‘দ্য টক্সটেথ টেরর’ !
১৯৯৪ এর অগস্টের শেষাশেষি এক মনোরম বিকেল৷ বিশ্ববিখ্যাত অ্যানফিল্ড স্টেডিয়ামে মুখোমুখি ইংলিশ ফুটবলের দুই ট্র্যাডিশনাল জায়েন্ট লিভারপুল ও আর্সেনাল ৷ লি ডিক্সন, মার্টিন কিওন, টনি অ্যাডামস্, নাইজেল উইন্টারবার্ন ও ডেভিড সিম্যান সমৃদ্ধ আর্সেনাল রক্ষণের বিপক্ষে লিভারপুল কিংবদন্তি ইয়ান রাশ, সাথে শহরেরই টক্সটেথ এলাকায় জন্মানো, ক্লাবের যুব দল থেকে উঠে আসা সদ্য টিনএজ পেরনো এক ছটফটে তরুণ৷ পরবর্তীকালে ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের ইতিহাসে অন্যতম শ্রেষ্ঠ ব্যাকলাইন হিসেবে পরিচিতি পাওয়া এই ডিফেন্সের বিরুদ্ধে মাত্র একটি মরসুম প্রথম ডিভিশনে খেলা, অনভিজ্ঞ এই ছেলেটিকে শুরু থেকে নামিয়ে কোচ রয় ইভান্স সঠিক সিদ্ধান্ত নিলেন কিনা, এই নিয়ে দুশ্চিন্তায় স্টেডিয়ামে উপস্থিত প্রায় তিরিশ হাজার দর্শক ৷তখনি ঘটে গেল এমন কিছু, যার জন্য প্রস্তুত ছিলেন না কেউই ৷ ম্যাচের বয়স যখন ২৬ মিনিট, কিওনের একটি মিসক্লিয়ারেন্সে বল রাশের পা হয়ে তার কাছে আসতেই একটা ছোট্ট হাফটার্নে প্রথম গোলটি করলো সেই ছেলে৷ দুমিনিট পর, ঘনিষ্ঠ বন্ধু স্টিভ ম্যাকম্যানাম্যানের পাস থেকে কোনাকুনি প্লেসমেন্টে দ্বিতীয় গোল ৷ ততক্ষণে নড়েচড়ে বসেছে দশকের পর দশক মহীরূহদের জন্ম দিতে থাকা এই স্টেডিয়াম, ষষ্ঠেন্দ্রিয় দিয়ে পেতে শুরু করেছে এক নতুন অধ্যায়ের ঘ্রাণ৷ আড়াই মিনিট পর জন্ বার্নসের থ্রু ধরে তৃতীয়বার সিম্যানকে পরাস্ত করলো ছেলেটি ৷ সাথে সাথে রচিত হলো এক নতুন রেকর্ড, প্রিমিয়ার লিগের ইতিহাসে দ্রুততম হ্যাটট্রিকের৷ ৩-০ ফলে শেষ হয় ম্যাচ, একইসাথে প্রতিষ্ঠিত হয় এক নতুন শব্দগুচ্ছ, ‘দ্য টক্সটেথ টেরর’ !
মার্সিতীরের নতুন তারকা
আজ ভাবতে যতই অবিশ্বাস্য লাগুক, এভাবে উল্কার মতোই ব্রিটিশ ফুটবলের মূলস্রোতে আবির্ভূত হন রবার্ট বার্নার্ড ফাউলার ৷ ৭০ ও ৮০র দশকের মিথতুল্য সাফল্যের পর, ৯০ এর দশকের গোড়া থেকে যখন ক্রমশ মধ্যমেধায় নিমজ্জিত হচ্ছে ইউরোপের অন্যতম সেরা এই দল, তখন প্রায় একার হাতে ক্লাবের বদ্ধ হতে থাকা পরিবেশে নতুন প্রাণের সঞ্চার ঘটান এই উঠতি প্রতিভা ৷ ১৯৯৩ সালে লিগ কাপে ফুলহ্যামের বিরুদ্ধে দুই লেগ মিলিয়ে ৬ গোল করে প্রথম প্রচারের আলোয় এলেও, স্টার হয়ে ওঠার জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছিল আরো এক বছর, উপর্যুক্ত সেই ঐতিহাসিক ম্যাচ পর্যন্ত৷ সেই মরসুমেই একইসাথে ইয়ান রাশকে টপকে লিভারপুলের সর্বোচ্চ গোলদাতা ও ‘পিএফএ ইয়াং প্লেয়ার অফ দ্য ইয়ার’ পুরস্কারপ্রাপ্তি৷ লিভারপুলের হয়ে তাঁর প্রথম ট্রফি জয় ১৯৯৫ সালের লিগ কাপ, যেখানে সেমিফাইনালের দুটি পর্বেই ক্রিস্টাল প্যালেসের বিরুদ্ধে গোল করেন৷ দ্বিতীয়বার এই ট্রফি জেতেন ২০০০-২০০১ মরসুমে, ফাইনালে তিনিই ছিলেন বার্মিংহামের বিরুদ্ধে লিভারপুলের একমাত্র গোলদাতা ৷
সাময়িক প্রস্থান
তিন মাসের মধ্যে পরপর এফএ কাপ আর উয়েফা কাপ জিতলেও, ম্যানেজার জেরার্ড হুলিয়েরের সাথে মতানৈক্যের জেরে মরসুম শেষে প্রিয় ক্লাব ছেড়ে পাড়ি দেন গত কয়েক বছরে সাড়া ফেলে দেওয়া লিডস্ ইউনাইটেডে ৷ চোট আঘাত জর্জরিত দুটি মরসুমে বলার মতো কোন পারফর্মেন্স না থাকায়, ২০০৩ সালে দেনার দায়ে তলিয়ে যেতে থাকা লিডস্ ছেড়ে যান ম্যানচেস্টার সিটিতে ৷ কেরিয়ারের এই পর্যায়ে এসে ফাউলার লিভারপুলের সেই চেনা বিষ্ফোরক ফর্মের ধারেকাছে না থাকলেও, ২০০৪-০৫ মরসুম সিটির যুগ্ম সর্বোচ্চ গোলদাতা হিসেবে শেষ করেন ৷
প্রত্যাবর্তন
ম্যানচেস্টারের নীল অর্ধে আরো একটি মরসুম কাটানোর পর, অবশেষে, ২০০৬ এর জানুয়ারিতে এলো সেই বহু প্রতীক্ষিত মুহূর্ত ৷ লিভারপুলে ফিরলেন ফাউলার, ঘরের ছেলেকে দুহাত বাড়িয়ে নস্টালজিয়াসিক্ত অভ্যর্থনা জানালেন সমর্থকেরা৷ এর দেড় মরসুম বাদে, তিন বছরের মধ্যে দ্বিতীয়বার লিভারপুলকে চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ফাইনালে তুলে, শেষবারের মতো অ্যানফিল্ড ছেড়ে যখন কেরিয়ারের বাণপ্রস্থ কাটাতে কার্ডিফের পথে রওনা দিলো সেদিনের সেই ১৯ বছরের ছেলেটি, ততদিনে লিভারপুল সমর্থকদের কাছে সে ‘দ্য গড’, অ্যানফিল্ডের ঈশ্বর, নামের পাশে বিখ্যাত লাল জার্সিতে ৩৬৯ ম্যাচে ১৮৩টি গোল ৷
কেরিয়ার সায়াহ্নে
আরো দুটি সিজন কার্ডিফ আর ব্ল্যাকবার্নের হয়ে নিজের দেশের সর্বোচ্চ পর্যায়ে খেলার শেষে যখন অস্ট্রেলিয়ার উড়ান ধরছেন, ততদিনে তিনি ১৬৩টি গোল করে প্রিমিয়ার লিগের ইতিহাসে টপ স্কোরারদের মধ্যে একজন৷ অস্ট্রেলিয়াতে আরো কয়েকটি মরসুম কাটানোর পর, ২০১৫ সালে থাইল্যান্ডের ক্লাব মুয়াঙ্গথঙ্ ইউনাইটেডে থাকাকালীন ফাউলার তাঁর খেলোয়াড় ভূমিকা থেকে অবসরের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন ৷
এদেশে পদার্পণ
যাই হোক,এবার আসল প্রসঙ্গে আসা যাক৷ এবারেই প্রথম ইন্ডিয়ান সুপার লিগে অংশগ্রহণ করতে চলেছে আমার আপনার প্রাণের ক্লাব৷ আর আমাদেরই কোচের ভূমিকায় দেখা যেতে চলেছে এই লিভারপুল কিংবদন্তীকে ৷ নিঃসন্দেহে বলা যেতে পারে, আমাদের ক্লাবের ১০০ বছরের ইতিহাসে এর চেয়ে হাই প্রোফাইল কোচ কেউ আসেননি৷ গত মরসুমে এ-লিগের ক্লাব ব্রিসবেন রোর-এ অল্প সময়েই নজর কেড়েছিলেন৷ ফলে তাঁকে প্রস্তাব দিতে দ্বিধা করেননি আমাদের ইনভেস্টার শ্রী সিমেন্টের দায়িত্বপ্রাপ্ত অফিসিয়ালরা ৷
ফাউলার এসেছেন, সাথে এনেছেন বাল্যবন্ধু টনি গ্রান্টসহ আট জনের কোচিং টিম, তাঁর পরিচিত ৬ বিদেশি আর এক বাক্স রঙিন স্বপ্ন৷ যে স্বপ্ন তিনি দেখিয়েছিলেন আজ থেকে আড়াই দশক আগে, পশ্চিম ইউরোপের এক ওয়ার্কিং ক্লাস শহরের, হতাশায় তলিয়ে যেতে থাকা, ঠিক আমাদেরই মতো ক্লাবঅন্তপ্রাণ এক সাপোর্টার বেসকে৷ আর ঠিক এখান থেকেই শুরু হচ্ছে আমাদের দায়িত্ব৷ আসুন, ভালো ফলকে উদযাপন করি, খারাপ দিনে কোচ-প্লেয়ারদের পাশে থাকি৷ সাহেবকে বুঝিয়ে দি, খেলায় না হলেও, সমর্থনের মাপকাঠিতে আমরাই এদেশের লিভারপুল৷ রবি ফাউলার হয়ে উঠুন আমাদেরও কাল্ট হিরো, লালের পাশাপাশি লাল-হলুদ হয়ে উঠুক ওঁর জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ ৷
জয় ইস্টবেঙ্গল !
তথ্যসূত্র: দিজ ফুটবল টাইমস্, রবি ফাউলার আর্কাইভ
4 Comments
রবি ফওলার কি ইংল্যান্ড জাতীয় দলের হয়েও মাঠে নেমেছিলেন ? সেই বিষয়ে কিছু তথ্য জানতে চাই।
Lekhok er kache apnar anurodh pouche deoa hoeche.. 🙂
হ্যাঁ ইংল্যান্ড জাতীয় দলের হয়েও খেলেছেন ৷ এই বিষয়ক সব তথ্য পাবেন এই লিঙ্কে:
https://www.englandstats.com/player.php?pid=1072
Though a die-hard fan, I know little about the present team. I hope you will help this fan to adjust his dream according to the strength of this year’s combination.