অঘটনের ইউরোর কোয়াটার ফাইনালে মিউনিখের আলিয়াঞ্জ এরিনা-তে (Allianz Arena) প্রতিযোগিতার অন্যতম সেরা দুই দল বেলজিয়াম আর ইতালি মুখোমুখি হয়েছিলো। জমজমাট খেলায় ২-১ জিতে সেমিফাইনালে গেলো ইতালি। সেমিতে তারা মুখোমুখি হবে স্পেনের (Spain national football team)।
প্রত্যাশিত ভাবেই আজেকের খেলায় দুটি দলই খুব বেশি পরিবর্তন করে নি। হ্যামস্ট্রিং চোটের জন্য বেলজিয়াম অধিনায়ক হ্যাজার্ড (Eden Hazard) খেলতে না পারলেও আগের দিন চোট পাওয়া ওপর তারকা দ্য ব্রুইনে (Kevin De Bruyne) শুরু করেছিলেন। হ্যাজার্ডের জায়গায় আক্রমভাগে শুরু করেন ডোকু (Jérémy Doku)। অপরদিকে আজ ইতালির দলে ফিরলেন অধিনায়ক কিয়েলিনি (Giorgio Chiellini)। আর ডান প্রান্তে আগের দিন নিষ্প্রভ বেরারদির (Domenico Berardi) জায়গায় শুরু করেন কিয়েসা (Federico Chiesa)।
সম্পূর্ণ ভিন্ন স্ট্র্যাটেজিতে খেলা দুই দল আক্রমণ প্রতিআক্রমণে উপভোগ্য খেলা উপহার দিলো। ইতালি (Italy national football team) নিজেদের দখলে বল রেখে প্রতিপক্ষের বক্সের বাইরে ছোট ছোট পাস খেলে আক্রমণ তৈরি করার প্রচেষ্টা করে গেলো। সারা খেলাতেই বলের দখল অনেকটাই বেশি ছিল ইতালির ( ৫৪% ইতালি – ৪৬ % বেলজিয়াম)। ইতালির বাম প্রান্তে ইনসিনিয়া (Lorenzo Insigne) আর স্পিনাজ্জোলা (Leonardo Spinazzola), ডান প্রান্তে কিয়েসা আর মাঝখানে ভেরাট্টি (Marco Verratti) অনবদ্য। তবে এক্ষেত্রে উল্লেখ করতেই হয় বেলজিয়মের রক্ষণের একটু বেশি পেছন থেকে খেলার প্রবণতার জন্য ইতালি বক্সের বাইরে শুধু নয়, বক্সের ভেতরেও অনেক বিপদজনক পাস খেলার সুযোগ পাচ্ছিলো।
অন্যদিকে লুকাকুকে সামনে রেখে দ্য ব্রুইনে আর ডকুর গতির ওপর ভরসা করে প্রতি মূলত প্রতিআক্রমন নির্ভর ফুটবল খেলে গেলো বেলজিয়াম (Belgium national football team)। বনুচি (Leonardo Bonucci) আর কিয়েলিনির তুলনামূলক মন্থর রক্ষণকে গতি দিয়ে পরাস্ত করার পরিকল্পনা নিয়ে মাঠে নেমেছিলো বেলজিয়াম। মাঝমাঠ থেকে লুকাকুর (Romelu Lukaku) উদ্দেশ্যে বাড়ানো বল বা দ্য ব্রুইনের এবং ডোকুর দৌড় বেশ কয়েকবার বিপদ তৈরিও করে।
শুরু থেকেই সমানে সমানে খেলা হয় দুই দলের । প্রথম ১০ মিনিটেই লুকাকু দুবার গোলের কাছাকাছি চলে গিয়েছিলেন। এরপর ফ্রিকিক থেকে করা ১২ মিনিটেই ইনসিনিয়ার সেন্টার থেকে বনুচি গোল করলেও অফ সাইডের জন্য ইতালির এই গোল বাতিল হয়। অন্যদিকে ২১ মিনিটে মাঝমাঠ থেকে একক দক্ষতায় বল নিয়ে এসে দ্য ব্রুইনের দুর্দান্ত শট ডান দিকে ঝাঁপিয়ে পড়ে অবধারিত গোল আটকান ইতালির গোলকীপার জিয়ানলুইগি ডোনারুমা (Gianluigi Donnarumma)। ২৫ মিনিটে আবার লুকাকুর বক্সের বাইরে থেকে নেওয়া আরেকটি শট বাঁচান তিনি। প্রতিআক্রমনের কয়েকটা সুযোগ ছাড়া বাকি খেলাটা কিন্তু মূলত বেলজিয়ামের অর্ধেই হয়েছে।
৩১ মিনিটে রক্ষণের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে খেলার প্রথম গোলটি করে ইতালি। একটা সাধারণ ফ্রিকিক ক্লিয়ার না করতে পাড়ার ফলে বেলজিয়াম বক্সের ঠিক বাইরে ভেরাট্টি বল পেয়ে যান। তিনজন ডিফেন্ডারের মাঝে থেকেও তাঁর বাড়ানো বল থেকে বক্সের মধ্যে খুব ছোট জায়গার সুন্দর গোল করেন বারেলা (Nicolò Barella) (১-০)।
৪৪ মিনিটে বা দিক থেকে বল নিয়ে ইনসিনিয়া (Lorenzo Insigne) ডান পায়ের বাঁকানো শটে দৃষ্টিনন্দন গোল করে ব্যবধান ২-০ করেন। ডান পায়ের খেলোয়াড় ইনসিগনের সবসময় প্রবণতা থাকে বাঁ দিকে একটু জায়গা পেলেই এই বাঁকানো শটে টপ কর্নার ফিনিশ করার। প্রতিযোগিতায় এই নিয়ে দ্বিতীয় বার এভাবে গোল করে সফল হলেন তিনি। এই গোলটা নিঃসন্দেহে প্রতিযোগিতার অন্যতম সেরা গোল হবার দাবিদার।
কিয়েসা আর ইম্মোবিলে (Ciro Immobile) সুযোগের সঠিক ব্যবহার করলে প্রথমার্ধেই আরো গোল করতে পারতো ইতালি। সারা খেলাতেই সেভাবে কার্যকরী দেখা যায়নি ইম্মোবিলেকে। দ্বিতীয়ার্ধে তাই তাকে বসিয়ে দিতে বাধ্য হন মানচিনি (Roberto Mancini)। প্রথমার্ধের শেষে ডোকুকে ফাউল করলে পেনাল্টি পায় বেলজিয়াম। পেনাল্টি থেকে গোল করে ২-১ করেন লুকাকু। সারা খেলায় ইতালির সুশৃঙ্খল রক্ষণ এই একবারই সম্ভবত বড় ভুল করেছিলো।
দ্বিতীয়ার্ধের খেলাও একই গতিতে হয়। বেশ কিছু সুযোগ পায় দুই দলই। ৬৬ মিনিটে ইনসিনিয়ার পাস থেকে স্পিনাজ্জোলার ভলি একটুর জন্য গোলের বাইরে না গেলে বা ৬৯ মিনিটে ইনসিগনের আবার একইরকম ডান পায়ের বাঁকানো শট সোজা গোলকীপারের হাতে না গেলে ব্যবধান বাড়াতেই পারতো ইতালি।
তবে অন্তত দুবার গোল শোধ করার সহজ সুযোগ পেয়েছিলেন লুকাকু। ৬১ মিনিটে ডোকুর বুদ্ধিদীপ্ত পাস থেকে বক্সের মধ্যে বাঁদিকে ফাঁকায় বল পান দ্য ব্রুইনে। দ্বিতীয় পোস্টে তার গড়ানো সেন্টার থেকে গোল করতে পারেননি লুকাকু। স্পিনাজ্জোলা জায়গায় এসে আটকে দিয়েছিলেন গোলমুখী দুর্বল শট। ৭১ মিনিটে পরিবর্ত চাদলি (Nacer Chadli) বাঁ দিক থেকে রাখা আরেকটি সেন্টারেও মাথা ঠেকাতে পারেননি লুকাকু। হেড দিতে পারলেই সামনে ফাঁকা গোল ছিল তার। তবে নজর কাড়লেন ডোকু। দ্বিতীয়ার্ধে একাধিক বার বা দিক থেকে তার দৌড় ইতালি রক্ষণকে বিপদে ফেলছিলো। খেলার একদম শেষ সময়ে ৮৪ মিনিটে বাঁদিক থেকে ভেতরে ঢুকে একাধিক খেলোয়াড়কে কাটিয়ে বক্সের বাইরে থেকে শট মারলেও গোলে রাখতে পারেননি তিনি। একটুর জন্য বারের ওপর দিয়ে চলে যায় শট। ভবিষ্যতের তারকা হওয়ার সমস্ত রসদ রয়েছে এই তরুণ খেলোয়াড়ের।
সবশেষে বলতে হয় প্রতিযোগিতায় ফর্মের বিচারে দুটো দলই কিন্তু ফাইনাল খেলার দাবি রাখে। বিশেষ করে ফ্রান্স,পর্তুগালের মতো দলের বিদায়ের পর সাধারণ সমর্থকরা তাই চেয়েছিলো। দুর্ভাগ্য বেলজিয়ামকে বিদায় নিতে হল। তাদের এই স্বর্ণালী প্রজন্মের ফুটবলাররা হয়তো দেশের জন্য বড় প্রতিযোগিতা জেতার শেষ সুযোগ হারালো।
অন্যদিকে প্রশিক্ষক মানচিনির (Roberto Mancini) এই নতুন ইতালি দলের খেলা একেবারেই ইতালি সুলভ নয়। তাদের দৃষ্টিনন্দন পাসিং ফুটবল বরঞ্চ মাঝে মাঝে তিকিতাকার স্পেনকে মনে করায়। এখন দেখার এই খেলা বজায় রেখে ইউরো জিততে পারে নাকি ইতালি।
তবে এই জয়ের মধ্যেও ইতালির জন্য বড় খারাপ খবর স্পিনাজ্জোলার চোট। ৭৮ মিনিটে চোট পেয়ে বসে যাবার সময় মনে হলো তার চোট বেশ মারাত্মক। গুরুত্বপূর্ণ এই খেলোয়াড়কে প্রতিযোগিতায় আর দেখতে পাবার সম্ভবনা কম।