দুটো দলের খেলা। আই লীগ থেকে আই এস এলে উঠে আসা দুটো দল। একটির বছর তিনেক হোলো আর একটির এটিই প্রথম বছর সদ্য দেশের সর্বোচ্চ প্রতিযোগিতার মুকুট অর্জন করা টূর্ণামেন্টটিতে। প্রথম দলটি নবীন অথচ পেশাদারিত্বর এক দুরন্ত নিদর্শন নিয়ে এসেছে ভারতীয় ফুটবলে। একবার আই এস এল জিতেও নিয়েছে। যদিও পরপর তিন টি ম্যাচ হেরে তারা রীতিমতো চাপে। তাদের তিন বছরের পুরোনো কোচ বিতাড়িত এবং অন্তর্বর্তী কোচের পরিচালনায়। সেট টীম হলেও খারাপ ফর্ম আর চোট আঘাত টাই মূল সমস্যা।
দ্বিতীয় দলটি শতবর্ষ পূর্তির প্রেক্ষাপটে আভ্যন্তরীন সমস্যায় জর্জরিত। কোনো রকমে জোড়াতালি দেওয়া একটা দল। আর বিশ্বব্যাপী প্রতিপত্তিশালী এক নবীন ব্রিটিশ কোচ। প্রথম ৫ টা ম্যাচ-এ ১ পয়েন্ট নিয়ে লীগ-এর যাত্রা শুরু করেছে । অনেক নিন্দে -মন্দ সামলে একটু একটু করে পায়ের তলার মাটি পাচ্ছে। লীগে টিকে থাকার জন্য এই ম্যাচ-এ জয় তা ভীষণ জরুরি। তবে রেফারি-র বদান্যতায় তাদের কোচ এই ম্যাচ-এ নির্বাসিত এবং এই ম্যাচটি সহকারী কোচের তত্ত্বাবধানে। ভালোর মধ্যে শুধু ম্যাচ শুরুর কিছু সময় আগে তাদের ক্যাপ্টেনকে লাল কার্ডের কবল থেকে ছাড়িয়ে আনা গেছে।
এই দুটো দলের রেষারেষি আধুনিক ভারতীয় ফুটবলে বেশ উত্তেজনা এনেছিল মাঝের বছর চারেক। এইরকম জীর্ণ দশা দুই দলের হৃষ্টপুষ্ট সমর্থক বৃন্দের জন্য কষ্টকর। প্রথমটির ক্রমাগত সাফল্য আর দ্বিতীয়টির একশো বছরের আবেগ ছাপানো হতাশা। যাই হোক, খেলা হোলো বেঙ্গালুরু আর ইস্টবেঙ্গলের। এবার দেখা আই এস এলে। ইস্টবেঙ্গলের সমর্থকদের মনে শেষ সাক্ষাতের চার গোলের দগদগে স্মৃতি। তার প্রতিশোধ নেবার একটা আশা হঠাৎই যেন ভেসে উঠেছে। এবং সেই আশা কড়ায় -গন্ডায় না হলেও পূর্ণ হয়েছে।
কয়েকটা তাৎপর্য্যপূর্ণ বিষয় আলোচনা করা যাক
১) ইস্টবেঙ্গল টিমে আরনের জায়গায় মাঘোমার অন্তর্ভুক্তি ছাড়া আর কোনো পরিবর্তন ছিলোনা। কিন্তু তাতে পরিকল্পনায় পরিবর্তন এসেছিলো বলাই বাহুল্য। গোয়ার ম্যাচ থেকে যেমন কোচ এক পয়েন্ট নিতেই নেমেছিলেন, এই ম্যাচ থেকে কিন্তু একটা সাবধানী অথচ জয় ছিনিয়ে নেবার প্রচেষ্টা ছিল শুরু থেকেই। বেঙ্গালুরু যদিও বেশ কয়েকটি পরিবর্তন করেছিল প্রথম একাদশে।
২) হার্মানপ্রীত থেকেই শুরু করি। ছেলেটি প্রচুর খাটে। ওর দৌড়াদৌড়ি বিপক্ষ ডিফেন্ডারদের বল বিতরণের কাজটি কঠিন করে তোলে। এটি গোয়া ম্যাচেও দেখা গেছে। ওর গোল করার ক্ষমতা তেমন তৈরী না হলেও , এই অভিজ্ঞতাগুলো ইস্টবেঙ্গল তথা ভারতীয় ফুটবলের সম্পদ হয়ে উঠতে পারে। ব্রাইট-ও যখন বক্স -স্ট্রাইকার নয় তখন নামে -ভারে বড়ো কারুকে মাঠে শিখণ্ডীর মতন দাঁড় না করিয়ে রেখে হার্মানপ্রীত কে খেলানো নিয়ে আর কোনো প্রশ্ন থাকতে পারে বলে`মনে`হয়না।
৩) মাঘমা মূলত বাঁ দিকের খেলোয়াড় হলেও গোটা মাঝমাঠ জুড়ে খেলে। ফিটনেসের উন্নতি ঘটায় ডিফেন্সে অবদান এখন অনেক বেশি। তার উপর বলের উপর কর্তৃত্ব আর শরীরের দুর্দান্ত ব্যবহার করে খেলার গতি নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা মিলন সিংহ-এর কাজটা অনেক সহজ করে দিচ্ছে। আগের ম্যাচে আরন মূলত বল ধরে খেলার গতি কমাচ্ছিল যাতে গোয়ার দুরন্ত মাঝমাঠ কে সামাল দেবার জন্য ডিফেন্স তৈরী থাকে।
৪) মিলন সিংহ ক্রমশঃ উন্নতি করছে। মাঘমার সাহায্য পাওয়ায় ও আড়াআড়ি খেলতে পারছে। আর তাতে স্টেইনম্যান বক্স থেকে বক্স খেলার সুযোগ বেশি পাচ্ছে। যেটা আক্রমণ ভাগে শক্তি বাড়াচ্ছে।
৫) ম্যাত্তি স্টেইনম্যানের ডিফেন্সিভ অবদান মসলিনের মতো মসৃন। তদুপরি আক্রমণের প্রেক্ষিতে তার মাঝমাঠ ধরে সাবলীল দৌড় বেঙ্গালুরুর মাঝমাঠের প্লেয়ারদের বিভ্রান্ত করেছে বারবার। বক্সের ভিতর তার ‘সঠিক সময়ে সঠিক জায়গায় ‘ থাকার প্রবণতা উপযুক্ত স্ট্রাইকারহীন ইস্টবেঙ্গলকে গোয়াল পেতে সাহায্য করলো আজকেও।
৬) ব্রাইট বল ধরলেই দুজন প্লেয়ার কভার করছে যেটা মাঘমা, স্টেইনম্যান বা আরন কে বাড়তি জায়গা দিয়েছে বারবার। এমনকি হারমানপ্রীত-ও একবার দারুন জায়গায় বল পেয়ে গেছিলো। দ্বিতীয় হাফে দমে ঘাটতি পরলেও আর কটা ম্যাচ গেলেই সেই সমস্যা কাটিয়ে ওঠা যাবে বলেই মানি হয়। আর আপাতত আরন ছাড়া সব বিদেশী-ই নিজেদের প্রমাণ করতে পারায় ফাউলার রোটেশন করতে পারবেন নিশ্চিন্তে।
৭) আরন বাকিদের তুলনায় ম্লান হলেও আমার বিশ্বাস ওকেও সময় দিলে নিজের কাজ তা ঠিক করে দেবে। একাধিক জায়গায় খেলতে পারায় ও কিন্তু কোচকে বাড়তি বিকল্প দেয়।
৮) প্রথম হাফে, মাঘমা ফিরে আসায় আর উদান্তার দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে নারায়ণ উপরে উঠে আসছিলো অনেক বেশি আর আক্রমণ ভাগে অনেক সক্রিয় ছিলো। একটা গোল বা দুটো ভালো ম্যাচ ওর আত্মপ্রত্যয় বাড়িয়ে তুলবে নিশ্চিত ভাবে।
৯) চার বিদেশী নিয়ে ম্যাচ শুরু করা বেঙ্গালুরু দ্বিতীয় অর্ধে সেন্ট্রাল ফরওয়ার্ডে নিয়ে আসে ক্রিস্টিয়ান অপসিথ কে। নারায়ণ ডিফেন্সে মনোনিবেশ করে আর বেঙ্গালুরু ইস্টবেঙ্গলের ডান প্রান্তে থাকা অঙ্কিতের দিক থেকে আক্রমণ তুলে আনার চেষ্টা করতে থাকে সুনীল ছেত্রীর মাধ্যমে। বার দুয়েক বক্সের উপর থেকে শটের সুযোগ পেলেও দেবজিৎ ‘সেভজিৎ’ হয়ে ওঠে বারবার।
১০) অঙ্কিত, ম্যানেজমেন্টের মাস্টার স্ট্রোক সাইনিং। বার দুয়েক ভারত অধিনায়কের কাছে হার মানলেও অঙ্কিতের মানসিক দৃঢ়তা লক্ষণীয়। প্রথম অর্ধে গোলের ক্ষেত্রে অবদান ছাড়াও উইং ধরে বেশ কয়েক বার অঙ্কিত উঠে এসেছে।
১১) গত কয়েকটা ম্যাচে রাজুর ধারাবাহিকতা নিয়ে বেশি কিছু বলার নেই। ওর ইস্টবেঙ্গলের সাথে প্রথম অধ্যায়টিতে যেটার খুব অভাব ছিলো ।
১২) নেভিল আর ফক্স আসতে আসতে নিজের সেরা খেলাটা দিতে শুরু করেছে। একাধিক ব্লকিং তো বটেই, যেই বেঙ্গালুরু সেট-পিস বৈচিত্র্যে ছবি আঁকে, আর বিপক্ষের কাছেই সেই শিল্প ঠিক গোলক ধাঁধার মতো লাগে, সেই বেঙ্গালুরুর সেট-পিস রীতিমতো ভোঁতা করে দেয়া গেছিলো।
১৩) যারা ম্যাচ দেখেন নি, ‘ম্যান অব দ্য ম্যাচ ‘ দেবজিৎ কেন সেটা ম্যাচের হাইলাইটস দেখলেই পরিষ্কার বোঝা যাবে। দেবজিতের হাতের থেকে ‘ডিস্ট্রিবিউশন’-এর উন্নতি গোয়া ম্যাচ থেকেই দেখা যাচ্ছে। দূরের শটে অপ্রতিরোধ্য। আর ডিফেন্স এরিয়াল বলে অসামান্য উন্নতি ঘটানোয় ওই একমাত্র চিন্তার জায়গাটা খুব একটা প্রকট হচ্ছেনা।
১৪) পিলকিংটন ফিট। এখন ফাউলারের কাছে ভেবে দেখার ছয়ের মধ্যে কোন পাঁচ বিদেশী নামবে। আরন যে বেঞ্চে বসবে সেটা এক প্রকার নিশ্চিত।
১৫) সব শেষে তিন পয়েন্ট। ইস্টবেঙ্গল সমর্থকদের জন্য স্বপ্নের পরিধি বড়ো করার শুরু। বছরের শুরুটা বেশ ঝলমলে।