ষাটের দশকের মাঝামাঝি সময়। ব্রাজিলিয়ান ক্লাব স্যান্টোসে (Santos FC) তখন রাজ করছেন ফুটবল সম্রাট পেলে (Pelé)। আচমকাই একটু ফর্মে ঘাটতি। অনেক ভাবনাচিন্তা করেও যখন যুক্তিগ্রাহ্য কোনও কারণ তিনি খুঁজে পাচ্ছেন না, তখন তাঁর হঠাৎ করে মনে হলো, হয়তো নিজের “লাকি” জার্সিটা এক স্যান্টোস সমর্থককে দিয়ে দেওয়ার পরেই ফর্ম হারিয়েছেন তিনি। অগত্যা এক ডিটেকটিভ ভাড়া করে নিজের পয়া জার্সি খুঁজতে নামলেন পেলে এবং সপ্তাহখানেক পরে সেটা খুঁজেও পেলেন। আশ্চর্য্যের বিষয় এই যে, পয়মন্ত জার্সি খুঁজে পাওয়ার সাথে সাথেই পেলে খুঁজে পেয়েছিলেন তাঁর হারানো সেই ফর্ম।
ইস্টবেঙ্গলে (East Bengal) শেষ সর্বভারতীয় ট্রফি এসেছিলো ২০১২ সালের ফেডকাপে। এরপরে ২০১৮ সালে সুপার কাপে রানার্স আপ হওয়া ছাড়াও আইলিগে দুবার রানার্স, তিনবার তৃতীয় স্থানে শেষ করলেও ঠোঁট আর কাপের মধ্যে দূরত্বটা ঘোচেনি। একদিকে যখন ২০২০ সালে পড়শী ক্লাব মোহনবাগানের ফুটবল বিভাগ উঠে গিয়ে এটিকে-র সঙ্গে তাঁরা মার্জ হয়ে যাওয়ার পর যখন এটিকে মোহনবাগানের বর্তমান কর্ণধারদের অন্যতম উৎসব পারেখ (Utsav Parekh) “বাবা পুরোনো জিনিসটা ভুলে যান”-এর মতো উপদেশ দিয়েছেন, তখন অন্যদিকে ইস্টবেঙ্গলের বর্তমান ইনভেস্টর শ্রী সিমেন্ট কর্তৃপক্ষ (Shree Cement) উল্টোপথে হেঁটে ইস্টবেঙ্গলের ঐতিহ্যের এবং লাল হলুদ জনতার আবেগের আধা-লাল আধা-হলুদ হোম জার্সি এবং মহম্মদ হাবিবদের গায়ে চাপানো আশির দশকের অ্যাওয়ে জার্সি ফিরিয়ে এনেছেন। জার্সি তো ফিরলো, কিন্তু নতুন মরশুমে ভাগ্য ফিরবে কি? অপেক্ষার শুরু।
এমনিতেই ইস্ট-মোহন সমর্থক হওয়া মানেই ফুটবল মরশুমে টেনশনের কয়েক টন ওজনের বস্তা নিজের মাথায় চাপিয়ে নেওয়া। তবে গত কয়েক মরশুমে একাধিক মাঠের ও মাঠের বাইরের ঘটনায় ইস্টবেঙ্গল সমর্থকদের হতাশার পাল্লা যে একটু বেশীই ভারী, সেটা স্বীকার করতে দ্বিধা থাকার কথা নয়। এই মরশুমেও লাল-হলুদের টিম তৈরী হলো ট্রান্সফার উইন্ডোর শেষ ৩-৪ দিনে। ফলে অতি বড় ইস্টবেঙ্গল সমর্থকও মনে হয় বুক ঠুকে বলতে পারবেন না যে, যে কোনো প্রতিপক্ষকে হেলায় উড়িয়ে দেওয়ার মতো গোলাবারুদ ইস্টবেঙ্গলের অস্ত্রভাণ্ডারে মজুত আছে।
গোয়ার তিলক ময়দানে (Tilak Maidan) আজ পূর্ব ভারতের প্রতিবেশী ক্লাব জামশেদপুর এফসির (Jamshedpur FC) বিরুদ্ধে নামছে এসসি ইস্টবেঙ্গল (SC East Bengal)। তার আগে ইস্টবেঙ্গলের আশা ও আশংকার জায়গাটা একই – দলের বিদেশী স্কোয়াড। দলের প্রতিটি বিদেশীই নতুন, ফলে তাঁদের গুণগত মান কেমন হবে, মাঠে না নামলে জানার উপায় নেই। ইউটিউবের ভিডিও দেখে বিদেশী ফুটবলারদের ব্যাপারে ধ্যান ধারণা করাটা সমিচীন নয়।
গত পরশু থেকে এই মরশুমের আইএসএল শুরু হওয়ার পর হয়ে যাওয়া দুটো ম্যাচে গোল হয়েছে ১২ টি। দুটো ম্যাচেই দেখা গেছে, ভালো সেন্ট্রাল ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডারের অভাবে ভুগেছে কেরালা ব্লাস্টার্স এবং নর্থইস্ট ইউনাইটেড। যার খেসারত দিতে হয়েছে ৪ গোল হজম করে। এখানেই রক্ষণ সংগঠনের ক্ষেত্রে কিছুটা হলেও ভালো জায়গায় রয়েছে মানোলো ডিয়াজের দল। অভিজ্ঞ অস্ট্রেলিয়ান টমিস্লাভ মার্সেলা-র (Tomislav Mrcela) পাশাপাশি তাঁর হাতে রয়েছে ২৫ বছর বয়সী তরুণ ক্রোয়েশিয়ান স্টপার ফ্রানো পর্চে (Franjo Prce)। সঙ্গে আছেন আদিল খানও (Adil Khan)। তবে যেহেতু টুর্নামেন্টের প্রথম ম্যাচ, তাই স্প্যানিশ কোচ মানোলো দুই বিদেশী স্টপারে প্রথম একাদশ সাজালেও অবাক হওয়ার মতো কিছু নেই। সেক্ষেত্রে কোপ পড়বে আপফ্রন্টে। কারণ মাঝমাঠে ড্যারেন সিডোয়েলের জায়গা মোটামুটি পাকা ধরে নেওয়া যায়। তবে যদি টিম কম্বিনেশনের দিকে চোখ রাখতে হয়, তবে দলের প্রথম একাদশের চার বিদেশী হতে পারেন – মার্সেলা, ড্যারেন, আমির, চিমা। পরিবর্ত হিসেবে আসতে পারেন আন্তোনিও পেরোসেভিচ। গোয়ার খবর, রাজু গায়কোয়াড়ের (Raju Gaikwad) হয়তো হালকা চোট আছে।
তবে ইস্টবেঙ্গলের প্রথম একাদশে সবচেয়ে চিন্তার জায়গা হলো দুটো – লেফট ব্যাক এবং দ্বিতীয় স্ট্রাইকার। শেষবেলায় বাজারে বেরিয়ে চোখ ধাঁধানো রিক্রুট হয়তো সম্ভব ছিল না, তবুও লেফট ব্যাকে হীরা মন্ডল ছাড়া কোচের কাছে অপশন কই? জয়নার লরেন্সো (Joyner Lourenco), সাইখোম সিং বা সারিনিও ফার্নান্ডেজের (Sarineo Fernandes) মতো কিছু নাম থাকলেও তাঁরা হয় সেভাবে পরীক্ষিত নন, অথবা অনভ্যস্ত পজিশনে খেলতে বাধ্য হবেন। এমনকি হীরাও যতই সম্ভাবনাময় হন না কেন, এর আগে আইএসএলের মতো বড় মঞ্চে কখনও খেলেননি।
একই সমস্যা দ্বিতীয় স্ট্রাইকারের ক্ষেত্রেও। হাওকিপ হয়তো আজ শুরু করতে পারেন, স্কোয়াডে রয়েছেন কেরিয়ারের সায়াহ্নে পৌঁছানো বলবন্ত সিং। খুব একটা ভরসা করার মতো জায়গায় থাকবেন না লাল-হলুদ সমর্থকেরা।
তবে টিমের একটা খুব ভালো পজিটিভ দিক হলো, কিছু কিছু পজিশনে কোচের হাতে অনেক অপশন, এবং কয়েকজন প্রতিশ্রুতিমান ফুটবলারের স্কোয়াডে থাকা। ফোকাস ঠিক থাকলে আপফ্রন্টে নাওরেম মহেশ বা লেফট উইংয়ে সংপু সিংসিট কোচ মানোলোর তুরুপের তাস হয়ে উঠতেই পারেন। প্র্যাকটিস ম্যাচগুলোতে বেশ ভালো ফর্মে ছিলেন সৌরভ দাস। ম্যাচের মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারে পেরোসেভিচের স্কিলফুল পাসগুলোও। ফলে এই মরশুমে শেষ চারের লক্ষ্যে পৌঁছনো কঠিন হলেও অসম্ভব কোনোভাবেই নয়। শুধু দরকার গত মরশুমের মতো মাঠে এবং মাঠের বাইরের বিতর্ক থেকে যতটা সম্ভব ফুটবলারদের দূরে রাখা। ক্লাব-ইনভেস্টর দ্বন্দ্বে গত কয়েক মরশুমে ইস্টবেঙ্গলের যা অবস্থা, তাতে পান থেকে চুন খসলেই কিন্তু একশ্রেণীর সমর্থকদের দাঁতনখ বের হওয়া কেবল সময়ের অপেক্ষা। ফলে বছর তিনেক আগে রিয়েল মাদ্রিদের বি দলের হয়ে কোচিং করানো হোসে ম্যানুয়েল’ মানোলো ডিয়াজ ফার্নান্ডেজের (Manolo Díaz) জন্য সামনের চারমাসের পথ কিন্তু কণ্টকাকীর্ণ। রক্তাক্ত হওয়ার প্রবল সম্ভাবনা।
প্রতিপক্ষ জামশেদপুর এফসি এই বছর ধারে ভারে অত্যন্ত শক্তিশালী। দুর্দান্ত একটা দল এই মরশুমে হাতে পেয়েছেন কোচ ওয়েন কয়েল (Owen Coyle)। নেরিজুস ভালস্কিস (Nerijus Valskis), পিটার হার্টলে-রা (Peter Hartley) তো ছিলেনই, এই বছর বিদেশী স্কোয়াডে যুক্ত হয়েছে কেরালা ব্লাস্টার্স থেকে আসা জর্ডন মারে (Jordan Murray) এবং চেন্নাইন এফসি থেকে আসা এলি সাবিয়া-রাও (Eli Sabiá)। রেঞ্জার্স এফসি (Rangers F.C.) থেকে সেন্টার ফরওয়ার্ড হিসেবে এসেছেন গ্রেগ স্টুয়ার্ট (Greg Stewart)। ফলে ইস্টবেঙ্গলের রক্ষণ সংগঠন জমাট না হলে বিপদ বাড়তে বাধ্য। এই মরশুমে এফসি গোয়া থেকে জামশেদপুরে এসেছেন ঈশান পান্ডিতা (Ishan Pandita), এটিকে মোহনবাগান (ATK Mohun Bagan FC) থেকে এসেছেন প্রণয় হালদারও (Pronay Halder)।
সবমিলিয়ে, আইএসএলের কোনও ম্যাচই যেমন সহজ হবে না, সেভাবেই আজকের ম্যাচেও শুরুতেই বেশ কঠিন পরীক্ষা লাল-হলুদ ব্রিগেডের। তিন পয়েন্ট নিয়ে শুরু করতে পারলে সেটা পরের সপ্তাহের কলকাতা ডার্বির আগে বেশ খানিকটা আত্মবিশ্বাস যোগাবে চিমা, আদিল খানদের। নইলে হয়তো ডার্বিতে একটু পিছিয়েই শুরু করতে হবে ইস্টবেঙ্গলকে। তবে আগামী শনিবার তিলক ময়দানে মানোলোর কপালে জয়তিলক আঁকা হবে কিনা সময় বলবে, তবে তার আগে আজ রবিবাসরীয় সন্ধ্যায় জামশেদপুরের আক্রমণ জ্যাম করে তিন পয়েন্ট ঘরে তুলে আনাটা জরুরী।
পেলের গল্পটার শেষাংশ বাকি থেকে গেছে। শেষ পর্যন্ত পেলের ডিটেকটিভ কিন্তু ওনার পয়া জার্সিটা খুঁজে বের করতে পারেননি, তবে পেলেকে শান্ত রাখার জন্য অন্য একটা জার্সিকেই পয়া বলে চালিয়ে দেন। সেই জার্সি পরেই কিন্তু পেলে স্যান্টোসের হয়ে আবারও গোলের বন্যা বইয়ে দেন। ফলে, নতুন বা পুরোনো জার্সির ডিজাইন না, বাঙাল আবেগ বুকের মধ্যে জ্বালাতে পারলে সাফল্য খুব বেশীক্ষণ দূরে থাকতে পারবে না।
বাঙাল ক্যাপ্টেন অরিন্দম (Arindam Bhattacharya), টিম মিটিংয়ে নতুন ফুটবলারদের বলেছো তো ইস্টবেঙ্গলের ইতিহাস?