ফরিদপুর বাংলাদেশের একটি অতি প্রাচীন জেলা। প্রাচীনকালে বর্তমান ফরিদপুর ছিল ভাঙ্গ-রাজত্বের অন্তর্ভূক্ত। পদ্মার দক্ষিণ ব-দ্বীপ নামে ভাগীরথীর মধ্যবর্তী এবং ব্রহ্মপুত্রের পুরনো অংশ ও দক্ষিনাংশ নিয়ে উহা গঠিত ছিল। দ্বীপটি গঠিত হয়েছিলো গঙ্গার প্রবাহের ভিতরে। দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের (৩৮০-৪১২ খ্রিস্টাব্দ) আমলে মহাকবি কালিদাস রচিত ‘রঘুবংশ’ কাব্যে ফরিদপুর অঞ্চল সম্পর্কে বর্ণনা রয়েছে যে ‘অধিবাসীরা নৌকা ও নদী বিষয়ক জ্ঞানে অভিজ্ঞ’। অনেক আউলিয়া-দরবেশ, রাজনীতিক, পূণ্যাত্মার আবাসভূমি হিসেবে এ অঞ্চল অত্যন্ত সুপ্রসিদ্ধ। এ জেলার পূর্বনাম ছিল ‘‘ফতেহাবাদ’’। প্রচলিত বিশ্বাস, বহু বছর আগে প্রখ্যাত সাধক এবং দরবেশ খাজা মাইনউদ্দিন চিশতী (রহঃ) এর শিষ্য সুফি সাধক শাহ ফরিদ এর নামানুসারে এ জেলার নামকরণ করা হয় ফরিদপুর। ফরিদপুর জেলার প্রতিষ্ঠা সন ১৭৮৬ হলেও তখন এটির নাম ছিল জালালপুর এবং প্রধান কার্যালয় ছিল ঢাকা। ১৮০৭ খ্রিঃ ঢাকা জালালপুর হতে বিভক্ত হয়ে এটি ফরিদপুর জেলা নামে অভিহিত হয় এবং হেড কোয়ার্টার স্থাপন করা হয় ফরিদপুর শহরে। ফরিদপুর জেলার উল্লেখযোগ্য নদ-নদীর মধ্যে রয়েছে পদ্মা, মধুমতি, কুমার, ভুবনেশ্বর, আড়িয়াল খাঁ, বারাশিয়া।
ফরিদপুরের কোটালীপাড়া থেকে অনেকগুলি বৌদ্ধমুর্তি পাওয়া গেছে। বাকুঁড়ার নিকটবর্তী সুমুনিয়া নামক স্থানে পর্বত গোত্রে খোদিত লিপিতে পুস্করণের অধিপতি সিংহবর্মা ও তার পুত্র চন্দ্রবর্মার ’কোট’ নামক স্থানে একটি দুর্গ ছিল। ষষ্ঠ শতকের শিলালিপিতে এর উল্লেখ আছে। এই কোট থেকে কোটালীপাড়া হয়েছে বলে অনেকের ধারণা। সুমুদ্রগুপ্ত কর্তৃক চন্দ্রবর্মা পরাজিত হলে আদি ফরিদপুর গুপ্ত সম্রাজ্যের অন্তর্ভূক্ত হয়। গুপ্ত সাম্রাজ্যের শেষ উল্লেখযোগ্য রাজা স্কন্ধগুপ্তের একটি স্বর্ণমুদ্রা ও চারটি তাম্রলিপি পাওয়া যায়। এই তাম্রলিপিতে ধর্মাদিত্য, গোপচন্দ্র, ও সমাচার দেব নামের তিনজন রাজার নাম পাওয়া যায়। তাম্রশাসনে উল্লেখিত রাজাগণ গৌড়দেশের স্বাধীন রাজা ছিলেন। প্রাচীন ফরিদপুর এই সময়ে এই রাজাদের শাসনাধীন ছিল। বঙ্গদেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আবিস্কৃত স্কন্ধগুপ্তের মুদ্রার অনুরুপ কয়েকটি স্বণমুদ্রা কোটালীপাড়ায় পাওয়া যায়। মুদ্রা তত্ত্ববিদদের মতে এই মুদ্রাগুলি ব্ঙ্গদেশে প্রচলিত খ্রিস্টীয় সপ্ত-শতাব্দীর মুদ্রা। ঐতিহাসিকগণ অনুমান করেন এগুলি শশাঙ্কের মৃত্যুর পর গৌড়রাজ মাধবগুপ্ত চালু করেন । পাল-রাজত্বে ফরিদপুরের সমতট অংশটি যথেষ্ট গুরুত্ব লাভ করে। ৯০০ খ্রি. থেকে ১০৫০খ্রি. পযন্ত বিক্রমপুর বসে ফরিদপুর শাসন করেছে পাল বংশ । মামলুক শাসনকর্তাদের মধ্যে সুলতান মুগিসুদ্দীন তুগরীল (১২৬৮-৮১) সর্বশ্রেষ্ঠ ছিলেন। তিনি পদ্মা নদীর দুই তীরবর্তী ফরিদপুর ও ঢাকা জেলার বিস্তত অঞ্চলের ওপর তাঁর কৃতিত্ব স্থাপন করেন। ইলিয়াসশাহী বংশের অভুত্থানের পূর্বে মামলুক বংশীয় শামসুদ্দিন ফিরোজ শাহের (১৩০০-১৩১২) কয়েকটি মুদ্রা সুন্দরবন অঞ্চলে পাওয়া গেছে। এ সময়ে ফরিদপুরের দক্ষিণাংশে তৎকালীন সুন্দর বনাঞ্চলের অর্ন্তভূক্ত ছিল। ইলিয়াসশাহী বংশের পত্তনের পর পঞ্চদশ শতাব্দীর প্রারম্ভে রাজা গণেশ বাংলার সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন। তাঁর রাজত্বের সময় ফরিদপুরের ফতেহাবাদ সমেত দক্ষিণবঙ্গের কতকাংশ তাঁর রাজ্যের অর্ন্তভূক্ত ছিল।
পদ্মাপারের ছায়াঢাকা-পাখিডাকা অম্বিকাপুর গ্রামেই মায়া মমতায় জড়াজড়ি করে ভরে থাকা নকশী কাঁথার মাঠের রচয়িতা পল্লী কবি জসীম উদদীনের স্মৃতিবিজরিত বাড়ি। এই গ্রামে যাওয়ার ‘নিমন্ত্রণ’ জানিয়ে কবি নিজেই লিখেছিলেন, ‘তুমি যাবে ভাই—যাবে মোর সাথে, আমাদের ছোট গাঁয়।’ শচিন কত্তার কন্ঠে ‘নিশিতে যাইও ফুলবনে – রে ভোমরা, নিশিতে যাইও ফুলবনে’ বিখ্যাত এই গানটি পল্লী কবির রচনা। বাড়ীতে ০৪টি পুরনো টিনের চার চালা ঘর রয়েছে। কবির ব্যবহ্নত বিভিন্ন জিনিসপত্রাদি ঘরে সংরক্ষিত রয়েছে। কবির বিভিন্ন লেখা বাড়ীর চত্ত্বরে প্রদর্শন করা আছে। কবি ১৪-০৩-১৯৭৬ খ্রিঃ তারিখ হতে ডালিম গাছের তলে চিরতরে শায়িত রয়েছেন। কবির বাড়ি থেকে কিছু দূর এগিয়ে চোখে পড়বে ‘সোজন বাদিয়ার ঘাট’। আজ থেকে প্রায় ৭০০ শত বছর পূর্বে আলা-উদ্দিন হুসাইন শাহ ছিলেন বাদশা। তখন সাতৈর গ্রামে বহু আওলিয়ার বসবাস ছিলেন। ঐতিহাসিক এই মসজিদটি সেই সময়ে নির্মিত হয়। মথুরাপুর দেউলটি ফরিদপুর জেলার মধুখালী উপজেলার গাজনা ইউনিয়নে অবস্থিত। কারু কাজ খচিত প্রায় ৯০ ফুট উচ্চতা বিশিষ্ট দেউলটির পশ্চিমে রয়েছে চন্দনা নদী। রয়েছে মাটির ফলকের তৈরী অসংখ্য ছোট ছোট মুর্তি-যা দশীনার্থীদের কাছে আকর্ষনীয়। ভাঙ্গা উপজেলাধীন আজিমনগর ইউনিয়নের পাতরাইল গ্রামে অবিস্থিত প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী আউলিয়া খান জামে মসজিদটি ১৩৯৩ হতে ১৪১০ খ্রিঃ মধ্যে গিয়াসউদ্দিন আজম শাহ নির্মাণ করেন বলে ধারণা করা হয়। ঐতিহাসিক মসজিদের দক্ষিণ পাশ্বেই চির নিন্দ্রায় শাহিত আছেন মহান আউলিয়া মজলিস আউলিয়া খান। জনশ্রুতি আছে যে, এলাকায় প্রজাদের পানীয় জলের সমস্যা নিরসনকল্পে ও ইবাদতের জন্য মসজিদের পার্শ্বেই ৩২.১৫ একর জমির উপর একটি দীঘি খনন করেন।ফরিদপুরের জমিদার শাসনের ইতিহাস বেশ সমদ্ধ, এখানকার খ্যাতনামা জমিদার বংশ গুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল কানাইপুরের ‘শিকদার বংশ’। বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদৌলার শাসনামলেরও প্রায় শতবছর পূর্বে এই জমিদার শিকদার বাড়ী প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বলে স্থানীয় লোকজন থেকে জানা যায়। ফরিদপুর শহর থেকে প্রায় ৬ কিঃমিঃ পরে দক্ষিণ পশ্চিমে এবং কানাইপুর বাজার থেকে উত্তরে ফরিদপুর-যশোর মহাসড়কের কাছে কানাইপুর গ্রামে শিকদার বাড়ি অবস্থিত।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ বৃহত্তর ফরিদপুরের বর্তমান গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গীপাড়ায় এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। বাংলাদেশের রুপকার, স্বাধীনতা আন্দোলনের মহান নেতা ও স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ১৯৭১ সালে ৯ মাস রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাঙালী জাতিকে বিশ্বের মানচিত্রে স্বাধীন জাতি হিসাবে স্বীকৃতি লাভ করিয়ে দিয়েছে। তাঁর রাজনীতিক ইতিহাস এত বিশাল তা লিখে শেষ করা যাবে না। ভারতীয় বাংলা চলচিত্রের জীবন্ত কিংবদন্তী মৃনাল সেন। ১৯২৩ সালে ফরিদপুর শহরের ঝিলটুলী তার জন্ম। ভুবন সোম, ক্যালকাটা, পদাতিক যা তাকে একজন আন্তর্জাতিক পরিচালকের খ্যাতি এনে দিয়েছিলো। তিনি আন্তর্জাতিক চলচিত্র পুরস্কার পেয়েছিলেন বেশ কয়েকবার। চারুচন্দ্র চক্রবর্তী জরাসন্ধ ছন্দনামে পরিচিত লাভ করেছেন লেখক হিসাবে। ফরিদপুর জেলার নগরকান্দা উপজেলার ব্রাহ্মনকান্দা গ্রামে ১৯০২ সালে জন্ম। বিখ্যাত উপন্যাস ‘লৌহ কপাট’ লিখে বাংলা কথা সাহিত্যে সুবিশাল পরিচিতি নিয়ে বিখ্যাতও হন। ‘তামসী’, ‘পাড়ি’, ‘সীমারেখা’, ‘ন্যায়দণ্ড’, ‘পরশমনি’, ‘উত্তরাধিকার’, ‘তৃতীয় নয়ন’, ‘রঙ চঙ’, ‘পলাশ ডাঙার ঝড়’, ‘আবরণ’, ‘একুশ বছর’ ‘ছায়াতীর’, ‘ছবি’, ‘সপ্তষি’,‘মল্লিকা’ ‘অশ্রু বন্যা’ ‘রবিবার’, ‘পরিসর’, ‘যমরাজের বিপদ’ প্রভৃতি ওনার উল্লেখযোগ্য রচনা। বিখ্যাত দোতারা বাদক, গীতিকার ও সুরকার কানাইলাল শীলের জন্ম ফরিদপুর জেলার নগরকান্দা উপজেলায়। তিনি উপমহাদেশের বিখ্যাত দোতারা বাদক হিসাবে খ্যাতি অর্জন করেন। ফকির আলমগীর ১৯৫০ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ভাষা আন্দোলনের স্মরণীয় দিনটিতে ফরিদপুর জেলার ভাঙ্গা থানার কালামৃধা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ক্রান্তি শিল্পী গোষ্ঠী ও গণশিল্পী গোষ্ঠীর সদস্য হিসাবে ষাটের দশকে বিভিন্ন আন্দোলন সংগ্রামে এবং ৬৯’ এর গণ অভ্যুত্থানে এক বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। ১৯৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধে শিল্পী ফকির আলমগীর একজন শব্দ সৈনিক হিসাবে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে যোগ দেন।
লোক সংস্কৃতি বাংলা সাহিত্যের একটি বিশাল ভান্ডার। ফরিদপুর একটি সুপ্রাচীন জনপদ। ফরিদপুরের নিজস্ব সংস্কৃতিও এক্ষেত্রে উল্লেখ করার মত। লোকগীতি, লোকসংগীতি, পল্লীগীতি, বাউল গানের বিখ্যাত মরমী লোক কবি ও চারণ কবিদের লালন ক্ষেত্র এ ফরিদপুরে। এ জেলার অনুকুল আবহাওয়া ও পরিবেশ এদের লালন করেছে আর যুগে যুগে উপাদান ও উপকরণ সরবরাহ করে মরমী ও লোক কবিদের সাধনা ক্ষেত্রে অনুপ্রেরনা যুগিয়েছে। পল্লী কবি জসীমউদ্দিন, তাইজদ্দিন ফকির, দেওয়ান মোহন, দরবেশ কেতাবদি শাহ, ফকির তীনু শাহ, আজিম শাহ, হাজেরা বিবি, বয়াতি আসাদুজ্জামান, আবদুর রহমান চিশতী, আঃ জালাল বয়াতি, ফকির আব্দুল মজিদ প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য। ফরিদপুরের ঐতিহ্যবাহী খাবারের মদ্ধ্যে বিখ্যাত খেজুরের গুড়, বিভিন্ন ধরনের পিঠা ও পদ্মার ইলিশ।