আজকের মুন্সিগঞ্জ জেলা এক সময় বিক্রমপুর নামে ভারতবর্ষে পরিচিত ছিল। প্রাচীন সংস্কৃত সাহিত্যে বিক্রমপুরের নাম পাওয়া যায় না। তার বিশেষ কারণ এই যে, বিক্রমপুর প্রাচীন নাম নয়। পূর্বে বিক্রমপুর সমতট নামে প্রখ্যাত ছিল। প্রাচীন বাংলার গৌড়পুন্ড্র-বরেন্দ্রীথ-রাঢ়া-সুহ্ম-তাম্রলিপ্তি-সমতট বঙ্গ-বঙ্গাল-হরিকেশ প্রভিৃতি জনপদ”। এর মধ্যে ‘সমতট’ জনপদের মধ্যেই বিক্রমপুরের অস্তিত্ব ছিল। চৈনিক পরিব্রাজক হিউয়েন সাঙ-এর ভ্রমন বৃত্তান্তে এ কথার সমর্থন পাওয়া যায়। সেখানে তিনি বিক্রমপুরকে প্রাচীন সমতটের অন্তর্ভুক্ত বলে উল্লেখ করেন। সেন রাজাগণের সময় এই সমতট বিক্রমপুর নামে অভিহিত হয়। জনশ্রতি আছে যে, উজ্জায়নীর বিখ্যাত রাজা বিক্রমাদিত্য ভাই ভতৃহরি র সাথে মনোমালিন্য হওয়ায় দেশ ভ্রমণে বের হয়ে সাগর তীরবর্তী সমতট প্রদেশের স্থান বিশেষের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে সেখানে অবস্থান করার সিদ্ধান্ত নেন। তারই নামানুসারে এ অঞ্চলের নাম হয়েছে বিক্রমপুর। কিন্তু এই মত গ্রহণীয় নয়। কারণ উজ্জয়িনীর রাজা বিক্রমাদিত্যের এ অঞ্চলে আসার কোনো ঐতিহাসিক প্রমাণ পাওয়া যায় না। বৌদ্ধগ্রন্থ ‘বিক্রমনীপুর’ থেকেও বিক্রমপুর নামের উৎপত্তি বলে ধারণা করা হয়। “বিক্রমপুরী-বিহার” থেকে বিক্রমপুরের নাম হয়েছে বলে আর একটি ধারনা আছে। বিভিন্ন তথ্য প্রমাণ যোগে-মোটামুটিভাবে নবম শতাব্দী থেকেই শ্রীবিক্রমপুর নামের উৎপত্তি বলে ধারণা করা হয়। এরপর থেকেই শ্রীচন্দ্রদেবের তাম্রশাসন, শ্যামলবর্মার তাম্রশাসন, সেনরাজাদের তাম্রশাসন প্রভৃতির মাধ্যমে বিক্রমপুরের অস্তিত ইতিহাস লিপিবদ্ধ হতে থাকে। দশম থেকে দ্বাদশ শতাব্দী পর্যন্ত বঙ্গের রাজধানী বিক্রমপুরে অবস্থিত ছিল। ঐ সময় বঙ্গেশ্বরগণ বিক্রমপুর থেকেই রাজ্যশাসন করতেন।
বিক্রমপুর শুধু ইতিহাসের নয়, একটি জাতির প্রাণকেন্দ্র। বাংলাদেশের প্রাণ স্পন্দন। নবম শতাব্দী থেকে পঞ্চদশ শতাব্দী পর্যন্ত বঙ্গে বৌদ্ধ, সেন, পাঠানদের শাসনকালকে বাঙালী জাতির আত্মবিকাশের শ্রেষ্ঠ সময় হিসেবে ধরা হয়। ভারত উপমহাদেশে জাতিগত রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব ও ক্ষমতা দখলের প্রবণতা লক্ষ্য করা গেলেও শিক্ষা সংস্কৃতি বিকাশে তারা ছিল উদার। আর বিক্রমাদিত্যের বিক্রমপুরে বৌদ্ধ, সেন, মুসলিম, পাঠানদের রাজত্বকালে গড়ে উঠেছিল শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতির শ্রেষ্ঠ ঐক্য ধারা। সেই সংস্কৃতির ঐক্যের ধারাই প্রাচীন বঙ্গের ইতিহাস। যখন নবদ্বীপ, গৌড়, সোনারগাঁ, ঢাকা সপ্তগ্রাম জনসাধারণের কাছে পরিচিত হয়ে উঠেনি তারও পূর্বে বিক্রমপুরস্থ বজ্রযোগিনী গ্রামে বৌদ্ধ বাঙালী পন্ডিত শ্রী জ্ঞান অতীশ দীপঙ্করের জন্ম হয়। এই দুই বাঙালী মনীষী আধুনিক বিশ্বে মানবতার কিংবদন্তী। পাল রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা গোপাল পাল থেকে শুরু করে একাদশ শতাব্দী পর্যন্ত পালবংশ বিক্রমপুর শাসন করে। বিক্রমপুরের ইতিহাস মূলত : সেন রাজাদের সময়ই পরিপূর্ণ হয়ে উঠে। আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন, ধারাবাহিক শিল্প সংস্কৃতির উত্তরণ, কৌলিণ্য প্রথা এবং কৃষিভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থা ও বিচার কাঠামো সেন রাজাদের রাষ্ট্রীয় চিন্তা দর্শন। সেনবংশীয় রাজাদের সময় বিক্রমপুরের রামপাল বাংলার রাজধানী হয়ে উঠে এবং দ্বিতীয় বল্লাল সেনের সময় মুসলিম দরবেশ বাবা আদম রামপালের নিকটবর্তী আবদুল্লাহপুর গ্রামে কানাইচঙ্গ নামক স্থানের মসজিদে আশ্রয় নেন। বল্লাল সেন মারা গেলে ১১৬৮ সালে লক্ষণ সেন পৈতৃক রাজ্য লাভ করেন। পরে লক্ষণ সেন রাজধানী বিক্রমপুর থেকে গৌঢ় বা লক্ষণাবর্তীতে স্থানন্তরিত করেন। তার রাজত্বকালে গৌড়ে প্রধানমন্ত্রী এবং প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিযুক্ত হন বাঙালী পশুপতি ও বৈদিক ব্রাহ্মণ হলায়ুধ। যাদের জন্মস্থান বিক্রমাপুর। গৌড়ে লহ্মণ সেনের রাজত্বকালে পুত্র বিশ্বরূপ সেন বিক্রমপুর পরগনার শাসনভার গ্রহণ করেন। জাতিগত ঐক্যের নবজাগরণে পঞ্চদশ শতকের মাঝামাঝি বাংলার শাসনকর্তা সৈয়দ হুসেন শাহের আমলে মানবতাবাদী রাষ্ট্রচিন্তার নায়ক শ্রী চৈতন্য মহাপ্রভু নবদ্বীপ ছেড়ে বিক্রমপুরে অবস্থান নেয়। শিক্ষা ও সংস্কৃতির উত্তরাধিকার হিসেবে বিক্রমপুরবাসী আপোষহীন। তাই মোগল আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ষোড়শ শতাব্দীর শেষভাগে আড়ফুল বাড়িয়া গ্রামের দু’সহোদর বাঙালী বিপ্লবী চাঁদ রায় ও কেদার রায় বিক্রমপুরের অর্ন্তগত পদ্মা তীরবর্তী শ্রীপুর দুর্গ থেকে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। মানসিংহ ক্ষিপ্ত হয়ে তৃতীয়বার বিক্রমপুরে এসে বার ভূঁইয়াদের মতভেদের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে পদ্মার তটস্থিত বিক্রমপুরের রাজধানী কেদার রায়ের প্রিতম শ্রীপুর দুর্গ জয় করেন।
বিক্রমপুরের সীমানা নির্ধারণ বেশ দুরূহ ব্যাপার। বিভিন্ন সময়ে এর সীমা পরিসীমা বারবার গতিপথ পরিবর্তন করছে। রাজনৈতিক উত্থান পতনের কারণে এর ভৌগলিক অবস্থানের অদল-বদল ঘটে। নদীর গতিপথ পরিবর্তনের মাধ্যমেও বিক্রমপুরের রূপ-রপান্তর অব্যাহত থাকে। বিশেষত হেয়াঁলি পদ্দার ভাঙাগড়ায় এই এলাকা বিভিন্নভাবে ভূপ্রকৃতি পরিবর্তন করে। চন্দ্র-বর্ম-সেন প্রভৃতি হিন্দু ও বৌদ্ধ নৃগতিগণের শাষণকালে পাঠান ও মোগল প্রভাবকালে চাঁদরায়, কেদাররায় প্রভৃতি বার ভূইয়ার প্রাধান্য সময়েও বিক্রমপুরের সীমা পরিবর্তিত ও পরিবর্ধিত হয়েছে, তারপর ইংরেজ-রাজত্ব-কালে বিক্রমপুরের সীমা পদ্মা নদীর গতি পরিবর্তনে ও ভীষণ আক্রমনে দিন-দিনই পরিবর্তিত হয়েছে। ইতিহাসের পাতায় বিক্রমপুর একটি জ্ঞানী তাপসজনের মিলন কেন্দ্র। এখানে জন্মেছেন সাহিত্যিক সৈয়দ এমদাদ আলী, বিপ্লবী, সাহিত্যিক এবং শ্রমিক-সংগঠক সত্যেন সেন, ইংলিশ চ্যানেল বিজয়ী ব্রজেন দাস, বৈজ্ঞানিক জগদীশ চন্দ্র বসু, অতীশ দিপঙ্কর, বিখ্যাত লেখক অদ্যাপক হুমায়ুন আজাদ, জনপ্রিয় অভিনেতা ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রখ্যাত লেখক, ঔপন্যাসিক সমরেশ বসু তথা কালকূটের মতো জগদ্বিখ্যাত ব্যক্তিরা। বিপ্লবী দীনেশ গুপ্ত ও বিনয় বসুও মুন্সিগঞ্জে জন্মগ্রহন করেন।
ঐতিহাসিক জনপদ বিক্রমপুর, স্বাধীন বাংলার রাজধানী বিক্রমপুর আজ ঐতিহ্য হারাতে বসেছে। এক সময়ের সেই গৌরবের রাজধানী বিক্রমপুর এখন অতিতের নিরব সাক্ষী মাত্র। তবে ইতিহাস এখনো বিক্রমপুরের কথা মনে করিয়ে দেয়। বিক্রমপুরের প্রাচীন ঐতিহ্যের অন্যতম হল অতীস দীপঙ্করের বাড়ি, মুন্সীগঞ্জ জেলা শহরের ৬ কিলোমিটার পশ্চিমে বজ্রযোগিনী গ্রামে। বিখ্যাত কবি সরোজনী নাইডুর পৈতৃক বাড়ি লৌহজং উপজেলার কনকসার গ্রামে এখন পদ্মা গর্ভে। মানিক বন্দোপাধ্যায়ের পুতুল নাচের ইতিকথার গাওদিয়া গ্রাম পদ্মার ভাঙ্গনের পর এখন অবশিষ্ট অংশ দেখতে পর্যটকরা ভীর জমান এ এলাকায়। ইতিহাসসমৃদ্ধ এই জনপদ এখন দেশের অন্যতম পর্যটন নগরী। কালের সাক্ষী হয়ে এখনও মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে বহু প্রাচীন স্থাপনা। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এই জনপদের জৌলুস ছড়ায়। পর্যটকদের হাতিছানি দিয়ে ডাকে। হাজার বছরের প্রাচীন পাল আমলের বৌদ্ধ বিহার ছাড়াও মুঘল স্থাপত্য ইদ্রাকপুর কেল্লা, সুলতানী আমলের বাবা আদমের মসজিদ এবং ব্রিটিশ স্থাপত্য সোনারং জোড়া মঠকে কেন্দ্র করে পর্যটকদের বিচরণ শুরু হয়ে গেছে। সদর উপজেলার রঘুরামপুরে হাজার বছরের প্রাচীন বৌদ্ধ বিহার এবং টঙ্গিবাড়ী উপজেলার নাটেশ্বরে প্রায় দেড় হাজার বছরের প্রাচীন বৌদ্ধ মন্দির স্তূপ তথা বৌদ্ধনগরী মাটির নিচে পাওয়া গেছে। এসব প্রাচীন অমূল্য নিদর্শন দেখতে এখানে উৎসুক মানুষের ভিড় লেগেই আছে। এত কাছাকাছি চার শাসনামলের প্রাচীন নিদর্শন বিরল। শুধু প্রাচীন স্থাপত্যই নয়, রয়েছে প্রকৃতির নয়নাভিরাম পদ্মা, মেঘনা, ধলেশ্বরী, ইছামতি, রজত রেখা ও কাজল রেখা নদীর অপরূপ সৌন্দর্য। মাওয়ার পদ্মার চর এখন আকর্ষণীয় স্থান। জগদ্বিখ্যাত বিজ্ঞানী স্যার জগদীশ চন্দ্র বসুর পৈত্রিক ভিটা শ্রীনগর উপজেলার রাঢ়ীখাল পর্যটকদের অন্যতম বিচরণ ভূমিতে পরিণত হয়েছে। পাল তোলা নৌকা, আর রাখালের গান, পিঠে পুলির দেখা মিলবে বিক্রমপুরে। বাংলার বারভূইয়াদের দমনের উদ্দেশ্যে মুন্সীগঞ্জে ১৬৬০ খ্রীস্টাব্দে মীর জুমলা ধলেশ্বরী নদীর তীরে দুর্গ নির্মাণ করেন। দুর্গের পূর্বদিকে ইংরেজীতে লেখা রয়েছে ‘দি ইদ্রাকপুর ফোর্ট’। বর্তমানে এটি মুন্সীগঞ্জ শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত। সোনারং জোড়া মঠ টঙ্গিবাড়ী উপজেলার সত্যেন সেনের সোনারং গ্রামে অবস্থিত। অনুমান করা হয় এখন থেকে সাড়ে তিনশ’ বছর আগে এই জোড়া মঠ নির্মিত হয়।
বর্তমান সময়ে বিক্রমপুরে নামের সাথে যে নামটি একদম মিলেমিশে গেছে সেটা হল “মিস্টি”। পাতক্ষীরশা এখানকার বিখ্যাত খাবার। এছাড়া রসগোল্লা, দই, চমচম, ছানা ইত্যাদি বেশ প্রসিদ্ধ এই অঞ্চলে। জনপ্রিয় খাবারের তালিকায় আরো রয়েছে বাংলার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অন্যতম অনুষঙ্গ পিঠাপুলি। শীত এলেই নতুন ধানের পিঠাপুলির স্বাদ ও মৌ মৌ গন্ধ চারদিকে ছরিয়ে পরে । ভাঁপা পিঠা, ছাঁচ পিঠা, চিতই পিঠা, দুধ চিতই, বিবিখানা, মুখশালা , চাপড়ি পিঠা, ছিট পিঠা, পাকান পিঠা, সরভাজা, পুলি পিঠা, পাতা পিঠা, পাটিসাপটা, মালপোয়া, কলা পিঠা, ক্ষীর কুলি, হাঁড়ি পিঠা, ঝালপোয়া পিঠা, ঝুরি পিঠা, নকশি পিঠা, নারকেল পিঠা, তেলের পিঠা, তেলপোয়া পিঠা, ফুল ঝুরি পিঠা, ফুল পিঠা, হাতের সেমাই পিঠাসহ, দুধ লাউ সহ নানা ধরনের পিঠা এখানকার ঐতিহ্যের একটি অংশ। পদ্মা নদীর ঢেউ আর সূর্যের মিতালি, জেলেদের মাছ ধরা, খাবারের মেন্যুতে রুপালি ইলিশ, মাছের ডিম ভাজা, লেজ ভর্তা অন্যতম উল্লেখযোগ্য। চাপাকলা, সবরী কলা, কবরী কলা, অমৃত সাগর কলার জন্য এখনো মুন্সিগঞ্জে বিখ্যাত।