শেষবার এসসি ইস্টবেঙ্গল যেই ম্যাচটি জিতেছিল বেঙ্গালুরু এফ সির বিরুদ্ধে সেই ম্যাচেও রবি ফাউলার ছিলেন গ্যালারিতে। তার পর থেকে মাঠের ভিতরে এবং বাইরে বিতর্ক আর ব্যর্থতায় ইস্টবেঙ্গল সংক্রান্ত হেডলাইনে সমর্থকদের জন্য আশাব্যঞ্জক কিছু থাকতোনা। সাত ম্যাচ অপরাজিত রেকর্ড লীগের ‘ফার্স্ট বয়’ মুম্বাই সিটির কাছে ভাঙলেও, গোয়ার বিরুদ্ধে নিশ্চিত তিন পয়েন্টের জায়গায় এক পয়েন্ট নিয়ে ফিরলেও খেলা খারাপ হয়নি। কিন্তু বেঙ্গালুরু এফ সির বিরুদ্ধে ফিরতি ম্যাচে হতশ্রী পারফরম্যান্সের পর লিভারপুলের কিংবদন্তি ফুটবলারের কোচিং দক্ষতার উপর প্রশ্ন উঠে আসে প্রচুর। মূলত প্রথম এগারো নিশ্চিত করতে না পারায়। গোদের উপর বিষফোঁড়ার মতন চার ম্যাচের সাসপেনশনের শাস্তির খাড়া নেমে এলো।
অতএব আজ সাইডলাইনে ছিলেন টনি গ্র্যান্ট। চোট-আঘাত আর কিছু পজিশনে জঘন্য খেলতে থাকা খেলোয়াড়দের পারফরম্যান্সের নিরিখে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আজ হলো। চোট ফেরত রাজু গায়কোয়াড় আর দীর্ঘদেহী সার্থক গোলুই -এর অন্তর্ভুক্তির ফলে ভালো ফর্মে থাকা স্কট নেভিলকে বসিয়ে একটি আক্রমণাত্মক লাইন-আপ সাজানো গিয়েছিল। আরন হামাদি হ্যালোওয়েকে দিয়ে গোল করানো যাবেনা বুঝে এন্টোনি পিলকিংটনকে ফিরিয়ে আনা হয় দলে। ক্রমাগত খারাপ খেলতে থাকা মিলান সিং এবং অজয় ছেত্রীর জায়গায় দলে আসেন মুম্বাই সিটি এফসি-র আরেক ব্রাত্য খেলোয়াড় সৌরভ দাস।
সি ডি এম, স্ট্রাইকার আর রাইট উইং বাদ দিলে টীম মোটামুটি সেট। এই তিনটে পজিশনেই জোড়াতালি দিতে গিয়ে ক্রমাগত পরিবর্তন হচ্ছে প্রথম একাদশে। আজ যদিও এমন একটি পরিবর্তন হলো যা অনেকেই অনুধাবন করেননি। এই মরসুমের ভারতীয় খেলোয়াড়দের মধ্যে সবচেয়ে ধারাবাহিকভাবে প্রদর্শন করা দেবজিৎ ঘোষের জায়গায় তিন কাঠির নীচে খেললেন ‘স্পাইডারম্যান’ সুব্রত পাল। আজকের দল নির্বাচনের একটি বিশেষ দিক হলো, রাজু ছাড়া বাকি সব ভারতীয় খেলোয়াড়-ই বঙ্গসন্তান। শেষ কবে ইস্টবেঙ্গলের প্রথম একাদশে পাঁচজন বাঙালি ফুটবলার খেলেছেন তা অতি বড় সমর্থক-ও মনে করতে পারবেন বলে মনে হয়না। এছাড়া মাঝমাঠে শুরু থেকেই খেলেন জ্যাক মাঘোমা।
রুটিন-মাফিক ব্রাইট এনোবাখারের বলের উপর দুরন্ত নিয়ন্ত্রণ এবং বিপক্ষ রক্ষণকে অতিষ্ট রাখার প্রবণতা প্রশংসনীয়। মাঘোমা দুর্দান্ত খেললেন আজ। একটি লক্ষণীয় ট্যাকটিক্যাল পরিবর্তন ছিল আজ। স্টেইনম্যানকে খেলানো হলো মূলত আক্রমণ বিভাগে জোর দিয়ে আর মাঘোমা খেললো অনেক ভিতরে, মূলত রক্ষণভাগ সামলে। জার্মান মিডফিল্ডারের নিজে নারায়ণ দাসের তোলা কর্নার থেকে মাথা ছুঁয়ে গোল করা হোক বা এসসি ইস্টবেঙ্গল আক্রমণ থেকে বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া ডিফেন্স-চেড়া থ্রু বল থেকে পিলকিংটনকে দিয়ে গোল করানো, নিজের ভূমিকা অনবদ্য ভাবে পালন করেছেন ‘ম্যান অব দ্য ম্যাচ’। ৩-৫-২ ছকেও নারায়ণ দাস প্রতিদিন নিজেকে ছাপিয়ে যাচ্ছে। সে সেট-পিস্ হোক বা বাম-প্রান্ত বরাবর দৌড়ে। আজ ইস্টবেঙ্গলের সেট-পিসে বেশ কয়েকবার অভিনবত্বের উদাহরণ পাওয়া গেছে।
সোদপুরের মিষ্টুকে আজ বিশেষ কিছু করতে হয়নি। শুধু ভাল্সকিসের একটি হেড শেষ মুহূর্তে দুরন্ত না বাঁচালে ইস্টবেঙ্গলের তিন পয়েন্ট আজও গড়াগড়ি খেত। গোলকিপিং পজিশনে একমাত্র চিন্তার বিষয় ছিল আউটিং, সুব্রতর বেরিয়ে আসার অনুমান ক্ষমতা দেবজিতের থেকে তুলনায় ভালো আর উচ্চতা বেশি থাকায় ছয় গজ বক্সের ভিতর গোলকিপারকে কর্তৃত্ত্ব করতে দেখা যাবে কিনা সেটা ভবিষ্যৎ বলবে।
দ্বিতীয়ার্ধে পঁয়ষট্টি মিনিটের মধ্যেই চারটে চট -জলদি পরিবর্তন নেন বার্নলে, বোল্টন ওয়ান্ডারার্স, চেন্নাইয়িনে সাফল্য পাওয়া ওয়েন কয়েল। বিরতির পর প্রথম পনেরো-কুড়ি মিনিট ইস্পাতনগরীর বুকে নতুন দমের সঞ্চার ইস্টবেঙ্গল মাঝমাঠকে বিব্রত করেছিল বিলক্ষন। কিন্তু তাতে অর্ধে তৈরী হচ্ছিলো ফাঁক-ফোকর। আর সেই সুযোগেই এন্টোনি পিলকিংটনের দ্বিতীয় গোল। আইরিশ খেলোয়াড়ের দুর্ধর্ষ গতির শট ইস্টবেঙ্গলের প্রাক্তন টি পি রেহেনেশকে কোনো সুযোগই দেয়নি। তিরাশি মিনিটের মাথায় পিটার হার্টলে একটি গোল পরিশোধ করলেও অতিরিক্ত সময়ের দু-তিন মিনিট ছাড়া ইস্টবেঙ্গল ডিফেন্স খুব একটা চাপে ছিলোনা তেমন। এরই মাঝে যদিও ভালস্কিস এবং পিলকিংটনের প্রয়াস প্রতিহত হয় পোস্টে।
নাক কুচঁকানোর মতন দুটি জায়গা আছে এই ম্যাচে। রাজু গায়কোয়াড়, ড্যানি ফক্স এবং সার্থক গোলুই একসাথে ভালোই খেললো আজ। তিনজনই অভিজ্ঞতার সম্পূর্ণ ব্যবহার করেছে। যদিও সাথে বাম প্রান্তে নারায়ণের যোগ্য সঙ্গত পেলেও অঙ্কিত মুখার্জী মাঝে মাঝেই হারিয়ে যাচ্ছে ম্যাচ থেকে। আর সেই কারণেই বক্সের ডান দিকটা ভঙ্গুর লাগছে। খুব সহজেই বল ভেসে আসছে ওই পাশ থেকে। দ্বিতীয়ত, পিলকিংটনের স্ট্রাইকার পজিশনে খেলার তেমন অভিজ্ঞতা না থাকায়, ওর বক্সের ভিতর শট নেবার সময় নির্বাচন ভুল হচ্ছে। তার উপর তার স্বাভাবিক খেলা অনুযায়ী বল পায়ে রাখতে পছন্দ করায় বক্সের ভিতর জায়গা ছোট করে দিচ্ছে বিপক্ষ রক্ষণ। আর সব শেষে গোল না পাওয়ায় চাপ নিয়ে ফেলছে অতিরিক্ত। সুতরাং তার খেলা দেখতে স্বার্থপরের মতন লাগছে। এই সমস্যাটা আক্রমণভাগের খেলোয়াড়দের মধ্যে বোঝাপড়া বাড়িয়েই ঠিক করা সম্ভব।
এই ম্যাচে তিন পয়েন্ট লাল-হলুদকে কেরালা ব্লাস্টার্সের উপরে নয় নম্বরে তুলে আনলেও, পরের ম্যাচে প্লে-অফ তাড়া করতে থাকা হায়দ্রাবাদ এফ সির অল্প বয়েসী টগবগে কিছু প্রতিভাবান ভারতীয় খেলোয়াড়ের বিরুদ্ধে কৌশলে কি পরিবর্তন আসবে ? অপেক্ষা বারো তারিখের।