ইউরোর (UEFA EURO 2020) কোয়ার্টার ফাইনাল খেলতে নেমে কিকঅফের আগে অসাধারণ সৌজন্যবোধের নিদর্শন রাখলেন চেক প্রজাতন্ত্রের টিম ম্যানেজমেন্ট। ম্যাচের শুরুতে ডেনমার্ক অধিনায়ক সিমন ক্যারের (Simon Kjær) হাতে ক্রিস্টিয়ান এরিকসেন (Christian Eriksen) নামাঙ্কিত চেক রিপাব্লিকের দশ নম্বর জার্সি তুলে দেন চেক অধিনায়ক টমাস সউচেক (Tomas Soucek)।
ডেনমার্কের কোচ ক্যাসপার হুলমন্ড (Kasper Hjulmand) ম্যাচের দিন সকালে বলেছিলেন, তাঁরা বার্সেলোনা (FC Barcelona) এবং ডাচ ফুটবলের কিংবদন্তী জোহান ক্রুয়েফের (Johan Cruyff) নির্ভীক ফুটবলের আদর্শে বিশ্বাসী। হুলমন্ডের কোচ বা খেলোয়াড় হিসেবে পরিসংখ্যান কোনোটাই আকর্ষক নয়। বরঞ্চ এরকম পরিসংখ্যান নিয়ে ডেনমার্ক জাতীয় দলের দায়িত্ব পাওয়া গেলেও, ভারতীয় জাতীয় দলের দায়িত্ব হয়তো দেওয়া হতো না। ড্যানিশ ফুটবল কি তাদের ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের (Danish Football Association) দুঃসাহসী কোচ নির্বাচনের সুফল পাচ্ছে?
ডেনমার্ক দলটি (Denmark national football team) ১৯৯২-এর পর ইউরো কাপের শেষ চারে উঠলো আবার। ঊনত্রিশ বছর আগে তারা চ্যাম্পিয়ন হলেও মজার ঘটনা হলো তারা সেই বছর মূলপর্বে যোগ্যতা অর্জন করতেই পারেনি। যুগোস্লাভিয়া (Yugoslavia) যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার কারণে তাদের জায়গায় সুযোগ পায় ডেনমার্ক। বর্তমান গোলকিপার ক্যাসপার শ্মাইকেলের (Kasper Schmeichel) বাবা পিটার (Peter Schmeichel) ছিলেন সেই ইউরো জয়ী টিমের গোলরক্ষক। ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের (Manchester United F.C.) হয়ে উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লীগ (UEFA Champions League), প্রিমিয়ার লীগ (Premier League) জিতেছিলেন বিশ্বের অন্যতম সেরা গোলরক্ষক পিটার শ্মাইকেল (Peter Schmeichel)। বাবার মতন প্রিমিয়ার লীগ জিতলেও লেস্টার সিটির (Leicester City F.C.) গোলরক্ষকের উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লীগ এখনো জেতা হয়নি ক্যাস্পারের। যদিও তাঁর দেশ আবার ইউরো জয়ের দুই ম্যাচের মধ্যে চলে আসলো তাঁর বিশ্বস্ত দস্তানার ভরসায়।
ম্যাচের ৫ মিনিটেই গোল করে এগিয়ে যায় ডেনমার্ক। প্রথম কর্ণার থেকে অরক্ষিত অবস্থায় হেডে গোল করে যান বরুসিয়া ডর্টমুন্ডের মিডফিল্ডার (Borussia Dortmund) টমাস ডেলানি (Thomas Delaney) (১-০)। স্ট্রাইগার লারসেনের (Stryger Larsen) একের পর এক সুযোগ সন্ধানী ক্রসে চেক রক্ষণ প্রথম কুড়ি মিনিট বেশ বিপর্যস্ত ছিল। সতেরো মিনিটের মাথায় এরকমই আরেকটা ক্রস থেকে প্রায় গোল করে ফেলেছিলেন ম্যাচের সেরা ডেলানি।
৪২ মিনিটে ডেনমার্কের হয়ে দ্বিতীয় গোলটি করেন ক্যাসপার ডোলবার্গ (Kasper Dolberg)। বাম প্রান্ত থেকে মেহলের (Joakim Mæhle) অসাধারণ ডানপায়ের আউটস্টেপ দিয়ে তোলা ক্রস অল্পের জন্য ব্রেথওয়েটের (Martin Braithwaite) মাথা মিস করলেও ছয় গজ বক্সের ভিতর থেকে ডোলবার্গের নিয়ন্ত্রিত ভলি জালে জড়িয়ে যায় (২-০)। ইউসুফ পৌলসেনের (Yussuf Poulsen) চোটের জন্য ওয়েলসের বিরুদ্ধে প্রথম দলে সুযোগ পেয়েই জোড়া গোল করে ভরসা জুগিয়েছিলেন ডোলবার্গ। এই ম্যাচেও প্রথম একাদশে সুযোগ পেয়ে কোচের বিশ্বাসের মর্যাদা রাখলেন। টুর্নামেন্টে এখনও পর্যন্ত মোট ৩ গোল করে ডেনমার্কের হয়ে ইউরোয় সর্বকালের সেরা গোলদাতার তালিকায় হেনরিক লারসেনের (Henrik Larsen) সঙ্গে একই পংক্তিতে চলে আসলেন ডোলবার্গ।
দ্বিতীয়ার্ধ শুরু হয় সম্পূর্ণ বিপরীত সুরে। শুরু থেকেই চেকরা আক্রমণের ঢেউ তুলতে থাকে। প্রথম দুই মিনিটের মধ্যেই তিনটি শট বাঁচান শ্মাইকেল। এর মধ্যে আন্তোনিন বারেকের (Antonín Barák) একটি শটে কোনো মতে শরীর ছুঁড়ে আঙ্গুল ছুঁয়ে বাঁচাতে হয় ড্যানিশ দলের শেষ প্রহরীকে। শেষ পর্যন্ত মুহুর্মুহু আক্রমণের সুফল আসে প্যাট্রিক শিকের (Patrik Schick) পা থেকে। ৪৯ মিনিটে ডানদিক থেকে ভ্লাদিমির কৌফলের (Vladimír Coufal) ভাসানো বলে পা ছুঁইয়ে ড্যানিশ ডিফেন্ডারের পায়ের ফাঁক দিয়ে বল জালে জড়িয়ে দেন প্যাট্রিক শিক (২-১)। টুর্নামেন্টে তাঁর পাঁচ নম্বর গোল করে ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডোর (Cristiano Ronaldo) সমান সংখ্যক গোল করে ফেলেন। দুজনেই ইউরো থেকে ছিটকে গেলেও, টুর্নামেন্টে টিকে থাকা খেলোয়াড়দের মধ্যে তাঁদের সবচেয়ে কাছাকাছি থাকা ডোলবার্গের এখনও গোলসংখ্যা তিন।
আজারবাইজানের রাজধানী বাকু শহরের অলিম্পিক স্টেডিয়ামে (Baku Olympic Stadium) দ্বিতীয়ার্ধে স্কোডা গাড়ির দেশ গতি পেলেও, অনায়াসে গোলসংখ্যা বাড়াতে পারতেন পৌলসেন, ব্রেথওয়েটরা। ফিনিশিং-এর অভাবে এবং তিন কাঠির নীচে ভাসলিকের (Tomáš Vaclík) দক্ষতায় গত দুই ম্যাচে চার গোল করা ড্যানিশ ডায়নামাইটদের (Danish Dynamite) দুই গোলেই থামতে হয়। ১৯৮৯ সালের ভেলভেট বিপ্লবের পর ১৯৯৩ সালে চেকোস্লোভাকিয়া ভেঙে তৈরী চেক রিপাবলিক প্রথম সুযোগেই উয়েফা ইউরো কাপ রানার্স হয়েছিল ১৯৯৬ সালে। পাভেল নেদভেদ (Pavel Nedvěd), পেটের চেক (Petr Cech) বা ইয়ান কোলারের (Jan Koller) মতো তারকা না থাকলেও সিলেভির (Jaroslav Šilhavý) প্রশিক্ষণাধীন চেকরা কোয়ার্টার ফাইনালে পৌঁছোয় ফেভারিট নেদারল্যান্ডসকে (Netherlands national football team) ছিটকে দিয়ে। তাদের ইউরো ২০২০ অভিযান শেষ হলো কোয়ার্টার ফাইনালেই।
১৯৯২ সালে ইউরো কাপ জেতার পর এই প্রথম সেমিফাইনালে উঠলো ফিফা ক্রমপর্যায়ে বিশ্বের দশ নম্বর দেশ। টুর্নামেন্টে ক্রিস্টিয়ান এরিকসেনের বিভীষকাময় শুরুর পর স্বপ্নের ইউরো-সমাপ্তির দিন গোনা শুরু ইউরো কাপের সেমিফাইনালে পৌঁছনো একমাত্র স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশের।