১৯১৯ থেকে এখনও পর্যন্ত মোট ৬ বার কোপা আমেরিকা আয়োজনের দায়িত্ব পেয়েছে ব্রাজিল। গত পাঁচবারের মধ্যে একবারও দেশের মাটি থেকে খালি হাতে ফিরতে হয়নি ব্রাজিল দলকে। এই বছর হঠাৎ করেই একদম শেষমুহূর্তে কোপা আয়োজনের দায়িত্ব পেয়েছিলো ব্রাজিল। নেইমাররা কি পারবেন ছয়ে ছয় করে ঘরের মাঠে কোপা জয়ের অলউইন রেকর্ড অক্ষুন্ন রাখতে?
উত্তর পেতে গেলে অপেক্ষা করতে হবে আগামী রবিবার সকাল পর্যন্ত। তবে মঙ্গলবার সকালে পেরুর বিরুদ্ধে সেমিফাইনালে বিশ্বজুড়ে অগণিত সমর্থকদের বেশিক্ষণ অপেক্ষায় রাখলেন না নেইমার-প্যাকেতারা। ৩৫ মিনিটের মাথায় লুকাস প্যাকেতার করা একমাত্র গোলে পেরুকে হারিয়ে ফাইনালের বার্থটা বুক করে ফেললো ব্রাজিল (Brazil national football team)।
কোয়ার্টার ফাইনালে জঘন্য ফাউল করে লালকার্ড দেখে সাসপেন্ড হওয়া গ্যাব্রিয়েল জেসাসের (Gabriel Jesus) বদলি হিসেবে পর্তুগিজ ক্লাব বেনফিকার (S.L. Benfica) ফরওয়ার্ড এভারটন সোয়ারেসকে (Everton Soares) প্রথম দলে রেখেছিলেন ব্রাজিলের কোচ তিতে (Tite)। আর মাঝমাঠে লোক বাড়াতে লিভারপুল (Liverpool F.C.) স্ট্রাইকার রবার্তো ফার্মিনোর (Roberto Firmino) জায়গায় প্রথম একাদশে নিয়ে এসেছিলেন লুকাস প্যাকেতাকে। বাকি দল ছিল অপরিবর্তিতই।
প্যাকেতাকে প্রথম একাদশে রাখার ফল মিললো হাতেনাতেই। রিও ডি জেনেইরোর (Rio de Janeiro) এস্তাদিও নিল্টন স্যান্টোস স্টেডিয়ামের (Estádio Nilton Santos) জঘন্য মাঠেও প্রথমার্ধে ফুল ফোটালো ব্রাজিল। ম্যাচে যা সুযোগ পেয়েছিলো ব্রাজিল, তাতে প্রথমার্ধেই ৩-৪ গোলের লিড নিতে পারতো তারা। ম্যাচের ৮ মিনিটের মাথায় প্যাকেতার থ্রু ধরে রিচার্লিসন যে মাইনাসটা রেখেছিলেন, সেখান থেকে বল গোলে রাখতে পারেননি নেইমার। ১২ মিনিটের মাথায় প্রায় ৩০ গজ দূর থেকে ক্যাসেমিরোর নেওয়া বুলেট শটের ফ্রিকিক পেরুর গোলকিপার পেদ্রো গ্যালেসে (Pedro Gallese) ঠিক করে ধরতে পারেননি। ছিটকে আসা বলের নাগাল পেতে ব্যর্থ হন এভারটন।
দুপ্রান্তের উইং ধরে আক্রমণ ছাড়াও বেশ কয়েকবার দূরপাল্লার শট মারার চেষ্টা করতে দেখা গেল ব্রাজিলিয়ান মাঝমাঠকে। ১৪ মিনিটে এভারটনের গড়ানো শট সহজেই তালুবন্দি করেন গ্যালেসে। তবে ১৯ মিনিটের মাথায় প্রথম গোল পাওয়া উচিত ছিল ব্রাজিলের। আবারও গোল লক্ষ্য করে দূর থেকে শট নেন ক্যাসেমিরো (Casemiro)। নিজের বাঁদিকে ঝাঁপিয়ে পড়ে গ্যালেসে নিশ্চিত গোল বাঁচালেও ফিরতি বল ড্যানিলো (Danilo) আবার বাড়িয়ে দেন ক্যাসেমিরোকে। অসাধারণ ব্যাকহিলে পুরো পেরু ডিফেন্সকে অনাবৃত করে দেন তিনি। ক্যাসেমিরোর থেকে বল পেয়ে লুকাস প্যাকেতা (Lucas Paquetá) ডানদিক থেকে কাট করে বক্সে ঢুকে যে বল বাড়ান, সেখান থেকে গোল না হওয়াই আশ্চর্যের। কিন্তু পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জ থেকে গোলকিপারের গায়ে বল মারেন নেইমার (Neymar Jr.)। ফিরতি বলে আবারও রিচার্লিসনের শট অনবদ্য সেভ করেন পেরুর গোলরক্ষক।
পেরুর ডিফেন্সে তখন আছড়ে পড়ছে একের পর এক ব্রাজিলিয়ান আক্রমণের ঢেউ। সেই ঢেউয়েই শেষমেশ ৩৫ মিনিটের মাথায় বাঁধ ভাঙলো পেরুর রক্ষণের। রিচার্লিসনের (Richarlison) থেকে বল পেয়ে নেইমারের সোলো দৌড় এবং তারপর দুরন্ত বল কন্ট্রোল-সহ ড্রিবলে বক্সের ভিতর একসঙ্গে পেরুর তিন তিনজন ডিফেন্ডার কেটে গেলেন। নেইমারের মাইনাস থেকে বাঁপায়ের সুন্দর প্লেসমেন্টে গোল করতে ভুল করেননি প্যাকেতা (১-০)।
তবে ম্যাচের প্রথমার্ধ যদি ব্রাজিলের হয়, দ্বিতীয়ার্ধের বেশীরভাগটা জুড়েই প্রাধান্য রেখে গেলো পেরু। ঘরে বসে বেশকিছু উৎকণ্ঠার মুহূর্ত নিশ্চয়ই কাটাতে হলো ব্রাজিল সমর্থকদের। বিরতিতে রাজিয়েল গার্সিয়া (Raziel García) এবং এমএলএসে (Major League Soccer) খেলা মার্কোস লোপেজ (Marcos López) নামার পর পেরুর আক্রমণের তেজ বাড়ে। ৪৯ মিনিটের মাথায় ম্যাচে নিজেদের সেরা সুযোগটি পায় পেরু। ১৯ নম্বর জার্সিধারী জোসিমার ইয়োতুন (Yoshimar Yotún) মাঝমাঠ থেকে অসাধারণ একটি এরিয়াল থ্রু বল বাড়ান পেরুর একমাত্র স্ট্রাইকার জিয়ানলুকা লাপাডুলা-র (Gianluca Lapadula) উদ্দেশ্যে। বক্সের ভিতরে ডানদিক থেকে কাট করে ঢুকে আসা লাপাডুলা-র বাঁপায়ের শট অসাধারণ দক্ষতায় বাঁচান ব্রাজিলের গোলরক্ষক এডেরসন মোয়ারেস (Ederson Santana de Moraes)।
গোলমুখ খুলতে ব্যর্থ হওয়ার পরেও কিন্তু দমে যায়নি পেরু (Peru national football team)। বরং ব্রাজিলিয়ান ডিফেন্সে যথেষ্ট চাপ বাড়াচ্ছিলো তারা। বিশেষত পরিবর্ত হিসেবে নাম গার্সিয়া খানতিনেক শট নেন ব্রাজিলীয় গোল লক্ষ্য করে, যদিও ৬১ মিনিটের গড়ানো শটটি ছাড়া সেইভাবে এডারসনকে বিব্রত করতে পারেননি তিনি। শটটি ঠিক সময়ে ক্লিয়ার করে বিপন্মুক্ত করেন বর্ষীয়ান ডিফেন্ডার থিয়াগো সিলভা (Thiago Silva)। ম্যাচের বাকি সময়ে কোনও দলই আর সেইভাবে বিপজ্জনক কোনও মুভ করতে পারেনি।
এভারটনকে রাইট উইংয়ে খেলিয়ে রিচার্লিসনকে কখনও সেন্টার ফরওয়ার্ড, কখনও একটু বাঁদিকে নিচ থেকে অপারেট করে নেইমারকে ফ্রি রোলে খেললেন তিতে। ফলও মিললো। লেফট ব্যাক রেনান লোডি (Renan Lodi) বারবার উঠে এসে আক্রমণে সাহায্য করছিলেন। সাথে মাঝমাঠে প্যাকেতা-ক্যাসেমিরো-ফ্রেডরা (Fred) আক্রমণে যোগ দেওয়ায় প্রায় প্রতিটি মুভের সময়ই পেরুর রক্ষণে সাত-আটজন হলুদ-নীল জার্সির আনাগোনা ছিল। ফলে ম্যাচে ব্রাজিলের গোলসংখ্যা বাড়লেও অবাক হওয়ার কিছু ছিল না।
যদিও দ্বিতীয়ার্ধে তিনজন সেন্টার ব্যাকের মধ্যে একজনকে তুলে নিয়ে রিকার্ডো গ্যারেকা (Ricardo Gareca) গার্সিয়াকে নামাতেই চাপ বাড়লো ব্রাজিলিয়ান ডিফেন্সে, যা চিন্তায় রাখবে তিতে-কে। কোপার ফাইনালে অভিজ্ঞ কিন্তু কিছুটা শ্লথ হয়ে যাওয়া থিয়াগো সিলভা, নাকি রিয়েল মাদ্রিদের (Real Madrid CF) হয়ে বর্তমানে ভালো ফর্মে থাকা এডের মিলিতাও (Éder Militão) – মারকুইনোসের (Marquinhos) সঙ্গে সেন্ট্রাল ডিফেন্সে জুটি বাঁধবেন কে, তা নিয়েও ভাবতে হবে ব্রাজিলের থিঙ্কট্যাঙ্ককে।
ভারতীয় সময় বুধবার ভোর সাড়ে ছটায় অপর সেমিফাইনালে নামছে লিওনেল মেসির নেতৃত্বাধীন আর্জেন্তিনা (Argentina national football team) নামছে কলম্বিয়ার (Colombia national football team) বিরুদ্ধে। ম্যাচের সেরা হয়ে সাংবাদিক সম্মেলনে নেইমার বলেই দিলেন – ফাইনালে চিরশত্রু আর্জেন্তিনাকেই চাইছেন তাঁরা!