বেঙ্গালুরু এফসি। নামটা শুনলেই ইস্টবেঙ্গল সমর্থকদের মধ্যে যেন একটা আলাদা জোশ আসে। কলকাতা ডার্বির পরে যদি আর কোনও ম্যাচ ঘিরে স্মরণকালে ভারতীয় ফুটবল সবচেয়ে বেশী আলোড়িত হয়ে থাকে, তাহলে সেটা ইস্টবেঙ্গল বনাম বেঙ্গালুরু এফসি। যুবভারতী হোক কি কান্তিরাভা, বারাসাত হোক বা কলিঙ্গ স্টেডিয়াম, এই ম্যাচ ঘিরে সবসময়ই দুদলের সমর্থকের মধ্যে উত্তেজনার পারদ উঠেছে তুঙ্গে।
এখনও পর্যন্ত আইলীগ, সুপার কাপ ও ডুরান্ড মিলিয়ে বেঙ্গালুরু এফসি এবং ইস্টবেঙ্গল পরস্পরের মুখোমুখি হয়েছে ১০ বার। ইস্টবেঙ্গল জিতেছে ৬টি, বেঙ্গালুরুর জয় ৪টি ম্যাচে। ২০১৯-এ শেষবারের মতো দুই দলের সাক্ষাত হয় ডুরান্ডে, যেখানে ইস্টবেঙ্গল ২-১ গোলে জয়ী হয়। কিন্তু সে তো ছিল দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানো, কারণ বেঙ্গালুরু এফসি ডুরান্ড খেলতে এসেছিলো তাদের অনুর্ধ্ব-২৩ দল নিয়ে।
তবে তারও আগে ইস্টবেঙ্গল সমর্থকদের মনে দগদগে ঘা হয়ে রয়েছে ২০১৮-র সুপার কাপ। আনসুমানা ক্রোমার গোলে এগিয়ে গিয়েও হারতে হয়েছিলো ১-৪ গোলে। জোড়া গোল করেছিলেন সুনীল ছেত্রী। গোদের উপর বিষফোঁড়ার মতো মাথা গরম করে হাত চালিয়ে লালকার্ড দেখেছিলেন সামাদ আলি মল্লিক।
এবারে নতুন মঞ্চ, পুরোনো শত্রুতা। বলা ভালো, ওল্ড ওয়াইন ইন আ নিউ বটল।
এসসি ইস্টবেঙ্গল:
আইএসএলের শুরুটা ভালো না হলেও গত চার ম্যাচ অপরাজিত রবি ফাউলারের দল। তারমধ্যে রয়েছে ছয়দিন আগেই ওড়িশা এফসির বিরুদ্ধে ৩-১ গোলে জয় এবং তার তিনদিনের মাথায় এফসি গোয়ার বিরুদ্ধে দ্বিতীয়ার্ধের চল্লিশ মিনিট দশজনে খেলেও এক পয়েন্ট। আপফ্রন্টে মাঘোমা, ব্রাইটদের ফর্ম আত্মবিশ্বাসের তুঙ্গে রাখবে এসসি ইস্টবেঙ্গলকে। এফসি গোয়ার বিরুদ্ধে বিশ্বমানের গোলের পর এমনিতেই ব্রাইট এনোবাখারে এখন ভারতীয় ফুটবলমহলের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। ইস্টবেঙ্গল জনতার আদরের “উজ্জ্বলদা” যদি তাঁর গত দুম্যাচের বিধ্বংসী ফর্ম নিয়েই বেঙ্গালুরু ম্যাচে নামেন, এবং তাঁকে যোগ্য সঙ্গত দেন স্টেইনমান, মাঘোমা, হরমনপ্রীতরা, তাহলে ইস্টবেঙ্গল সমর্থকরা এই ম্যাচ থেকে তিন পয়েন্টের আশায় বুক বাঁধতেই পারেন।
আত্মবিশ্বাসী হলেও মাঠ ও মাঠের বাইরের সমস্যার ঘেরাটোপে খুব একটা স্বস্তিতেও থাকতে পারছে না লাল হলুদ শিবির। দুটো হলুদ কার্ড দেখে এই ম্যাচে বেঞ্চে নেই হেডকোচ তথা লিভারপুল লেজেন্ড রবি ফাউলার। ওনার অবর্তমানে দলের হাল ধরবেন সহকারী কোচ টনি গ্রান্ট। রিজার্ভ বেঞ্চে ফাউলারের অনুপস্থিতিতে টিমের স্ট্র্যাটেজি বা ফর্মেশনে কোনও পরিবর্তনের সম্ভাবনা না থাকলেও টনি গ্রান্টের গেম রিডিংয়ের দক্ষতার উপরে কিন্তু দ্বিতীয়ার্ধে ম্যাচের গতিপ্রকৃতি নির্ভর করতে পারে।
মাঠের ভিতরেও এসসি ইস্টবেঙ্গলের জন্য খারাপ খবর। গত ম্যাচে লালকার্ড দেখে এই ম্যাচে নেই ডিফেন্সের প্রধান স্তম্ভ ড্যানি ফক্স। ফলে স্কট নেভিল এবং রাজু গায়কোয়াড়কে নিয়েই সাজানো হতে পারে ইস্টবেঙ্গলের ডিপ ডিফেন্স। শেষবার যখন ড্যানি ফক্স ইস্টবেঙ্গলের জার্সি গায়ে মাঠে নামেননি, সেই হায়দ্রাবাদ এফসি ম্যাচে ১২ মিনিটের একটা স্পেলে তিন গোল হজম করে তারা। ইস্টবেঙ্গলের হজম করা ১৫টি গোলের মধ্যে ১২টিই কিন্তু এসেছে দ্বিতীয়ার্ধে। তাই অসতর্ক মুহূর্তের একটা ছোট্ট ভুলে তিন পয়েন্ট মাঠে ফেলে আসতে হলে তা ইস্টবেঙ্গল টিমের ফিটনেস এবং মনোসংযোগের উপর বড়সড় প্রশ্নচিহ্ন তুলে দেবে।
যদি না কোচ শেষমুহূর্তে কোনও চমক না দেন, তাহলে সাইড ব্যাকে শুরু করতে পারেন নারায়ণ দাস এবং বিকাশ জাইরু। সাথে থাকতে পারেন গত ম্যাচে ভালো খেলা অঙ্কিত মুখার্জীও। প্রথম একাদশে ফেরার সম্ভাবনা মহঃ রফিকেরও। তবে মিলন সিংহ না শেহনাজ, এই নিয়ে দ্বিধাবিভক্ত লালহলুদ সমর্থকরা। শেহনাজ ম্যাচফিট না হলে মিলনেরই শুরু করার সম্ভাবনা। ফক্সের অনুপস্থিতিতে অ্যারন আমাদি হলোওয়েকে কিভাবে ব্যবহার করেন ফাউলার, টনি গ্রান্টরা, সেটাও দেখার।
তবে শিবিরের খবর, প্র্যাকটিসে হালকা গা ঘামালেও এখনও পুরোপুরি চোটমুক্ত নন অ্যান্থনি পিলকিংটন। তাই মরশুমে প্রথমবারের জন্য ব্রাইট ও মাঘোমার একসাথে প্রথম একাদশে শুরু করার প্রবল সম্ভাবনা। তবে প্রথম একাদশে ফেরার ক্ষীণ সম্ভাবনা রয়েছে সুরচন্দ্র সিংয়েরও। সেক্ষেত্রে জাইরু বা নারায়ণ দাসের মধ্যে কোনও একজনের ঠাঁই হবে রিজার্ভ বেঞ্চে।
বেঙ্গালুরু এফসি:
২০১৩ সালে তৈরী হওয়ার পর অভিষেকেই আইলীগ জিতে চমক দেয় JSW-র মালিকাধীন এই দলটি। তবে ক্লাবের ইতিহাসে এই প্রথমবার পরপর তিন ম্যাচে হেরেছে প্রাক্তন কোচ কার্লস কুয়াদ্রাতের দল। একথা অনস্বীকার্য, মুম্বাই সিটি এফসির বিরুদ্ধে ১-৩ গোলে পর্যদুস্ত হওয়ার পর এইমুহূর্তে ভারতের সিলিকন ভ্যালির এই দলটা বেশ ছন্নছাড়া অবস্থাতেই রয়েছে। কার্লস কুয়াদ্রাতের অপসারণের পর অন্তর্বর্তী কোচ নৌশাদ মুসার তত্ত্বাবধানে এই লজ্জার ইতিহাসের পরিসমাপ্তি ঘটাতে বদ্ধপরিকর সুনীল ছেত্রীরা।
তবে প্রতিপক্ষকে হালকা ভাবে নিলে নিজের পায়েই কুড়ুল মারবে রবি ফাউলারের শিষ্যরা। ইতিমধ্যেই সুনীল ছেত্রীর নামের পাশে রয়েছে চার গোল। পিছিয়ে নেই ক্লিটন সিলভাও। তাঁরও এখনও অবদি তিন গোল করা হয়ে গিয়েছে। তবে কার্ড সমস্যায় কাল নেই এখনও ইস্টবেঙ্গলদের সমর্থকদের নয়নের মণি হরমনজ্যোত সিং খাবরা।
তবে খাবরা না থাকলেও চোট থেকে সেরে উঠে প্রথম একাদশে ফিরতে পারেন এরিক পার্তালু। ডিফেন্সে হুয়ানানের সাথে জুটি বাঁধতে পারেন মোহনবাগানের প্রাক্তন খেলোয়াড় এবং ইস্টবেঙ্গল সমর্থকদের সঙ্গে সোশ্যাল মিডিয়াতে আদায়-কাঁচকলায় সম্পর্ক রাখা ফ্রান গঞ্জালেজ। তবে একথা কট্টর বেঙ্গালুরু সমর্থকরাও মানবেন যে, এখনও পর্যন্ত ১২ গোল হজম করা বেঙ্গালুরু ডিফেন্স একেবারেই তাঁদের ভরসা জোগাতে পারছে না।
এখনও অবদি খেলা ৯টি ম্যাচেই গ্লাভস হাতে বেঙ্গালুরু এফসির দূর্গ গুরপ্রীত সিং সান্ধু সামলালেও এই ম্যাচে মাঠে নামতে পারেন গত বছর লোনে ইস্টবেঙ্গলে খেলে যাওয়া লালথুমাওইয়া রালতে। এছাড়াও মাঝমাঠে খেলা দিমাস দেলগাদোর ফর্মের উপরেও অনেকটা নির্ভর করছে এসসি ইস্টবেঙ্গলের বিরুদ্ধে বেঙ্গালুরু এফসির ভাগ্য। বেঙ্গালুরু এফসিকে চিন্তায় রেখেছে নিজেদের নামের প্রতি একেবারেই সুবিচার করতে না পারা জামাইকান ফরওয়ার্ড দেশর্ন ব্রাউন এবং নরওয়ে থেকে আসা আরেক স্ট্রাইকার ক্রিশ্চিয়ান অপসেথ। দুজনের কেউই এখনও গোলের মুখ খুলতে পারেননি। গোলে ফেরার জন্য ফক্সবিহীন ইস্টবেঙ্গলের ডিফেন্সকে তাঁরা যে টার্গেট করবেন, তা বলাই বাহুল্য।
সব মিলিয়ে খাতায় কলমে বেঙ্গালুরু শক্তিশালী দল হলেও একটুও পিছিয়ে নেই এসসি ইস্টবেঙ্গলও। এমনিতেই ময়দানে কথিত আছে যে, ইস্টবেঙ্গল কারোর ধারদেনা বাকি রাখে না, সুদে আসলে মিটিয়ে দেয়। সুপার কাপের হারের সেই ক্ষতে প্রলেপের লক্ষ্যেই আজ গোয়ার ফতোদরা স্টেডিয়ামে নামতে চলেছে লাল-হলুদ ব্রিগেড। আইএসএল ২০২০-২১-এর প্রথম লেগে নিজেদের শেষ ম্যাচে রিজার্ভ বেঞ্চে না থাকা রবি ফাউলারকে তাঁর ছাত্ররা তিন পয়েন্ট এনে দিতে পারেন কিনা, এখন তারই অপেক্ষা।