“গোল করতে পারো, গোল খাওয়া রুখবে কিভাবে?” কেরালা ব্লাস্টার্সের বিরুদ্ধে নামার আগে মতি নন্দীর স্ট্রাইকার উপন্যাসের এই প্রশ্নটাই বোধহয় ঘুরে বেড়াচ্ছে ইস্টবেঙ্গল শিবিরে।
লীগ টেবিলের শেষ স্থানে রয়েছে দল। গত ম্যাচে এগিয়ে গিয়েও পর্যুদস্ত হতে হয়েছে হায়দ্রাবাদ এফসির কাছে। এমন একটা অবস্থায় কোন জাদুমন্ত্রে ফাওলার দলকে জাগিয়ে তুলবেন, সেটাই দেখার। তবে আবেগ সরিয়ে দেখে বাস্তবের মাটিতে পা রাখলে, বিষয়টা কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে উঠছে ইস্টবেঙ্গলের কাছে।
নতুন বিদেশী ব্রাইট যোগ দিয়েছেন দলে। কিন্তু এখন তিনি কোয়ারেন্টাইনে, ডিসেম্বরে তাকে পাওয়া যাবে না। অন্যদিকে, ড্যানি ফক্স অনুশীলন করলেও কেরালার বিরুদ্ধে না খেলার সম্ভাবনাই বেশি। এমন একটা অবস্থায় ফাওলার কাকে খেলাবেন তার থেকেও বড়ো প্রশ্ন, কিভাবে খেলাবেন? একটা কথা স্পষ্টভাবে বুঝে নেওয়া উচিত – জয়ের সরণিতে ফেরার জন্য এটাই ইস্টবেঙ্গলের সবচেয়ে বড়ো সুযোগ।
কেরালা দলের অবস্থাও এই মুহূর্তে শোচনীয় এবং কিবু ভিকুনাও বুঝতে পারছেন যে আইএসএল কঠিন ঠাঁই। তাই ইস্টবেঙ্গলকে যদি শেষ চারের আশা জিইয়ে রাখতে হয়, এই ম্যাচটাই প্রত্যাবর্তনের প্রথম সোপান হতে পারে। স্কট নেভিলকে নিয়ে ক্ষোভের পারদ চড়লেও, এই মুহূর্তে ডিফেন্স তিনিই খেলবেন। দলের অন্য এক বিদেশী অ্যারন হয়তো প্রথম একাদশে শুরু করতে পারেন রবিবার। গত ম্যাচে সেভাবে নজর কাড়তে না পারলেও, তিনি নামার পরে ইস্টবেঙ্গল দ্বিতীয় গোলটি পায় ম্যাঘোমার হেডে। তিনি শুরু থেকে খেললে ধরে নেওয়া যায়, পিলকিংটন অনেকটা উইংয়ের দিকে সরে যাবেন। সেক্ষেত্রে ম্যাঘোমা এবং মাত্তি স্টেইনম্যানের উপর বাড়তি দায়িত্ব আসতে চলেছে মাঝমাঠ সামলানোর। গত ম্যাচে ডিফেন্সের সামনে থেকেও মাত্তির সরে যাওয়া ইস্টবেঙ্গলকে এক মিনিটে দুটো গোল খাইয়েছিল। দলের এই অবস্থায় তাকে আক্রমণে উঠে আসার নির্দেশ ফাওলার দেবেন বলে মনে হয়না। তবে পিলকিংটন উইংয়ে খেলা মানে, রফিককে মাঝখানে নিয়ে আসার অবকাশ পেতে পারেন লাল-হলুদ কোচ।
ফক্সের চোটের পরে, বহু হিসেব ওলোটপালোট হয়ে গেছে। তবুও, এই মুহূর্তে ইস্টবেঙ্গলের রক্ষণভাগের বিকল্পগুলি একবার দেখে নেওয়া যাক। চুলোভা জানুয়ারির আগে ফিরতে পারবেন না। রাণা ঘরামিকে সেন্ট্রাল ব্যাক হিসেবে খেলানোর ভরসা পাবেন না ফাওলার, তাই শেহনাজ এবং ইরশাদের শুরু করার সম্ভাবনাই বেশি। গত ম্যাচে শেষদিকে সুরচন্দ্র সিং নেমে বেশ কিছু আক্রমণ শানানোর চেষ্টা করেছিলেন। এই ম্যাচে নেভিলের কভার হিসেবে তাকে খেলানোর সম্ভাবনা থাকতে পারে। অন্য সাইডব্যাক হিসেবে নারায়ণ দাস শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ। অভিষেক আম্বেকর পরিবর্ত হিসেবে নামলেও, এই ম্যাচে হয়তো শুরু থেকে খেলতেও পারেন। ইস্টবেঙ্গলের সহকারী কোচ যদিও বলছেন পাঁচ ম্যাচে খেলোয়াড়দের মান নির্ধারণ করা সম্ভব নয়; তবে এই মুহূর্তে খুব জোর দিয়ে বলা যাচ্ছে না যে দলের উচ্চমানের ছয়জন ভারতীয় কারা। তাই ফাওলারের কাছে কালকের ম্যাচে গোলাপের চেয়ে কাঁটাই বেশি।
অন্যদিকে কেরালার সেন্ট্রাল ডিফেন্সের ভরসা কোনে তাদের সমর্থকদের নিয়ে যতই উচ্ছ্বসিত হন না কেন, দলকে নিয়ে হতে পারছেন না। গত ম্যাচে বেঙ্গালুরু এফসি উনিশটি শট মেরেছিল। কেরালার মূল সমস্যা তাদের মাঝমাঠে। একইসঙ্গে গোলরক্ষকের শিশুসুলভ ভ্রান্তিও তাদের হারের অন্ধাকারে ছুঁড়ে দিয়েছে কিছু ক্ষেত্রে। সুতরাং, রবিবার সন্ধ্যায় অ্যারন প্রথম থেকে শুরু করলে, তার পাশে বিনীথকেই খেলানো শ্রেয়ঃ। তার প্রধান কারণ, অ্যারন বলটা শিল্ড করতে পারেন। জেজে যেটা করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। এই পরিপ্রেক্ষিতে বিনীথ স্পিড এবং পজিশনিংয়ের নিরিখে কিছুটা হলেও এগিয়ে রয়েছেন। সেক্ষেত্রে ইস্টবেঙ্গল দল অনেকটা এরকম হতে পারে – দেবজিৎ, নেভিল, শেহনাজ, ইরশাদ, অভিষেক, স্টেইনম্যান, ম্যাঘোমা, রফিক, পিলকিংটন, বিনীথ, অ্যারন। বিকল্প হিসেবে নারায়ণ দাস অথবা সুরচন্দ্র রয়েছেন। তবে মনে রাখা দরকার, ইস্টবেঙ্গলকে জরডান মারে এবং গ্যারি হুপারের মতো আক্রমণভাগের খেলোয়াড়দের মুখোমুখি হতে হবে। নিশু কুমারের মতো একজন উইং ব্যাকের বিষাক্ত ক্রসগুলির মোকাবিলা করতে হবে ক্রমাগত। রাহুল কেপি বা প্রশান্থের গতির সঙ্গে পাল্লা দিতে হবে প্রতিটি বিন্দুতে। একট বিষয় মনে রাখা দরকার, কেরালার ডিফেন্সের অন্যতম সেরা খেলোয়াড় কোস্তা লাল কার্ড দেখার পরেই গত দুটি ম্যাচে হেরেছে তারা।
রবিবারের ম্যাচেও তিনি সাসপেনশনের কারণে বাইরেই থাকছেন। তাই ডিফেন্সের ফাঁকফোকর বের করে আনার সুবর্ণ সুযোগ রয়েছে ম্যাঘোমা-পিলকিংটনদের সামনে। দল নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষার মাঝেই, ইস্টবেঙ্গল কোচকে ইতিহাসের কথাও যদি কেউ বলতে পারতেন, তবে মন্দ হত না। সত্তর দশকে অনেক সময় পিকে ব্যানার্জি দুজন রাইট উইঙ্গারকে খেলিয়ে দিতেন একসঙ্গে। গতবার হায়দ্রাবাদে নিখিল পুজারীকে রাইট উইংয়ে রেখে কভার করা হত আশিস রাইকে। ইস্টবেঙ্গল সেই নীতি নিয়ে একবার ভাবতে পারে। সুরচন্দ্রকে যদি খেলানো হয়, সেক্ষেত্রে নেভিলকে সেন্ট্রাল ডিফেন্সে খেলিয়ে শেহনাজকে স্টেইনম্যানের পাশে জুড়ে দেওয়া। সেক্ষেত্রে সুরচন্দ্রকে কভার করার বাড়তি দায়িত্ব থাকবে রফিক বা পিলকিংটনের উপর। তবে একটা কথা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, এই ম্যাচ তিন পয়েন্টের জন্য ঝাঁপানোর ম্যাচ।
আবার একটি তৃতীয় সম্ভাবনা হিসেবে যে দলটির রূপরেখা উঠে আসছে, তা অনেকটা এরকম – দেবজিৎ, নেভিল, ইরশাদ, অভিষেক, সুরচন্দ্র (নেভিলের কভার), নারায়ণ (অভিষেকের কভার), শেহনাজ, স্টেইনম্যান, ম্যাঘোমা, পিলকিংটন, অ্যারন। সেক্ষেত্রে, ছকটা ৩-৫-২ আকার নিতে পারে। অ্যারন হলোওয়ের উপর বাড়তি নজর থাকবে তা বলাই বাহুল্য। তিনি যদি লাল-হলুদকে জয়ের দিশা দেখাতে পারেন, তবে হয়তো একটা জিয়নকাঠির ছোঁয়া লাগতে পারে ইস্টবেঙ্গল শিবিরে। সুতোর উপর দিয়ে হাঁটছে ইস্টবেঙ্গল। দুপাশে খাদ, সামান্য ভুলচুক মানে আরও তলিয়ে যেতে হবে। এমন একটা সময়ই তো জেগে ওঠার সঠিক মুহূর্ত। এটা সকলে জানেন আর ফাওলার জানেন না, সেটা হতে পারেনা। রূপকথা কি লিখতে পারবেন তিনি? সময় বন্ধু, সময়…
পূর্বাভাষ
ইস্টবেঙ্গল – ২
কেরালা – ১
(দ্বিস্তরীয় বা ত্রিস্তরীয় ডিফেন্স খেলালেই এই পূর্বাভাষ প্রযোজ্য)