সারাবছর ফুটবল নিয়ে আলোচনার বিষয় যাই হোক না কেন! ডার্বি ম্যাচের কয়দিন আগে থেকেই শুরু হয়ে নিজেদের দলের হয়ে সওয়াল বা বিপক্ষ সম্পর্কে নানা টিপ্পনি। কখনও সেটা খুবই মজার হয় কখনও আবার তা ব্যক্তিগতও হয়ে ঝগড়ার পর্যায়েও চলে যায়। কিন্তু তাও বাঙালির মজ্জা থেকে ডার্বির আবেগ কিন্তু একবিন্দুও কম হয় না। একটা ডার্বি গোটা বাংলাকে অনায়াসে দুই ভাগে ভাগ করে দেয় কটা দিনের জন্য। শুধু বাংলা কেন এই কদিন পরিবারের লোকজন, বন্ধুবান্ধব, অফিস কলিগ এমনকি প্রেমিক-প্রেমিকাও যেন একটা ছোট্ট তৃতীয় বিশ্ব যুদ্ধে সামিল হয়ে পরে। লোকাল ট্রেন, পাড়ার চায়ের দোকান, অফিস কাছারি, শপিংমল, সোশ্যাল মিডিয়া, হোয়াটসআপ গ্রুপ সবেতেই যেন একটা একে অপরকে বিদ্ধ করার লড়াই নিজেদের কথার বাণে।
আমার ডার্বির হাতেখড়ি সেই ডায়মন্ড ম্যাচের সময়। মাঠে গিয়ে দেখা হয়নি কিন্তু টিভির পর্দায় ডার্বি কি বস্তু সেটা প্রথম চাক্ষুস করা। বাড়িতে বসে ডার্বি দেখা কিন্তু একটা ডার্বি খেলার ঠেকে কম কিছু নয়। আমার দাদু সিগারেট খুব একটা খেতেন না কিন্তু বিড়ি খেতেন বেশ অনেকটাই। কিন্তু ডার্বিতে ইস্টবেঙ্গল গোল করলে বা জিতলে সিগারেট জ্বালিয়ে এসে বলতেন, “আজ ইস্টবেঙ্গল গোল দিল আর জিতলো। তাই আজকে সিগারেট ধরাতেই হবে আনন্দে”। আমাদের ইস্টবেঙ্গল কে সমর্থন করার বিজটা সেই বহুবছর আগে থেকেই বোনা ছিল। ঠিক তেমনই আমার বড় পিসেমশায়ের পরিবার কট্টর মোহনবাগানি। এমনও শুনেছি যে তিনি তার বন্ধুদের সাথে মাঠে ডার্বি দেখতে গিয়ে ভুল করে ইস্টবেঙ্গল গ্যালারিতে ঢুকে পড়েছিলেন। সেই অবধি ঠিক ছিল কিন্তু মোহনবাগান গোল দেওয়ার পরে নিজের উচ্ছাস আর চেপে রাখতে পারেননি। গল্প করেছিলেন যে বাঙাল গ্যালারিতে সেই উচ্ছাস দেখানোর পুরস্কার স্বরূপ হাতে হাতে তুলে নিয়ে তাদেরকে ফেনসিং টপকে পাশের মোহনবাগান গ্যালারিতে ফেলে দিয়েছিল।
সেই পিসেমশায়ের ছেলে আমার দাদা সে আরো বড় কট্টর মোহনবাগান সমর্থক। ডার্বি বাদে অন্য সময় তো প্রায়ই চলে এই ডার্বি যুদ্ধ। আর যদি কখনো একসাথে বসে ডার্বি দেখা হয় টিভিতে তাহলে তো যেন বাড়িতেই একটা ডার্বি হওয়ার উপক্রম। ডার্বির দিন মাঠে গিয়ে যদি এদিক ওদিক করে দেখা হয়েও যায় তাও ওই সময় টুকু উত্তর আর দক্ষিণ কোরিয়ার চাপা লড়াইয়ের মতন পরিস্তিতি বিদ্যমান থাকে। নিজে চোখে দেখেছি ব্যারেটো গোল মিস করায় সেই আক্রোশ টা আরেকটু হলেই টিভির উপর পড়ছিল।
গত বছর দুয়েক ধরে ভাইফোঁটার সময় একটা ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় খুব ঘোরাফেরা করছে যেখানে ইস্টবেঙ্গল জার্সি পরা বোন মোহনবাগান জার্সি পরা দাদাকে ফোঁটা দিচ্ছে। সেই ঘটনাটিও আমাদের বাড়িতেই আমার সামনেই হয়েছিল। আমার আরেক পিসতুতো বোন সেই দাদাকেই তাদের প্রিয় দলের জার্সি পরে ফোটা দিচ্ছিল। কিন্তু ডার্বি আসলেই দুজনেই কথার বাণে একে অপরকে বিদ্ধ করবেই।
বন্ধুদের গ্রুপে তো ডার্বি নিয়ে বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্য, অনৈক্য, মতানৈক্য সব বর্তমান। আমার ছোটবেলার এক বন্ধুর পরিবারের সবাই বাঙাল, সে নিজেও তাই। কিন্তু হঠাৎ খবর পাওয়া গেলো যে সে মোহনবাগান সমর্থক যদিও তার পরিবার ইস্টবেঙ্গল এর সাপোর্ট করে। বাকি বন্ধুরাও ডার্বির সময় একে অপরকে ধরে ছেড়ে কোনো কিছুতেই কথা শোনাতে ছাড়ে না। কারোর প্রিয় দল ডার্বিতে হেরে গেলে এক বেলা বা একদিন হয়তো আড্ডাতেই আসবে না। কারণ জানে তো আড্ডাস্থলে জয়ের স্বাদ পাওয়া শিকারীরা ওৎ পেতে বসে রয়েছে একটু একটু করে টিপ্পনি আর মশকরায় তাকে ঘিরে ধরবে বলে। আবার সারাদিন সোশ্যাল মিডিয়ায় ঘুরে বেড়ানো বন্ধুটার প্রোফাইলও একদিনের জন্য সমাধিতে চলে যায় এই ডার্বির পরেই।
পাড়ার চায়ের দোকান বা সেলুন বা লোকাল ট্রেনের দৈনিক যাত্রীরা তো আরও মজাদার। এই ডার্বির আগে বা পরে শয়ে শয়ে ফার্গুসন, মৌরিনহো, গার্দিওলার জন্ম দেয়। ভারতীয় ফুটবল নিয়ে চর্চা না করা কেউ যদি ওখানে এই কদিন উপস্থিত থাকে তাহলে ম্যাচের প্রিভিউ-রিভিউ দুটোই পেয়ে সেও আস্তে আস্তে পরবর্তী সময়ে সেই ডার্বির উন্মাদনায় জড়িয়ে যায়। লোকাল ট্রেনে যারা দৈনিক যাত্রা করে তারা তো একটা তো জীবনে অন্ততঃ একবার শুনেই থাকবে, “এখন আর কোথায় সেই খেলা হয়! খেলা তো হতো আমাদের সময়”। অফিসের ডার্বি লড়াইটা আবার একটু অন্যরকম। গর্বের সাথে সবাই ইস্টবেঙ্গল মোহনবাগান কে সমর্থন করার কথা বলে। কিন্তু ডার্বির শেষে ওই মজাদার টিপ্পনি গুলো একটু সীমিতই রাখতে হয়। পাছে অফিস কলিগের গোসা হয়ে যায় আর সমস্যার তৈরি হয়। কিন্তু তার মধ্যেও কিছু কলিগ বা বস পাওয়া যায় যে কিনা একদম ভিন্ন ধারার। আমারই এক প্রাক্তন ছিল যার সাথে কিনা কর্মসূত্রে দাদা-ভাইয়ের মত সম্পর্ক হয়ে গেছিল। বসকে একদিন অফিস ট্যুরের সময় জিজ্ঞেস করলাম যে কাল রাতের রিয়াল মাদ্রিদের খেলা দেখলো কিনা! উত্তর দিল, “আমি শুধু ইস্টবেঙ্গলের খেলা দেখি”। সেই বসই চাকরি ছাড়ার বহু বছর বাদে একদিন দুপুরে ফোন করে বলল, “ওরে আমি ট্রেনে আছি, নেট পাচ্ছি না। তুই আমি তোকে কল করবো মাঝে মাঝে তুই আমায় খেলার আপডেট দিতে থাকিস।” ডার্বির মজা এমনই যে প্রেমিক-প্রেমিকার মধ্যেও নিজের নিজের দল নিয়ে দ্বন্দ্ব বেঁধে যায় অনেক সময়। প্রিয় দল জেতার পর কতজনই না ফোন করে তার সঙ্গীকে বলেছে, “কি হেরে গেলে তো! বলেছিলাম তো আমাদের টিমের সাথে কোনদিনই পারবে না তোমরা”।
বাঙালির এই ডার্বিই জন্ম দিয়েছে কত নায়কের। ডার্বিতে গোল করে হয়ে উঠেছে কত সমর্থকের নয়নের মণি। আবার খুব বাজে খেলে কত নায়ক খলনায়কে পরিণত হয়েছে তার হিসেব পাওয়া দায়। যেদিন থেকে ডার্বির দিন জানা যায় সেই দিন থেকেই লাখ লাখ অনুরাগী অপেক্ষা করে বসে থাকে সেই দিনটার, সেই মাহেন্দ্রক্ষণটার। খেলার আগের দিন থেকেই গাড়ি বুক করা থেকে শুরু করে যার যার কাছে জার্সি, পতাকা যা আছে তা জোগাড় করার মধ্যেও কতজন কত আনন্দ খুঁজে পায় তা বলে বোঝানো যায় না কখনোই। সকাল থেকে সাজো সাজো রব। প্রচুর স্লোগান, ছড়া, গান হতে হতে সব লাল-হলুদ, সবুজ-মেরুন গাড়ি গুলো রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে যাত্রা শুরু করে। গন্তব্য সবার এক। সেই বিবেকানন্দ যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গন। আর সেই যাত্রাপথে কত অচেনা মুখই আপন হয়ে যায় শুধু মাত্র প্রিয় রঙটা দেখে। আর যদি কখনও বিপক্ষ সমর্থকদের গাড়ি চলে আসে পাশে তাহলে যে কি কি কথা হয় তা সেন্সর বোর্ডের অনুমতি ছাড়া লেখা যাবে না। যদিও মাঠের বাইরে সুস্থ প্রতিদ্বন্দ্বিতা বেশিরভাগ সময়ই উপভোগ করা যায়। স্টেডিয়ামের বাইরে টিকিটের লাইন, কেউ জার্সি কিনছে, কেউ প্রিয় রঙ গালে লাগাচ্ছে, কেউ নিজের দলের প্রতীক বানিয়ে আনছে মাঠে, কেউ ঢাক-ড্রামস-বাঁশি নিয়ে উচ্চস্বরে বাজাচ্ছে, কেউ আবার মাছের আগে টিফো উন্মোচনে ব্যস্ত। আট থেকে আশি, ছেলে মেয়ে সবাইকেই দেখা যায় শুধু আবেগ নিয়ে হাজারো ব্যস্ততার মধ্যেও, অনেক সমস্যার মধ্যেও উপস্থিত হয় বাঙালির সেই পুরনো লড়াইয়ের সাক্ষী থাকতে। কেউ আবার সদ্য স্বজন হারানোর যন্ত্রনা নিয়েও শুধু মাত্র প্রিয় দলের ভালোবাসার টানে চলে আসে মাঠে।
ম্যাচ শেষে যখন কেউ প্রিয় দলের জয়ের আনন্দে পাগলের মত নাচতে থাকে। তখন কেউ আবার জড়িয়ে সান্ত্বনা দিতে থাকে তার পাশে বসা অচেনা কোনো এক সমর্থক ভাই/বোনকে, “আরে কাঁদিস না। আজ আমাদের দিন ছিল না রে! পরের দিন দেখিস ওদেরকে 5টা গোল দিয়ে হারাবো”। যারা জিতে যায় তারা যেমন গাইতে গাইতে, নাচতে নাচতে, চিৎকার করতে করতে বাড়ি ফেরে। ঠিক তার উল্টোটা হয় দল হেরে গেলে, একদম নিশ্চুপ ভাবে হয়তো বা অন্য রাস্তা দিয়ে লুকিয়ে ফিরতে হয় বাড়ি কারোর। তবে যাই হোক না কেন খেলার ফলাফল, কেউ জিতবে কেউ হারবে, কেউ হাসবে কেউ কাঁদবে, কেউ কাউকে নিয়ে মজা করবে; কিন্ত তার দলকে নিয়ে একটা বাজে মন্তব্যও কিন্তু কেউ বরদাস্ত করবে না দলের পারফরম্যান্স যাই হোক না কেন। হয় হয়তো 2দিন! তারপর কিন্তু আবার সেই সাধাসিধে ঘষামাজা জীবন। সেই ট্রেন, সেলুনের উঠতি কোচেরাও নেই, আবার অফিসের হালকা টিপ্পনীও নেই, সোশ্যাল মিডিয়ার রাজা বন্ধু আবার তার পুরনো কার্যকলাপে ফেরত এসেছে। বন্ধুদের আড্ডাটাও আবার ডার্বি থেকে সরে গিয়ে অন্য কিছুতে মনোনিবেশ করেছে। প্রেমিকার কোথায় রাগ করে ছেলেটাও আবার তারই হাত ধরে কোনো পার্কে বা মলে বিন্দাস ঘুরছে। দাদা-ভাইয়ের সেই উত্তর-দক্ষিণ কোরিয়ার লড়াইয়েও কিন্তু শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় গেছে। পরিবারের খাবার টেবিলে আলোচনাটা ইলিশ-চিংড়ির মধ্যে কার বেশি স্বাদ সেটা থেকে সরে গিয়ে আবার সেই সংসারের চিন্তায় চলে গেছে। আর মনে মনে সবাই অপেক্ষা করবে কবে আবার সেই ডার্বি আসবে আর গোটা বাংলা আবার লাল-হলুদ সবুজ-মেরুন, বাঙাল ঘটি, ইলিশ চিংড়ি নিয়ে কথার লড়াইয়ে মাতবে। ফিরবে না শুধু দাদুর সেই গোলের আনন্দে সিগারেট খাওয়াটা আর পিসেমশায়ের ভুল করে অন্য গ্যালারিতে ঢুকে অল্পের জন্য মার খাওয়ার হাত থেকে রক্ষা পাওয়াটা। হয়ত তাঁরা তারার দেশে বসেই আবার সেই ডার্বির লড়াই উপভোগ করবে আর বলবে, “আমার টিমের সাথে তোমার টিম কোনোদিন পারে নাকি!” যতদিন বাঙালী জাতি থাকবে ততদিন ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান ডার্বির লড়াই সব বাঙালির হৃদয়ে বেঁচে থাকবে মৃত্যুর পরেও।