রাস্তার প্রচন্ড জ্যাম ঠেলে যখন যুবভারতীর 1নং গেটের কাছে 407টি দাঁড়ালো তখন ম্যাচ শুরুর বাঁশি বাজবে বাজবে করছে। গাড়ি থেকে একলাফে নেমে টিকিটটা কোনোমতে গেটে দেখিয়ে শুরু দলবেঁধে দৌড়। তখনও সাধের যুবভারতী নিজে অতটাও কড়া ছিল না তার প্রিয় দর্শকদের জন্য। তাই বসার টিয়ার বা এয়ারপোর্ট কায়দায় চেকিং নিয়েও সে তখন মাথা ঘামাত না সে। সে তখন অপেক্ষায় থাকতো তার সবুজ ক্যানভাসে বল নিয়ে ফুটবল শিল্পীদের আঁকিবুঁকি দেখতে উপস্থিত হাজারো দর্শকের উৎসাহ, উদ্দীপনা,আবেগ, পাগলামো দেখার জন্য।
খেলা শুরু হয়ে গেছে ততক্ষণে; আর মনের ভিতরে কেমন একটা হতে লাগলো, “ইশ! গ্যালারিতে পৌঁছানোর আগেই যদি গোল হয় আর সেটা মিস করে যাই!” দৌড়ের গতি বাড়লো আরও। কোনোমতে দ্বিতীয় টিয়ারে উঠতেই পুলিশ বলল, “এটা হাউসফুল। উপরের তলায় যাও”। মাঠের দিকে তাকিয়ে দেখি দূরের গোলপোস্টের সামনে মানবপ্রাচীর আর বলের সামনে দাঁড়িয়ে 21নং জার্সি পরা ছোটখাটো চেহারার বাচ্চা একটা ছেলে। ফ্রীকিক! পাশে থাকা বন্ধুদের বললাম যে এটা কি হয় দেখে নিয়ে তারপরই যাই। ছোট্ট কটা স্টেপ নিয়ে শট, মানবপ্রাচীরের উপর দিয়ে বল গিয়ে বাঁক খেয়ে ডানদিকের টপ কর্নারের জালে বল জড়িয়ে গেল। যুবভারতীর অর্ধেক জুড়ে আওয়াজ এলো “গো ও ও ও ও ও ল ল ল ল”, সাথে আমরাও আনন্দে লাফিয়ে জড়িয়ে ধরলাম একে অপরকে। আর বাকি অর্ধেক দিকে তখন পিন পড়ার শব্দ শুনতে পাওয়ার মত নিস্তব্ধতা। না গোল দেখাটা আমার মিস হয়নি। 2015 সিএফএল ডার্বিতে ডু ডং হিউনের ফ্রীকিকে এগিয়ে গেলো আমাদের প্রিয় ইস্টবেঙ্গল।
ম্যাচের শুরুর আগে থেকেই মাঠ ও মাঠের বাইরের সেই মনস্তাত্বিক লড়াইতা শুরু হয়ে গেছিল। গলি থেকে রাজপথ, চায়ের দোকান থেকে লোকাল ট্রেন সব জায়গায় তখন শুধু এই ম্যাচ নিয়েই আলোচনা। কোলকাতা সহ বাংলার বিভিন্ন জায়গা থেকে আসা গাড়িগুলোর গন্তব্য যখন ওই একজায়গায় এসে মেশে তখন পাশ দিয়ে যাওয়া ফুটবল নিয়ে খোঁজ না রাখা মানুষ গুলোও হয়তো গাড়ির কাঁচ নামিয়ে সেই উন্মাদনা বোঝার চেষ্টা করে। মোহনবাগান কোচ সঞ্জয় সেনের সেই দাম্ভিক ‘মুড়ি-মুড়কির তুলনা’ মন্তব্য যেন বিশ্বজিৎ ভট্টাচ্চার্যের জেদটা আরও বাড়িয়ে তুলেছিল। আর যেন পুরো ইস্টবেঙ্গল দলটাকেই চাগিয়ে তুলেছিল। আর সেই লীগের সর্বোচ্চ স্কোরার ইস্টবেঙ্গলের প্রাণভোমরা ডু ডং যেন একটু বেশিই উত্তেজিত ছিল ম্যাচে নিজের ছাপ ফেলতে। কারণ তার আগে খবরের কাগজে তাকে নিয়ে যা লেখা হচ্ছিল আর মোহনবাগান সমর্থকরা তো ধরেই নিয়েছিল যে তাদের দলের বিরুদ্ধে কিছুই করতে পারবে না আমাদের হার্টথ্রব ডং।
আনন্দ করতে করতেই আবার দৌড়, তিন তলায় পৌঁছতে হবে তো! কিন্ত সেখানেও এতো ভিড় যে বসার জায়গা নেই। বাধ্য হয়ে কেউ পাশের ডিভাইডার টপকে আবার কেউ ডিভাইডারের নিচ দিয়ে গিয়ে ধূলো মেখেই বসলাম। খেলা চলতে থাকলো ভালো গতিতে। ইস্টবেঙ্গল যেমন আক্রমণ করে গোলের ব্যবধান বাড়াতে চাইছিল ঠিক তেমনই মরিয়া হয়ে গেল শোধের চেষ্টায় ছিল মোহনবাগান। কখনও বাগানের ডুডুর হেড লক্ষ্যভ্রষ্ট হচ্ছিল তো কখনও আবার বিকাশ জাইরুর উইং ধরে দৌড় গুলো দিয়ে আক্রমণ তৈরি করছিল ইস্টবেঙ্গল। ম্যাচের 38 মিনিটের মাথায় মোহনবাগান বক্সের সামনে আবার একটা ফ্রীকিক, এবার গোলের আরেকটু কাছে, আবার দাঁড়িয়ে ডু ডং। বাকি ইস্টবেঙ্গল সমর্থকদের মত আমার মনও ভেবে উঠলো যে আবার কি গোল হবে তাহলে! আর ভাবতে ভাবতে তাই হলো। সেই একই রকম ভঙ্গিতে শট আর সেই একই রকম ভাবে বাঁক খেয়ের আবার সেই ডানদিকের টপ কর্নার দিয়ে জালে জড়ালো বল। 2টো ফ্রীকিক আর 2টো গোল যেন আইডেন্টিকাল টুইন। আর 2টি ক্ষেত্রেই রফিককে ফাউল করায় ফ্রীকিক 2টো আদায় হয়েছিল। গোটা লাল-হলুদ গ্যালারির গর্জনে তখন কান পাতা দায়। আর গোলের সেলেব্রেট করতে যখন গোটা ইস্টবেঙ্গল দল গাংনাম স্টাইল নাচ্ছিল তখন মাঠে থাকা সাপোর্টারদের সাথে মনে হয় টিভির পর্দায় খেলা দেখা সমর্থকরাও নেচে উঠেছিল। আর মনে হয় ভেঙে দিয়েছিল হাজার হাজার মোহনবাগান সমর্থকদের হৃদয়। আর কেটে গেছিল বাগানের গোলের শেষ প্রহরী সমর্থকদের আদরের বাজপাখি শিল্টন পালের ডানা 2টি। কারণ বাজপাখি হয়ে যতই তিনি উড়ুন না কেন ডং এর সোয়ারভিং মিসাইল কিক 2টির নাগাল কিন্তু তিনি পাননি কখনই।
প্রথমার্ধ শেষে যখন 2টি দল সাজঘরে ফিরছে তখন 2টি দলের শরীরের ভাষা দেখে এটুকু তো পরিষ্কার বোঝাই যায় যে এরকম একটা ম্যাচে একই রকম 2টি বিশ্বমানের গোল হলে কারা মানসিক ভাবে কোথায় থাকতে পারে! আর সেটা আন্দাজ করেই হয়তো মোহনবাগান গ্যালারির কিছু একটা অংশ ফাঁকা হতে শুরু হয়েছিল।
এরপর দ্বিতীয় অর্ধের শুরুতে কাৎসুমি ইউসার আগমন আর তাদের দর্শকদের তাতানো কিছুক্ষনের জন্য তাদের দলকে উজ্জীবিত করলেও তা ছিল ক্ষণস্থায়ী। কিছুক্ষণ বাদে ডুডু ওমাগবেমির লাল কার্ড মোহনবাগান এর খেলোয়াড় আর সমর্থক সবারই স্পাইনাল কর্ডটা ভেঙে দিয়েছিল এবং ইস্টবেঙ্গল সাপোর্টারদের মনে আশা ও মোহনবাগান সমর্থকদের মনে চাপা উৎকণ্ঠা ছিল যথাক্রমে একটা বড় জয় ও বড় ব্যবধানে হারের। 81 মিনিটের মাথায় যখন বিকাশ জাইরুর মাপা ক্রস থেকে মহম্মদ রফিক হেডটা মাটিতে ড্রপ খেয়ে জালে জড়ালো তখন মোহন গ্যালারি অর্ধেক ফাঁকা হয়ে গেল। আর ম্যাচের ইনজুরি টাইমে কর্নার থেকে মাথা ছুঁইয়ে রাহুল ভেকের গোল বাগানের কফিনে শেষ পেরেকটা পুতেই দিল শেষ অবধি। মনে তখন অফুরন্ত আনন্দ। বাগান গ্যালারি ততক্ষণে প্রায় ফাঁকা পুরো। গুটি কয়েক লোক সেখানে শেখ যাচ্ছে। 4-0 গোলে জিতলাম। কিন্তু একটা দুঃখ থেকেই গেল যে যা খেলা ইস্টবেঙ্গল দেখালো তাতে 5 গোল আজকে আবার দিতে পারতাম; সেটা হলো না! তাও ফিরলাম সেই গাড়ি চেপেই আনন্দ করতে করতে রাজার মতন।