রবিবার বিকেলে গোয়ার মারগাঁওয়ের ফতোরদা স্টেডিয়ামে নিজেদের ষোলোতম ম্যাচটি খেলতে নামছে এসসি ইস্টবেঙ্গল। প্রথম পাঁচটা ম্যাচে চারটে হার, দশ গোল হজম করা দলটা পরের সাতটা ম্যাচ অপরাজিত থেকে প্রথমবার আইএসএল খেলতে নেমেই শেষ চারে যাওয়ার একটা আশা বেশ ভালোমতোই সমর্থকদের মধ্যে জাগিয়েছিলো।
কিন্তু তাল কাটলো এরপরেই। মুম্বাই সিটি এফসি ম্যাচে হারটা তবুও বেশীরভাগ সমর্থকই হজম করে নিয়েছিলেন, মেনে নিয়েছিলেন মুম্বাই সিটি এফসি-র শক্তি, নিজেদের দুর্বলতা তথা দ্বিতীয়ার্ধে টিমের দুরন্ত পারফরম্যান্স। কিন্তু এরপর থেকেই মাঠে পারফর্মেন্সের গ্রাফ নিম্নগামী। পাল্লা দিয়ে বাড়ছে মাঠের বাইরের নাটকও।
অন্যদিকে শুরুটা ভালো করলেও জামশেদপুর এফসি-ও কিছুটা খেই হারিয়েছে মাঝপথে।
জামশেদপুর এফসি:
আজ বরং প্রতিপক্ষকে নিয়ে আলোচনাটা থাক। এমনিতেই এসসি ইস্টবেঙ্গলের শেষ চারে যাওয়ার আশা এখন শুধু খাতায় কলমেই সীমাবদ্ধ। দু-একটা জিতলে, মিরাকলের কোনও সম্ভাবনা তৈরী হলে না হয় আবার এইসব বিষয়ে ঢোকা যাবে।
এসসি ইস্টবেঙ্গল:
ওঁ ব্রাইটায় নমঃ। এসসি ইস্টবেঙ্গল শিবিরের একটাই মন্ত্র। গত কয়েকটা ম্যাচ ধরেই দেখা যাচ্ছে, গোল হজম করে চাপে পড়লেই এসসি ইস্টবেঙ্গলের খেলোয়াড়রা চোখ বন্ধ করে বল তুলে দিচ্ছেন ব্রাইটের পায়ে এবং আশা করছেন, করলে তিনিই কিছু করতে পারেন। কিন্তু ব্রাইট নিজেও তো ঠিক সুযোগসন্ধানী স্ট্রাইকার নন। তিনি অনেকটা গেমমেকারের ভূমিকা পালন করছেন বলা যায়। বামপ্রান্ত ধরে খেলতে ভালোবাসেন। দু-তিনজনকে অনায়াসে কাটাতেও পারেন। কিন্তু তারপর? ব্রাইটের বাড়ানো বলগুলো থেকে কাউকে তো গোলটাও করতে হবে।
১৯ বছর বয়সী হারমানপ্রীত অনভিজ্ঞ। দৌড়াদৌড়ি করেন বটে, কিন্তু এখনও গোলের গন্ধ পেয়ে ঠিক সময়ে ঠিক জায়গায় পৌঁছে যাওয়ার পরিণতিবোধটা আসেনি। তবে প্রতিভাবান। পাশে অভিজ্ঞ কাউকে পেলে, সঠিক কোচের হাতে পড়ে কয়েকবছর ঘষামাজা করলে হয়তো আশা করা যায়, এটিকে মোহনবাগান-এর মনভির সিংয়ের মতো ফুল ফোটালেও ফোটাতে পারেন। তবে মনভির এফসি গোয়াতে সার্জিও লোবেরার হাতে তিন বছর ধরে তৈরী হয়েছেন। শতাব্দীপ্রাচীন ইস্টবেঙ্গলের কর্তা-সদস্য-প্রাক্তন ফুটবলার-সমর্থকদের সেই ধৈর্য্য আছে কি? উত্তরটা কারোরই অজানা নয়।
জাঁক মাঘোমা। টটেনহ্যাম হটস্পারের ইয়ুথ অ্যাকাডেমির প্রোডাক্ট। গত পাঁচ বছর খেলেছেন বার্মিংহ্যাম সিটিতে। কঙ্গোর হয়ে দুবার আফ্রিকান নেশনস কাপও খেলেছেন। এসসি ইস্টবেঙ্গলে উনি যখন খেলেন, এমনিতে প্রচুর ওয়ার্কলোড নেন। কিন্তু তাতেও খুব কি কার্যকরী কিছু হচ্ছে? বল রিসিভ করেই নিজেদের ডিফেন্সের দিকেই ঘুরতে থাকেন, ওই যে বাড়তি ৪-৫ সেকেন্ড নেন, তাতেই বিপক্ষ নিজেদের ডিফেন্স গুছিয়ে নেওয়ার সময় পেয়ে যায়। ফলে খেটে খেললেও কার্যকরী তেমন কিছু হচ্ছে না।
অ্যান্টনি পিলকিংটন। এসসি ইস্টবেঙ্গলে শুরুটা ভালোই করেছিলেন। ২০০৪-০৫ মরশুমে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের ইয়ুথ একাডেমিতে ছিলেন। ২০১২ সালে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের বিপক্ষে গোলও করেছেন। কিন্তু এটা ২০১২ নয়, ২০২১। চোট পাওয়ার পরেই কি যে হলো, মাঠে রাখাই এখন দুষ্কর হয়ে দাঁড়িয়েছে। পুরোনো ঘিয়ের গন্ধ শুঁকে আর কতদিন?
জেজেকে নিয়ে অতিরিক্ত শব্দ খরচ করে খুব একটা লাভ নেই। কোচও খুব একটা খেলান না। খেললেও জার্সি নম্বর দেখে খুঁজতে হয়। জাতীয় দলে জেজেরই এক সতীর্থ ৩৬ বছর বয়সে সিক্স প্যাক বানিয়ে এইবছরের আইএসএলেও পাঁচটি গোল করে ভারতীয়দের মধ্যে শীর্ষে। জাতীয় দলের আরেক সতীর্থ ২৫ বছরের মনভীর এই বছর ৪টে গোল, ৩টে এসিস্ট করে ফেলেছেন। ৩০ বছর বয়সী জেজে কি করছেন, সেটা তিনিই ভালো বলতে পারবেন।
ব্রাইট, মাঘোমা, পিলকিংটন, জেজে, হারমানপ্রীতদের প্রসঙ্গ এই জন্যই আনতে হলো কারণ এসসি ইস্টবেঙ্গল ১৫ ম্যাচে গোল করেছে মাত্র ১২টি। আর একটা দুগ্ধপোষ্য শিশুও জানে, ম্যাচ জিততে গেলে গোল করাটা যে জরুরী। এসসি ইস্টবেঙ্গলে কোটি টাকার প্রশ্ন – গোলটা কে করবে?
ডিফেন্স ও মাঝমাঠ নিয়ে নতুন করে কিছু বলার নেই। ডিফেন্সের কম্বিনেশন মোটামুটি একই থাকবে। মাঝেমধ্যে রানা, রাজুরা তাসখেলার শাফলের মতো এদিক ওদিক হবেন। কে কবে নামবেন, কিসের ভিত্তিতে নামবেন, সেটা বলা এবং বোঝা কষ্টসাধ্য।
একই অবস্থা মাঝমাঠেও। কোনওদিন মিলন, কোনওদিন অজয় ছেত্রী, কোনওদিন আঙ্গুসানা – কে, কবে নামবেন, কেউ জানে না। লোকেন মিতাই আর শেহনাজ সিংয়ের নামে গোয়ায় কোনও মিসিং ডায়েরি হয়ে থাকলেও অবাক হওয়ার কিছু নেই। তবে বিকাশ জাইরু মনে হয় খেলছেন না কারণ ওই জায়গা দিয়েই আপাতত ব্রাইট অপারেট করছেন।
এমনিতে ১৫ ম্যাচ পরেও এসসি ইস্টবেঙ্গলের স্থায়ী প্রথম একাদশ বলে কিছু নেই। রোজই মিউজিক্যাল চেয়ার চলছে। রবি ফাউলারের প্রথম একাদশ নিয়ে স্বয়ং নস্ত্রাদামুসও ভবিষ্যৎবাণী করার সাহস দেখাতেন কিনা সন্দেহ।
রবি ফাউলারের প্রসঙ্গ যখন উঠলোই, তার সাথে আনুসাঙ্গিক আরও অনেককিছুই আসবে। চার ম্যাচ ব্যান তো আছেই, ফলে বেঞ্চে দায়িত্বে থাকবেন টনি গ্র্যান্ট। যিনি রবি ফাউলারের আরেক কাঠি উপরে। রবি ফাউলার তবু আইএসএলের নিকৃষ্টতম রেফারিংয়ের বিরুদ্ধে সঙ্গতকারণেই মুখ খুলেছেন, এফএসডিএলের চক্ষুশূলও হয়েছেন। সমর্থকরা তাঁর কোচিং নিয়ে একগাদা প্রশ্ন তুললেও ক্লাবের জন্য জন্য মুখ খোলায় এই ইস্যুতে লিভারপুল লেজেন্ডের পাশেই দাঁড়িয়েছেন। কিন্তু টনি গ্র্যান্ট আবার যেচে বিতর্ক বাঁধিয়েছেন। ইস্টবেঙ্গলে কর্তা-ইনভেস্টর বিভেদ আজ থেকে নয়, সেই কোয়েস আমল থেকেই। কিছু সমর্থক জেগে ঘুমোনোর ভান করলেও সংখ্যাগরিষ্ঠ সমর্থক বুঝতেই পারছেন, বারবার যখন একইরকম সমস্যা মাথাচাড়া দিচ্ছে, তখন সমস্যার শিকড় কোথায়। সেই অর্থে টনি গ্র্যান্টের আশঙ্কা হয়তো অমূলক ছিল না। কিন্তু কথা হচ্ছে, উনি তো টেকনিক্যাল মানুষ, কোচিং টিমের অন্তর্ভুক্ত। প্রশাসনিক বিষয়ে তাঁর ঢোকার কোনওরকম প্রয়োজন বোধহয় ছিল না। তার জন্য প্রণববাবু-হরিমোহনবাবুরা রয়েছেন। তাও হয়তো সমর্থকদের সহানুভূতি পেতেন, যদি মাঠের পারফরমেন্স তাঁর হয়ে কথা বলতো।
তার সাথে আরও এক বিরক্তিকর বিষয়ের আমদানি ঘটেছে এসসি ইস্টবেঙ্গলে, তা হলো প্রতি ম্যাচের আগে ও পরে ভার্চুয়াল সাংবাদিক সম্মেলনে রবি ফাউলার, টনি গ্র্যান্টদের রোজ রোজ একই কাঁদুনি গাওয়া। প্রি-সিজন হয়নি, নিম্নমধ্যমানের ভারতীয় ব্রিগেড, নিকৃষ্ট রেফারী – সবাই এই বিষয়গুলো সম্পর্কে অবহিত। সেগুলো রোজ তোতাপাখির মতো আওড়ানোর যুক্তিগ্রাহ্য কোনও কারণ নেই। সবকিছু বাদ দিলেও ১৫ ম্যাচ পরে প্রি-সিজন না হওয়ার একই কথা ঘ্যানঘ্যান করা সাদা বাংলায় ব্যর্থতার অজুহাত ছাড়া অন্যকিছু বলে মনে হচ্ছে না। লেবু কিন্তু বারবার কচলাতে কচলাতে তেতো হয়ে যাচ্ছে।
কর্তা-ইনভেস্টর টানাপোড়েন যথারীতি অব্যাহত। শোনা যাচ্ছিল, এটিকে মোহনবাগান ম্যাচের পরে দুপক্ষ আলোচনার টেবিলে বসবেন। সমর্থকরাও আশায় বুক বাঁধছিলেন, সেই মিটিংয়ের পরে প্রণববাবু-হরিমোহনবাবুরা একগাল হাসি নিয়ে একসাথে বেরিয়ে ফটোগ্রাফারদের পোজ দেবেন, আর লাল হলুদ জনতা সেটা বাঁধিয়ে রাখবেন। কিন্তু আনুষ্ঠানিক বিবৃতি, এক্তিয়ার, “যেমন কর্ম তেমন ফল”, “টনি গ্রান্ট ওর মনের কথা লিখেছে”, “ইনভেস্টর আজ আছে কাল নেই” – বহুপ্রতীক্ষিত শান্তিচুক্তির আগে দুপক্ষের গোলাগুলি অব্যাহত।
অবশ্য ইস্টবেঙ্গলে শেষ কবে কোনও মরশুমের মাঝপথে বিতর্ক জন্মায়নি, তা মনে করার জন্য কোনও ইতিহাসবিদ প্রয়োজন। খেলা বাদে মুচমুচে আলোচনার সব ব্যবস্থাই থাকে ইস্টবেঙ্গলে। এইসবের জাঁতাকলে পিষে মরে কেবল সমর্থকরাই। তার উপর সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে সবাই এখন শোনে কম, বলে বেশী। বেশিরভাগই চুলোচুলিতে ব্যস্ত। ফলে নানা মুনির নানা মতে প্রতিষ্ঠানটারই নাভিশ্বাস ওঠার জোগাড়।
শেষে একটা অপ্রাসঙ্গিক কথা। আদি কলকাতার শিরায় শিরায় ঢুকেছিলো অলিগলিতে ছড়িয়ে থাকা কেবিন রেস্টুরেন্টগুলো। প্রেমিক-প্রেমিকা তো বটেই, অন্যদেরও পছন্দের জায়গা। সাথে কফি হাউজ, গোলবাড়ির মতো ঐতিহ্যশালী জায়গাগুলো তো ছিলই। তারপর একদিন বিশ্বায়নের হাওয়া লাগলো। কলকাতার যুবক-যুবতীরা আজ কোন জায়গাগুলো পছন্দ করে, আলাদা করে বলে দিতে হবে না। আজ কেবিনের চপ কাটলেট, কবিরাজি, ফিশফ্রাইয়ে স্বাদ কমে গিয়ে ঐতিহ্যের অম্বলের চোঁয়া ঢেকুর ওঠে বেশী। গোলবাড়ির কষা মাংসের রং-কে পোড়া মোবিলের সাথে তুলনা করতেও পিছপা হয়না আজকের তরুণ প্রজন্ম।
এর একটাই কারণ, আজকের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম পুরোনো আবেগের চেয়েও কোয়ালিটির উপরে বেশি গুরুত্ব দেন। আজকাল আর তাঁরা নিজেদের গুগল পে শুধুমাত্র ঐতিহ্য দেখে স্ক্যান করেন না। এব্যাপারে তাঁরা অনেক কম রোম্যান্টিক, অনেক বেশী নির্মম। যেখানে তাঁদের সময় এবং অর্থের গুরুত্ব আছে, তাঁরা সেখানেই যান। তারজন্য একটু অতিরিক্ত গ্যাঁটের কড়ি খরচ করতেও তাঁরা পিছপা নন, যদি সার্ভিস ঠিকঠাক পাওয়া যায়।
এককালে কেএফসির চিকেন উইংস-কেও শকুনের মাংসের অপবাদ দেওয়া হয়েছিল। বিস্বাদের স্যালাডকে এখনও অনেকেই ঘাসফুস বলে তাচ্ছিল্য করেন। উইকএন্ডের শপিং মলের ফুডকোর্টগুলো কিন্তু অন্য কথা বলছে। আর কে না জানে, আজকের দিনে ফুডকোর্ট আর কেবিনের মধ্যে দিনের শেষে শেষ হাসি কারা হাসেন।
কালিদাস সময় থাকতে বোঝেননি।
লাল হলুদের মাঠ করা অভিজ্ঞ কর্তাব্যক্তি, প্রাক্তনীরা কি বুঝবেন?