১৯৭৫ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত রমেশ সিপ্পির ‘শোলে’ ভারতীয় সিনেমাজগতের সর্বকালের কাল্ট সিনেমাগুলোর একটা। সেই ছায়াছবিরই একটা দৃশ্য ছিল এরকম – গব্বর সিং তিনজনের গর্দান তাক করে পিস্তল চালাচ্ছেন, কিন্তু ভাগ্যক্রমে গুলি চলছে না। একে একে তিনজনেই বেঁচে যাচ্ছেন।
এসসি ইস্টবেঙ্গলের অবস্থাও অনেকটা বন্দুকের নলের সামনে দাঁড়ানো মানুষগুলোর মতোই। শেষ চারের দৌড়ে ট্রাপিজের সরু সুতো দিয়ে হাঁটছে লাল-হলুদ বাহিনী। মুহূর্তের অসতর্কতায় তলিয়ে যেতে হতে পারে লীগ টেবিলের অতল খাদে, যেখান থেকে আর কামব্যাক সম্ভব নয়। সেমিফাইনালের লড়াইয়ে টিকে থাকতে হলে সব ম্যাচই এখন ব্রাইট-স্টেইনম্যানদের জন্য ডু অর ডাই। অর্থাৎ, আনুষ্ঠানিকভাবে টুর্নামেন্টের নক-আউট রাউন্ড শুরুর অনেক আগেই এসসি ইস্টবেঙ্গলে এখন “হয় মারো, নয়তো মরো” আবহ।
হাইভোল্টেজ ম্যাচ খেলতে নামার আগে দেখে নেওয়া যাক দুই শিবিরের বর্তমান অবস্থা।
হায়দ্রাবাদ এফসি:
প্রতিপক্ষ হায়দ্রাবাদ এফসিকে ফুটবল বিশেষজ্ঞরা বলছেন এবারের টুর্নামেন্টের ডার্ক হর্স। গতবছর ৩৯ গোল খেয়ে সর্বশেষ স্থান পাওয়া দলটাই এইবার ম্যানুয়েল মার্কুয়েজের হাতে পড়ে বদলে গেছে। ১৬ ম্যাচে ২৩ পয়েন্ট নিয়ে শেষ চারের দৌড়ে প্রবল ভাবেই রয়েছে এই বছরই বরুসিয়া ডর্টমুন্ডের সঙ্গে দুই বছরের পার্টনারশিপের চুক্তি করা ক্লাবটি। যার পুরস্কারস্বরূপ হায়দ্রাবাদ এফসি-র ম্যানেজমেন্ট কোচ ম্যানুয়েল মার্কুয়েজের সঙ্গে ২০২৩ পর্যন্ত চুক্তিও সেরে ফেলেছে।
১৬ ম্যাচে ২৩ পয়েন্ট রয়েছে এফসি গোয়া এবং নর্থইস্ট ইউনাইটেড এফসিরও। কিছু বর্তমান ফর্মের বিচারে হায়দ্রাবাদ এফসি লড়াই করছে সেয়ানে সেয়ানে। যে কারণে গত ৮টি ম্যাচে তাঁরা অপরাজিত। এরমধ্যে রয়েছে চেন্নাইন এফসি এবং নর্থইস্ট ইউনাইটেড এফসিকে পরপর চার গোল দেওয়া এবং লীগশীর্ষে থাকা মুম্বাই সিটি এফসির সঙ্গে গোলশূন্য ড্র। স্বাভাবিকভাবেই আত্মবিশ্বাসের সাথেই এসসি ইস্টবেঙ্গলের সঙ্গে খেলতে নামবে নিজামের শহরের দলটি।
হায়দ্রাবাদ এফসি দলের তরুণ ভারতীয় ব্রিগেড প্রায় প্রতি ম্যাচেই ফুল ফোটাচ্ছে। দুই সাইডব্যাক আশীষ রাই এবং আকাশ মিশ্র এবছরের আইএসএলের আবিষ্কার। জানুয়ারী মাসের “Emerging Player of the Month” পুরস্কারটাও পেয়েছেন আকাশ মিশ্র। আরেক সেন্টার ব্যাক চিংলেনসানা সিং-ও ডিফেন্সে ভরসা জোগাচ্ছেন। প্রতিশ্রুতি জাগিয়ে কেরিয়ার শুরু করলেও কোথাও যেন হারিয়ে গিয়েছিলেন হোলিচরণ নার্জারি। এই মরশুমে যেন নিজেকে নতুন করে ফিরে পেয়েছেন। আইএসএলের প্রথম সাক্ষাতে এসসি ইস্টবেঙ্গলের জালে বলও জড়িয়েছিলেন তিনি। চার-চারটি গোল হয়ে গেছে তাঁর। রয়েছেন কলকাতা ময়দানে খেলা শৌভিক চক্রবর্তী, নিখিল পূজারীরাও। এছাড়াও আরেক প্রতিশ্রুতিমান খেলোয়াড় হিতেশ শর্মা রয়েছেন টিমে।
তবে এই মরশুমে একজনের কথা না বললেই নয়, তিনি লিস্টন কোলাসো। এফসি গোয়ার রিজার্ভ দল থেকে উঠে আসা বাইশ বছর বয়সী এই উইঙ্গার আইএসএলের বিদেশী স্ট্রাইকারদের ভীড়ে রোজই নিজের জাত চেনাচ্ছেন। এই মরশুমে দুটো গোল, তিনটে এসিস্ট তাঁর নামের পাশে। যার মধ্যে দুটি এসিস্ট এসেছিলো এসসি ইস্টবেঙ্গলের বিরুদ্ধে প্রথম লেগে পরিবর্ত হিসেবে নামার পর।
বিদেশীদের মধ্যে আরিদানে সান্তানা ৭ গোল করে এবারের আইএসএলে সর্বোচ্চ গোলদাতার তালিকায় ৬ নম্বরে। এসসি ইস্টবেঙ্গলের বিরুদ্ধে ম্যাচে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে দু গোল করে পিছিয়ে পড়া হায়দ্রাবাদ এফসিকে জিতিয়েছিলেন। আশা করা যায়, সান্তানাকে ছেড়ে রাখার মতো ভুল আবারও করবে না এসসি ইস্টবেঙ্গলের ডিফেন্স। এছাড়াও নজরে রাখতে হবে ব্রাজিলিয়ান মিডফিল্ডার জোয়াও ভিক্টরকে। ডিফেন্সে যথেষ্ট ভরসাযোগ্য স্প্যানিশ ওনাইন্দিয়া। মনে রাখতে হবে, সবচেয়ে কম গোল খাওয়ার নিরিখে (১৬) তিন নম্বরে আছে হায়দ্রাবাদ এফসি, লীগ টেবিলের প্রথম ও দ্বিতীয় স্থানে থাকা মুম্বাই সিটি এফসি (১১) এবং এটিকে মোহনবাগানের (১০) পরেই।
সবমিলিয়ে, তরুণ ভারতীয় প্রতিভা এবং অভিজ্ঞ বিদেশীদের সংমিশ্রণে এবারের আইএসএলে হায়দ্রাবাদ এফসি-র উত্থান অনেক টিমের কাছেই উদাহরণ হয়ে থাকবে, বিশেষত যাঁরা খুব দ্রুত অধৈর্য্য হয়ে কোচ এবং তরুণ খেলোয়াড়দের সময় দিতে চান না একদমই।
এসসি ইস্টবেঙ্গল:
এবারে তাকানো যাক লাল-হলুদ শিবিরের দিকে। গত জামশেদপুর এফসি ম্যাচে ৬ মিনিটের মাথায় গোল পেয়ে যাওয়ায় ম্যাচের দখল নিতে সুবিধে হয় এসসি ইস্টবেঙ্গলের। বেশীরভাগ ম্যাচেই প্রথমে গোল হজম করে চাপে পড়ে যাচ্ছে দল, যেখান থেকে ফিরে আশা সম্ভব হচ্ছে না। আসলে পিছিয়ে পড়ে ম্যাচ জিতে আসার মতো স্ট্রাইকিং ফোর্সের অভাব রয়েছে রবি ফাউলারের দলে, তা সে যতই স্টেইনম্যান, মাঘোমা-রা গোল করুন। গত ম্যাচে পিলকিংটন গোল করে ম্যাচ জেতালেও গোটা টুর্নামেন্টে সেভাবে দাগ কাটতে পারেননি। তবে জানুয়ারী ট্রান্সফার উইন্ডোর শেষদিকে সার্থক গলুই, সৌরভ দাসদের দলে অন্তর্ভুক্তি টিম কম্বিনেশনে অনেকটাই সাহায্য করেছে। অনেকদিন পর লাল-হলুদে বাঙালী ভূমিপুত্রদের ছড়াছড়ি, যা অত্যন্ত ভালো একটি দিক। অভিজ্ঞ সুব্রত পাল আসায় একটানা ম্যাচ খেলার ক্লান্তি থেকে মুক্তি পেয়েছেন দেবজিৎ মজুমদারও। কে না জানে, এই আইএসএলে ব্যস্ততম লাল হলুদ সৈনিক যে তিনিই।
এই মরশুমে হয়তো দ্বিতীয়বার অপরিবর্তিত প্রথম একাদশ মাঠে নামতে চলেছে। এর আগে গত ১৫ই জানুয়ারী কেরালা ব্লাস্টার্সের বিরুদ্ধে প্রথম একাদশে কোনও পরিবর্তন করেননি কোচ রবি ফাউলার। চোট সারিয়ে রাজু গায়কোয়াড় ফিরে আসায় স্কট নেভিলকে বসিয়ে আপফ্রন্টে স্টেইনম্যান-ব্রাইট-মাঘোমা-পিলকিংটনদের চতুর্ভুজ খেলাতে পারছেন রবি ফাউলার, টনি গ্র্যান্টরা। জেতা ছাড়া কোনও গতি নেই এসসি ইস্টবেঙ্গলের, কারণ একগাদা পয়েন্ট নষ্ট করে করে লীগের সব ম্যাচই এখন নকআউট টিমের কাছে। আর জিততে যখন হবেই, তখন শুরু থেকেই আক্রমণাত্মক খেলে গোল তুলে নেওয়ার চেষ্টা করাই স্বাভাবিক।
তবে এসসি ইস্টবেঙ্গল টিম ম্যানেজমেন্টকে চিন্তায় রাখবে টিমের একাধিক খেলোয়াড়ের তিনটে করে হলুদ কার্ড। ড্যানি ফক্স, স্কট নেভিল, নারায়ণ দাস – ডিফেন্সের তিন স্তম্ভই তিনটে করে হলুদ কার্ড দেখে বসে আছেন। সঙ্গে সার্থক গলুই, জ্যাক মাঘোমা আর এরোন হলোওয়ে – এরাও তিনটে হলুদ কার্ড দেখে সাসপেনশনের খুব কাছাকাছি। বিশেষত হলোওয়ে বাদে বাকিরা প্রায় সবাই প্রথম দলের খেলোয়াড়। আজ এঁদের মধ্যে কেউ আরেকটা কার্ড দেখা মানেই কলকাতা ডার্বি থেকে ছিটকে যাবেন। আর এবছরের আইএসএলে রেফারিংয়ের যা মান, সাসপেনশনের আশঙ্কা খুব একটা অমূলক নয়।
তবে যাই হোক, কয়েকটা ম্যাচে মুহূর্তের ভুলে পয়েন্ট নষ্ট করে (গত হায়দ্রাবাদ এফসি ম্যাচটাই তার অন্যতম একটি উদাহরণ) নিজেরাই নিজেদের কাজটা কঠিন করে ফেলেছেন লাল হলুদ ফুটবলাররা। এখন অন্য টিমগুলোর দিকে তাকিয়ে তো থাকতেই হবে, কিন্তু তার আগে নিজেদের ম্যাচগুলোও যে জিততেই হবে। অন্য কোনও টিম হলে হয়তো আগেই আশা ছেড়ে দিতো, কিন্তু টিমটার নাম যে ইস্টবেঙ্গল, যারা হারার আগে হারতে জানে না। আশা করা যায়, টিমের এতগুলো বাঙালী খেলোয়াড়, যাঁরা লাল হলুদ জার্সিটার আবেগ ও মর্যাদাটা বোঝেন, যাঁরা কোটি কোটি ইস্টবেঙ্গল সমর্থকের চোয়ালচাপা লড়াইয়ের ইতিহাসটা জানেন, তাঁরা নিশ্চয়ই এই কথাগুলো অন্যদের মাথায় ঢুকিয়েছেন। আশা করা যায়, তিলক ময়দানে আইএসএলের শেষ চারের স্বপ্ন বাঁচিয়ে রাখতে প্রাণপাত করবেন লাল-হলুদ জার্সিধারীরা। বাকিটা ৯০ মিনিটের শেষে দেখাই যাক না।
শোলে-তে কালিয়াদের শেষটা সুখকর হয়নি। এসসি ইস্টবেঙ্গল নিশ্চয়ই সেই অবস্থায় পড়তে চাইবে না। তাই আজ না হয় শোলের ভিলেন গব্বর সিংয়ের একটা ডায়লগই এসসি ইস্টবেঙ্গল শিবিরের মোটিভেশনের পেপটক হোক –
“যো ডর গ্যায়া, সমঝো মর গ্যায়া”