোগের ম্যাচে নিজের ভান্ডার উজাড় করে আক্রমণাত্মক ফুটবল খেলার চেষ্টা করেছিলেন। স্ট্রাইকারের অভাবে গোয়ার বিরুদ্ধে জেতা ম্যাচে দুই পয়েন্ট রেখে আসায় চাপ বেড়ে গেছিলো প্রচুর। ইস্টবেঙ্গলের শুভাকাঙ্খীদের ইচ্ছা মতোই হয়েছিল খারাপ ফর্মে থাকা এন্টোনি পিলকিংটনের জায়গায় আরন আমাদি হ্যালোয়ের অন্তর্ভুক্তি। ম্যাত্তি স্টাইনম্যানের অনুপস্থিতি নিয়েও প্রশ্ন উঠছিলো প্রচুর। সেও ফিরলো টিমে। আগের ম্যাচে দৃশ্যত সম্পূর্ণ ফিট না হওয়া জেজে লালপেখলুয়ার জায়গায় ফিরলো হারমানপ্রীত সিং। ডান দিকে শুরু থেকেই খেললো আঙ্গুসনা আর মাঝখানে উপায়ান্তর না থাকায় অজয় ছেত্রী। নৌশাদ মুসার অধীনে বেঙ্গালুরুর মাঝমাঠ আর ডিফেন্স অসাধারণ ফুটবল খেললো। জিততেই হবে এমন একটা ম্যাচে শুরুটা খারাপ হয়নি। কিন্তু বাকি আশি মিনিট হলো জঘন্য।
বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় বিশেষজ্ঞরা এবং সমথকবৃন্দেরা এখন প্রশ্ন তুলছেন মাঘমা ও পিলকিংটনকে বেঞ্চে রাখা হলো কেন? কেন বিকাশ জাইরু বা মহাম্মদ রফিক সুযোগ পাচ্ছেনা? শেহনাজ বা রাজু গায়কোয়াড়ের চোটের খবর কি? অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন এতো কেন পরীক্ষা-নিরীক্ষা? এখনো কেন টীম তৈরী হয়নি? উত্তরগুলো একে একে সাজিয়ে নেওয়া যাক।
খারাপ ফর্মে থাকা এন্টোনি পিলকিংটনের জায়গায় আরন যে ম্যাচ শুরু করবে সেটা মোটামুটি আন্দাজ করা যাচ্ছিলো। স্টেইনম্যানকে খেলাতে গেলে জ্যাক মাঘমাকে বসানো ছাড়া উপায় নেই। কারণ উপরে আরণকে রেখে মাঝমাঠে ব্রাইট, মাঘমা আর স্টাইনম্যানকে খেলাতে হলে ড্যানি ফক্স বা স্কট নেভিলকে বসতে হবে। রানা ঘরামী আর অজয় ছেত্রীর ভরসায় সুনীল ছেত্রী আর ক্লেটন সিলভাকে সামলানো অত্যন্ত কঠিন হতো। অঙ্কিত মুখার্জী প্রথম লেগে (মূলত প্রথমার্ধ) ভালো খেললেও, সে বাম প্রান্ত থেকে আক্রমণ ভেসে এলে নিজের অধীনে থাকা ডান পোস্টটি ছেড়ে রাখে। আজ বেশ কয়েকবার এরকম হয়। দ্বিতীয় গোলটির কারণ তার জায়গায় না থাকা। রানা ঘরামীর দুর্বল টার্নিং-এর সৌজন্যে সুনীল ছেত্রী তৃতীয় গোলটি করেই ফেলেছিলো। ক্রস-পিস্ রক্ষা করে। দুরন্ত দেবজিৎ ঘোষ আজ ছিল নড়বড়ে। একদিন এরকম হতেই পারে। তাকে আজ কঠিন শট বাঁচাতে না হলেও বহুবার ‘নো-ম্যান্স-ল্যান্ডে’ দাঁড়িয়ে পড়ছিলো সাথে আউটিং-এর সমস্যা। দেবজিৎ ছাড়া একমাত্র ভারতীয় ফুটবলার যে ধারাবাহিকভাবে ভালো খেলছে সে হলো নারায়ণ দাস। সাধ্য মতন চেষ্টা করেছে।
আরনের খেলা কেমন লাগলো? তার খেলার ধরণ বলে দেয় সে স্ট্রাইকার নয়। আরন শরীর ব্যবহার করে একজন হোলডিং মিডফিল্ডার হিসেবে বেশি কার্যকরী। তাকে খুব একটা ফিট মনে হয়নি। খেলার শেষ দশ-পনেরো মিনিট বিপক্ষের ক্লান্ত ডিফেন্সকে সে বিব্রত করতে পারলেও, গোল করতে পারবেনা। খুব সম্ভবত তাকে স্ট্রাইকার হিসেবে আনাও হয়নি। হারমানপ্রীত সিংকে নিয়ে নতুন করে কিছু বলার নেই। বিরতির পরেই সে চোটের কারণে বাইরে চলে যায়। বেঙ্গালুরুর ভারতীয় ব্রিগেড নিজেদের অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছিলো। ব্রাইটকে ডাবল মার্কিং-এ রেখে রাহুল ভেকে, উদান্ত সিং, প্রতীক আর হারমানজ্যোৎ সিং খাবড়া তার স্বাভাবিক খেলাটি প্রায় খেলতেই দেয়নি। পনেরো-কুড়ি মিনিট পরের থেকে আরন এবং হারমানের ভোঁতা যুগলবন্দী তাই রীতিমতো ধরাশায়ী। তাই ‘দ্য ব্লুজ’-দের মাঝমাঠ ছিল চাপমুক্ত। স্টাইনম্যান-ও খুব একটা সুবিধা করতে পারছিলোনা স্ট্রাইকাররা বিপক্ষ বক্সে জায়গা তৈরী করতে না পারে। দু গোলে পিছিয়ে থাকা, ধুঁকতে থাকা ইস্টবেঙ্গলের মাঝমাঠে ব্রাইটের উপর থেকে চাপ হালকা করতে নামানো হয় মাঘমাকে। পরিবর্ত হিসেবে পিলকিংটনকেও তৈরী করা হচ্ছিলো। একাত্তর মিনিটের মধ্যে পাঁচটা পরিবর্তন নিয়ে ফেলে ‘গোয়াঁর’ ফাউলার। আন্তর্জাতিক ফুটবলেও চোখ রাখলে দেখা যাবে চট করে পাঁচটা ট্যাকটিক্যাল (হারমানের পরিবর্তনতা চোটের জন্য না হলেও, ট্যাকটিক্যাল কারণেই অবশ্যম্ভাবী ছিল ধরে নিয়ে) পরিবর্তন নেবার উদাহরণ বিরল। স্ট্রাইকারের জায়গায় এন্টোনি স্টোকস আর পরে জো গার্নারকে প্রায় নিশ্চিত অবস্থা থেকে পাওয়া যায়নি। পেলে ফলাফল হয়তো অন্যরকম হতো।
মহাম্মদ রফিক গত কয়েক বছর ধরে রাইট-উইংয়ের খেলোয়াড়। রফিকের গতি কম আর ক্রসগুলো মোটেই ভালো হচ্ছিলোনা। যতটুকুই খেলেছে ইদানিংকালে খুব একটা আক্রমণ তৈরীতে সক্রিয় ছিলোনা। সুরচন্দ্র সিং দুপায়ের খেলোয়াড় হওয়ায় দুটি প্রান্তেই খেলতে পারে। তার উপর তুলনায় গতি বেশি থাকায় উনি বেশ কিছু ম্যাচ দলে ছিল, কিন্তু সেও আড়াআড়ি পাস ছাড়া খুব একটা কিছু করেনি। আজ আঙ্গুসানার জন্মদিনে কোচ তাকে ম্যাচ উপহার দিলেও পঁচিশ বছর বয়েসী মিডফিল্ডারটি তার দলকে কিছু উপহার দিতে ব্যর্থ।
বিকাশ জাইরু মূলত বাম প্রান্ত ধরে খেলে। সেই জায়গায় খেলছে ব্রাইট বা মাঘমা। সুস্থ হয়ে ওঠার পরেও তার সুযোগ না পাবার প্রধান কারণ হয়তো এটাই। বিকাশ দুটো ম্যাচ খেলেছিল নারায়ণের জায়গায়। তার আক্রমণের ক্ষেত্রে অবদান অনস্বীকার্য হলেও, রক্ষণভাগে বেশ দুর্বল। নারায়ণ সেই জায়গায় নিজের সুযোগের সদ্ব্যবহার করছে। এখন বিকাশকে বামদিকে খেলিয়ে ডান প্রান্তে ব্রাইট বা মাঘমাকে খেলানো যায় কিনা সেটা তর্কসাপেক্ষ। আর ব্রাইট বা মাঘমা একসাথে ডান দিকে কার্যকরী হচ্ছে কিনা সেটাও কোচ নিশ্চই খেয়াল রাখছেন।
ভয়ংকর মন্থর মিলান সিং-এর জায়গায় এসে অজয় ছেত্রী কেরালা ব্লাস্টার্সের বিরুদ্ধে তার প্রথম ম্যাচে মন ভরালেও চেন্নাইনের বিরুদ্ধে দ্বিতীয় ম্যাচেই সে লাল কার্ড দেখে বাইরে যায়। আর তারপর থেকে সে আর আশানুরূপ খেলতে পারেনি। অজয়ের বদান্যতায় এফ সি গোয়ার বিরুদ্ধে গোল খেয়েছিলো ইস্টবেঙ্গল, আজ আরো একবার তার পুনরাবৃত্তি হতে চলেছিল। বিকল্পের অভাবে আবার নামাতে হয় মিলানকে। যুমনাম গোপী সিং তার তৃতীয় ম্যাচে নেমেও নজর কাড়তে পারেনি।
শেহনাজ বা রাজুর চোট সংক্রান্ত খবর শুধু নয়, বায়ো-বাবলের ভিতরে ব্রেন্ডন ফার্নান্দেজ, অনিরুদ্ধ থাপা, আশিক কুরুনিয়ানের চোট বা ঈশান পান্ডিত্য, আব্দুল সাহালের সাময়িক অনুপস্থিতি সম্পর্কে কোনো খবরই পাওয়া যাচ্ছেনা বা যায়নি।
রেফারিং নতুন করে বলার কিছু না থাকলেও, ধারাবাহিকতার অনন্য নিদর্শন জঘন্য রেফারিং। শ্রীকৃষ্ণ মহাশয় বোধয় ইস্টবেঙ্গল নামটিকে কংসর সাথে গুলিয়ে ফেলেন। একগাদা উদাহরণ, যেমন গুরপ্রীত সিং সান্ধুর পেনাল্টি বক্সের মাথায় ‘হাই-বুট চ্যালেঞ্জ’ বা আরণের উপর ফ্রান্ গঞ্জালেজের ফাউল, রাহুল ভেকেকে হলুদ কার্ড না দেখানো, ভুল অফ-সাইড, গুরপ্রীতের হাত ফস্কে বেরিয়ে যাওয়া বলে ফাউল দেওয়া ইত্যাদি।
যাই হোক সমর্থকপুষ্ট লাল-হলুদে কোচিংয়ের অভিজ্ঞতা লিভারপুলের জাঁদরেল সমর্থকদের সামলে আসা কিংবদন্তির কোচিং জীবনকে সমৃদ্ধ করবে। সমর্থকরা প্রতি ম্যাচের পর ফ্লপ করা খেলোয়াড়দের পরিবর্তন চেয়েছেন। তারা একেকজন সুযোগ পাবার পর যেন ‘একে ছেড়ে তাকে দেখ’। কেন এতো পরীক্ষা সেই প্রশ্ন এখন করে লাভ নেই। কারণ ডিফেন্স সেট হলেও উপরের ভাগটা ভরসা দিতে ব্যর্থ। ভালো খেলে ড্র করা গেছে কয়েকটা ম্যাচ। শেষ চারে উঠতে হলে জিততে হবে এমন ম্যাচে পরিবর্তন আসবেই। সমস্যা হলো কোনো কম্বিনেশন-এই জেতার ফর্মুলা পাওয়া যাচ্ছেনা। শেষ বাজারের বিদেশীরা মন্দের ভালো হলেও, তাদের ফর্মের গ্রাফ নিচের দিকে গেলেই গোটা টীম ডুবে যাচ্ছে। স্ট্রাইকারহীন টিম ভালো খেললে এক পয়েন্ট পেতে পারে, খারাপ খেললে শূন্য।